ঘুরে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ

0
122

আবদুল মান্নান

ব্রিটিশ সাপ্তাহিক ‘দ্য ইকোনমিস্ট’ আমার একটি প্রিয় পত্রিকা, বিশেষ করে অর্থনীতি বিষয়ক তথ্য ও বিশ্লেষণের জন্য। রাজনীতি নিয়ে যখন দ্য ইকোনমিস্ট কোনো প্রতিবেদন প্রকাশ করে তাতে সাধারণত তাদের রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত হয়। তখন তারা বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ ও বিএনপির রাজনীতিকে ‘দুই বেগমের লড়াই’ হিসেবে আখ্যায়িত করে। পত্রিকাটির চলতি সংখ্যা কভিড-১৯ মহামারি পরবর্তীকালের বিশ্ব অর্থনীতি নিয়ে একটি বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, যা বেশ হতাশাব্যঞ্জক। প্রতিবেদক হেনরি কার লিখেছেন, বিশ্ব গড় অভ্যন্তরীণ প্রবৃদ্ধি গত বছরের তুলনায় ৮ শতাংশ সংকুচিত হবে। অথচ বিশ্ব মহামারিতে আক্রান্ত হওয়ার আগে ধারণা করা হয়েছিল চলতি বছরে বিশ্ব অর্থনীতি গড়ে ৩ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাবে। এখন আশঙ্কা করা হচ্ছে, সারা বিশ্বে যে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেবে তা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তীকালের মন্দাকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে। সারা বিশ্বে কয়েক কোটি মানুষ বেকার হবে, আনুমানিক ৯ কোটি মানুষকে হতদরিদ্র সীমার নিচে নিয়ে যাবে। চীনে যখন বছরের শুরুতে কভিড-১৯ মহামারি তাদের হুবাই প্রদেশের উহান শহরে আঘাত করে তখন চীন তাত্ক্ষণিক তাদের এই শিল্প শহরকে লকডাউন করে দেয়। তাদের এই ব্যবস্থাকে পশ্চিমের অনেক দেশ, যার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনও আছে, এই বলে ঠাট্টা করে যে এমন একটি হঠকারী ব্যবস্থা শুধু চীনের মতো একনায়কতান্ত্রিক দেশেই সম্ভব। এমনকি সেই সব দেশের অনেক গবেষকও এমন ব্যবস্থাকে উড়িয়ে দেন। কিন্তু যখন এই মহামারি দ্রুত ইউরোপে ছড়াতে থাকে, তখন এসব দেশের টনক নড়ে এবং তারাও চীনের অনুরূপ ব্যবস্থা নিতে শুরু করে, যদিও তত দিনে তাদের অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে। চীনের দ্রুত ব্যবস্থার ফলে তাদের অর্থনীতিতে সবার আগে গতি ফিরেছে। দ্য ইকোনমিস্ট আরো মন্তব্য করেছে, এই মহামারির ফলে বছর শেষে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে বিশ্বের উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশগুলো। ব্যাপকহারে বাধাপ্রাপ্ত হবে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য। চীন বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। আর যেহেতু চীনকে বলা হয় বিশ্বের কারখানা, কারণ বিশ্বের বেশির ভাগ দেশের শিল্পপ্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ চীনে তৈরি হয়, এমনকি অনেক দেশের নানা ধরনের শিল্পপণ্য চীনে সংযোজনও হয়, সেই চীন যদি আন্তর্জাতিক বাণিজ্য থেকে ছিটকে পড়ে, তাহলে বিশ্ব বাণিজ্যই ঝুঁকিতে পড়বে। বাস্তবে ঠিক তেমনটিই ঘটেছে, যে কারণে বিশ্বের অনেক নামিদামি প্রতিষ্ঠান চীন থেকে তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য গুটিয়ে ফেলছে।

