বিশেষ সাক্ষাৎকারে অর্থমন্ত্রী : দেশের স্বার্থে দরকার শক্তিশালী বিরোধী দল

0
782

মানিক মুনতাসির, ম্যানিলা, ফিলিপাইন থেকে

অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন, দেশের স্বার্থে একটা শক্তিশালী বিরোধী দল প্রয়োজন। বিএনপি পার্টি হিসেবে শেষ হয়ে গেছে। আর জাতীয় পার্টির বিরোধী দল হওয়ার মতো সক্ষমতা নেই। তিনি বলেন, দারিদ্র্য বিমোচন ও উচ্চতর প্রবৃদ্ধি অর্জন আমার সবচেয়ে বড় সফলতা। ব্যর্থতা হলো ব্যাংকিং খাতের নৈরাজ্য