দ্য ইকোনমিস্টের প্রতিবেদন পড়ে শেষ করার আগেই মঙ্গলবার আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফ আগামী দিনে বিশ্ব অর্থনীতির গতি-প্রকৃতি নিয়ে প্রকাশ করল, তাদের ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুক, যা এই অঞ্চলের অনেক বিশ্লেষক ও অর্থনীতিবিদকে হতবাক করে দিয়েছে। আইএমএফ তাদের প্রতিবেদনে বলছে, ২০২০ সালে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি আসবে ৩.৮ শতাংশ, যা বিশ্বের তৃতীয় আর এশিয়া ও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ। এই সময়ে বিশ্বের মাত্র ২৩টি দেশে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি যোগের ঘরে থাকবে, যার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে শুধু গায়ানা ও দক্ষিণ সুদান। এই দুটি দেশ বাংলাদেশের চেয়ে অনেক কম ঘনবসতিপূর্ণ আর সেখানে কভিড-১৯-এর প্রকোপ ছিল কম। এ পর্যন্ত গায়ানায় মহামারিতে মৃত্যু হয়েছে ১০৬ জনের আর দক্ষিণ সুদানে মাত্র ৫৫ জনের। আইএমএফ তাদের পূর্বাভাসে আরো বলছে, ২০২০ সালে ভারতের জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে মাইনাস ১০.৩ শতাংশ, পাকিস্তানের মাইনাস ০.৪ শতাংশ। চলতি বছরে বাংলাদেশের গড় মাথাপিছু জিডিপি হিসেবে বাংলাদেশ ভারতের চেয়ে এগিয়ে যাবে। যেখানে ভারতের হবে এক হাজার ৮৭৭ মার্কিন ডলার, সেখানে বাংলাদেশের হবে এক হাজার ৮৮৮ মার্কিন ডলার। অথচ গত পাঁচ বছর ভারতের মাথাপিছু জিডিপি আয় বাংলাদেশের তুলনায় ২৫ শতাংশ বেশি ছিল। এসব ঘটছে যখন চলতি মহামারির কারণে বিশ্ব অর্থনীতি ৪.৪ শতাংশ সংকুচিত হবে বলে ধারণা করা হয়। ভারতের গড় মাথাপিছু জিডিপির হিসাবে পিছিয়ে থাকলেও দেশটি ক্রয়ক্ষমতা সমতার হিসাবে (পারচেজিং পাওয়ার প্যারিটি) বাংলাদেশ থেকে এগিয়ে আছে। এই সংখ্যা যেখানে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে পাঁচ হাজার ১৩৯ মার্কিন ডলার হিসাব করা হয়েছে, সেখানে ভারতের হবে ছয় হাজার ২৮৪ মার্কিন ডলার। পরের বছর ভারতের পরিস্থিতি উন্নতির দিকে যাবে বলে আইএমএফের ধারণা। অর্থনীতিতে অনেক কিছুতেই স্থিতাবস্থা বজায় থাকে না, যে কারণে অর্থনীতিতে বহুল ব্যবহৃত একটি সাধারণ বাক্য হচ্ছে ‘অন্যান্য সব কিছু স্থিতাবস্থায় থাকা সাপেক্ষ’ (other things remaining the same)| সুতরাং ব্যষ্টিক বা সামষ্টিক, যেকোনো অর্থনীতি আলোচনার সময় তা সাবধানে করা ভালো। তার অর্থ বাংলাদেশের বর্তমান অর্জনকে কোনো অবস্থায়ই হালকা করে দেখার নয়। তবে অর্জনকে ধরে রাখা ও তার সঙ্গে নতুন নতুন অর্জন যোগ করার মধ্যে বাহাদুরি বেশি। আনন্দের খবর হচ্ছে, এ দেশের মানুষ তা করতে শিখেছে।

এই পর্যন্ত একাধিক আন্তর্জাতিক সংস্থা মহামারিকালে বিভিন্ন দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে সব সময় বাংলাদেশের অর্জন ইতিবাচক বলে মন্তব্য করেছে। যদিও তাদের দেওয়া সংখ্যা একটার সঙ্গে অন্যটার ভিন্নতা থাকে, যা স্বাভাবিক। আইএমএফের প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর ভারত ও বাংলাদেশে তা নিয়ে বেশ আলোচনা ও লেখালেখি হচ্ছে। দুই দেশের দুই দৃষ্টিভঙ্গি। ভারতের বিশ্লেষকরা প্রশ্ন করছেন, কী করে ভারতের অর্থনীতির এই করুণ দশা হলো? এসব আলোচনা যত না অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে করা হয়, তার চেয়ে তাতে বেশি থাকে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি। অন্যদিকে বাংলাদেশের বিশ্লেষকরা বিষয়টাকে অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছেন বেশি। তাঁরা এই ঘোর দুর্যোগকালে বাংলাদেশের এই অর্জনের পেছনের কারণ অনুসন্ধান করার চেষ্টা করেছেন এবং এ-ও বলেছেন, বাংলাদেশের অর্জন নিঃসন্দেহে অভিনন্দনযোগ্য, তবে তাকে ধরে রাখা অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং।

মহামারির এই কঠিন সময়েও বাংলাদেশের এই বিশ্বস্বীকৃতি অর্জনের পেছনে কারণ অনুসন্ধান করার জন্য আইনস্টাইন হওয়ার প্রয়োজন নেই। এই অর্জনের পেছনে আছে এ দেশের মানুষের হার না মানা চরিত্র, যা তারা একাত্তরে দেখিয়েছে। এরপর আছে দেশের নেতৃত্ব। এই দুটি বিষয় পরে আলোচনা করছি। একসময়ের কৃষি উৎপাদনের ওপর নির্ভরশীল বাংলাদেশ বর্তমানে তার অর্থনীতি সচল রাখার জন্য আরো কিছু খাতকে ওপরে তুলে এনেছে। যদিও এখনো কৃষি বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি। বিশ্বের অনেক দেশে কৃষিপণ্য আবাদ হয় না নানা কারণে। মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশে কোনো কৃষিপণ্য উৎপাদন হয় না পানি ও উর্বর জমির অভাবে। উত্তর গোলার্ধের একটা বিস্তীর্ণ এলাকা আর কয়েক সপ্তাহ পর বরফে ঢাকা পড়ে যাবে। সেখানে তখন কোনো কৃষিপণ্য আবাদ হবে না। এসব দেশ শীতকালে কৃত্রিম গ্রিনহাউস তৈরি করে কিছু শাক-সবজি উৎপাদন করে, যার উৎপাদনব্যয় হয় আকাশচুম্বী। আফ্রিকার অনেক দেশে ভালো জমি আছে, বৃষ্টি হয় ভালো, কিন্তু সেখানকার মানুষ জমি আবাদ করতে জানে না। তানজানিয়া তার একটি উত্কৃষ্ট উদাহরণ। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা বাহিনীতে কর্মরত বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা এই মহাদেশের অনেক স্থানে সেখানকার মানুষকে জমি চাষ করতে শেখাচ্ছে। এশিয়ার দেশগুলো প্রাকৃতিকভাবে কৃষিপণ্য উৎপাদন করার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত। কিন্তু আবার এসব দেশের অনেকগুলোতেই সমতল ভূমি নেই, যেমন জাপান। আবার একটা দেশ যখন কোনো কৃষিপণ্য উৎপাদন করে তার উল্লেখযোগ্য অংশ নিজেদের প্রয়োজন মেটাতে রেখে দেয়। নিজের পেট ভরলে তারপর অন্যের চিন্তা। বিশ্বে যত খাদ্যপণ্য উৎপাদন হয়, যেমন—চাল বা গম তার অল্প পরিমাণ আন্তর্জাতিক বাজারে আসে। চালের ক্ষেত্রে এর পরিমাণ ৪ শতাংশের বেশি নয়। আবার কোনো কারণে উৎপাদন ব্যাহত হলে তা-ও আসে না। তখন টাকা দিলেও খাদ্য পাওয়া কঠিন। ২০০৭ ও ২০০৮ সালে তা এই দেশে হয়েছিল। শেখ হাসিনা পিতার মতো এটি উপলব্ধি করেছিলেন যে দেশের অগ্রগতি নিশ্চিত করতে হলে সবার আগে কৃষির ওপর নজর দিতে হবে। ১৯৯৬ সালে সরকার গঠন করে তিনি সারের দাম অর্ধেক করে দিয়েছিলেন। ডিজেলের ওপর ভর্তুকি বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। বর্তমানে বাংলাদেশ ১৯৭২-৭৩ সালের তুলনায় প্রায় চার গুণ চাল উৎপাদন করে। এই বছর যদিও দেশের এক-তৃতীয়াংশ অঞ্চল বন্যায় ডুবে গিয়েছিল, ফসলের বেশ বড় ক্ষতি হয়েছিল, তথাপি ২০১৯-২০ অর্থবছরে তিন কোটি ৮৯ লাখ টন চাল উৎপাদন করেছে বাংলাদেশের কৃষক। চাল উৎপাদনকারী শীর্ষ ১০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান বর্তমানে তৃতীয়, যা আগে ইন্দোনেশিয়ার দখলে ছিল। গম ও ভুট্টার ফলনও ভালো হয়েছে। চলতি অর্থবছরে বোরোর উৎপাদনও ভালো হয়েছে। কৃষিক্ষেত্রে বাংলাদেশের অন্যতম সমস্যা উৎপাদন নয়, বরং সঠিক বিতরণ ও সরবরাহ ব্যবস্থা সৃষ্টি করা। দেশে খোলাবাজারে চালের দাম যতই বাড়তি থাকুক কৃষক প্রায়ই তার পণ্যের ন্যায্য মূল্য পায় না। চালের সরবরাহ ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করেন মিলমালিক, আড়তদার আর পাইকাররা। তাঁরা সবাই মিলে একটি সিন্ডিকেট।

বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্প দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই শিল্পে প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক কাজ করে। মহামারি শুরুর প্রথম দিকে এই খাতসহ সমগ্র রপ্তানি খাত বেশ বড় রকমের ধাক্কা খেয়েছিল, কারণ আমদানিকারক দেশগুলোর বেশির ভাগই মহামারিতে সম্পূর্ণ পর্যুদস্ত। সব ধরনের বন্দর বন্ধ। চারদিকে এক ধরনের হায় হায় রব। এর মধ্যে এসব দেশে যে বাংলাদেশিরা কাজ করত তারা দলে দলে দেশে ফেরা শুরু করেছে। দেশের সব তৈরি পোশাক কারখানা বন্ধ ঘোষণা করা হলো। এগিয়ে এলো সরকার বিভিন্ন প্রণোদনা প্যাকেজ নিয়ে। মাস দুয়েকের বিরতি দিয়ে আবার কারখানা খুলল, শুরু হলো রপ্তানি। বর্তমানে এই খাত অনেকটা তার আগের অবস্থায় ফিরে গেছে। শুধু পোশাক নয়, অন্যান্য রপ্তানি পণ্যও বিদেশ যাওয়া শুরু করল। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের আর চীনের সঙ্গে ভারতের বৈরী সম্পর্কের কারণে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে কিছুটা সুবিধা পেয়েছে। ২০১৯ সালে বাংলাদেশ ৪৫.৭ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আন্তর্জাতিক বাজারে রপ্তানি করেছে। সরকারি হিসাবে বাংলাদেশের জনসংখ্যা যদি সাড়ে ১৬ কোটি হয়, তাহলে দেশের প্রতিজন মানুষের ভাগে পড়েছে ২৭৫ মার্কিন ডলার রপ্তানি আয়। স্বাধীনতার সময় বাংলাদেশের মাথাপিছু গড় আয় ছিল ৭০ ডলার আর জনসংখ্যা ছিল সাড়ে সাত কোটি।

যেসব বাংলাদেশি শ্রমিক বিদেশ থেকে দেশে ফিরেছিল, তারা নিজেদের কাজে ফিরতে শুরু করেছে। তাদের ছাড়া ওই সব দেশের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা অনেকটা অচল। কারণ ওই সব দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সংখ্যাটি নিম্নগামী হওয়ায় সেই সব দেশে অনেক শ্রমঘন কাজ করার জন্য শ্রমিকের প্রচণ্ড ঘাটতি। বিদেশ থেকে শ্রমিক না গেলে ইউরোপের বা অনেক আরব দেশের রাস্তায় ট্যাক্সি চলবে না, রেস্টুরেন্ট খুলবে না, খুচরা পণ্য বেচাকেনা বন্ধ হয়ে যাবে। বন্ধ হবে অনেক সেবা খাত। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব মতে, বিদেশে কর্মরত আমাদের শ্রমিকদের কাছ থেকে বাংলাদেশ সেপ্টেম্বর মাসে ১৮ হাজার ২০০ কোটি টাকা (১৮২ বিলিয়ন) পেয়েছে, যা আগের মাসের তুলনায় প্রায় এক হাজার ৪০০ কোটি টাকা বেশি। বর্তমানে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে, যা আগামী ছয় মাসের আমদানি খরচ মেটাতে সক্ষম।

বাংলাদেশের এই অভাবনীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নের পেছনে অন্যতম কারণ শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে সরকার গঠন করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর উদযাপনকে সামনে রেখে দেশের জন্য ২০২১ রূপকল্প তৈরির দিকে নজর দিয়েছিলেন। নেতা হতে গেলে দূরদৃষ্টি বা ভিশন থাকতে হয়, যা বঙ্গবন্ধুকন্যার আছে। এরই মধ্যে তিনি তাঁর কাজ দ্বারা তা প্রমাণ করেছেন। মহামারি শুরু হওয়ার পর পর দেশের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থাকে সুরক্ষার জন্য তিনি যে কটি পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, তা এখন ফল দিচ্ছে। তবে এটাও ঠিক সরকারের প্রশাসনযন্ত্রকে যদি দুর্নীতিমুক্ত করা যেত, তাহলে বাংলাদেশের অবস্থান আরো অনেক ওপরে উঠতে পারত। বর্তমান অর্জনকে ধরে রাখতে হলে প্রথমে প্রশাসনসহ সব ক্ষেত্রকে দুর্নীতিমুক্ত করতে হবে। এটি হচ্ছে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশের উন্নয়নের লক্ষ্য ভারতকে টেক্কা দেওয়া নয়। ভারত একটি জটিল ও বহুমাত্রিক দেশ। সেই দেশের গন্তব্য কী হবে তা সে দেশের নীতিনির্ধারকরা ঠিক করবেন।

এইচএসবিসি ব্যাংক তাদের এক গবেষণায় বলেছে, ২০৩০ সালে বাংলাদেশ বিশ্বের ২৬তম বৃহত্তম অর্থনীতি হবে। তেমনটা যদি হতে হয়, তাহলে বাংলাদেশকে মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, সিঙ্গাপুরের পাশাপাশি হাঁটতে শিখতে হবে আর তার জন্য চাই মানবসম্পদ উন্নয়নে আরো বেশি পরিমাণ বিনিয়োগ। বর্তমানে দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা বা উপরিকাঠামো যেভাবে উন্নত হচ্ছে তা অচিরেই ইতিবাচক ফল দেবে। দেশে আরো বেশি কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা জরুরি। মহামারি পরবর্তীকালে চীন থেকে অনেক বিদেশি কম্পানি নিজেদের ব্যবসা গুটিয়ে ভারত, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, কেনিয়া প্রভৃতি দেশে যাচ্ছে। বাংলাদেশে আসার তেমন একটা আগ্রহ তাদের মধ্যে দেখা যায় না। কারণ এ দেশে এসব শিল্পে কাজ করার জন্য দক্ষ জনশক্তির এখনো প্রচণ্ড ঘাটতি রয়েছে। দেশের শিক্ষাব্যবস্থা এখনো পরীক্ষা ও সনদনির্ভর। সেখান থেকে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে বের করে আনতে হবে।

দেবদ্বীপ পুরোহিত ভারতের ডেইলি টেলিগ্রাফের একজন অর্থনীতি বিষয়ক প্রতিবেদক। তিনি ২০১৯ সালের ৩ এপ্রিল তাঁর এক নিয়মিত বিশ্লেষণে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রশংসা করতে গিয়ে শেখ হাসিনার ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন এবং লিখেছিলেন ‘বাংলাদেশ আর কখনো একজন শেখ হাসিনা পাবে না।’ এবারও তিনি বাংলাদেশের মহামারিকালীন অর্জন সম্পর্কে টেলিগ্রামে লিখতে গিয়ে অনেকটা একই কথা বলেছেন এবং আরো বলেছেন এই অগ্রগতি জিইয়ে রাখতে হলে বাংলাদেশকে ২০০৯-পূর্ববর্তী রাজনীতিতে ফিরে গেলে চলবে না। বাংলাদেশের এই সময়ের অর্জনে নিশ্চয় দেশের মানুষ গর্বিত, তবে যেতে হবে অনেক দূর, যা সহজ নয়, তবে সম্ভব।

লেখক : বিশ্লেষক ও গবেষক

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here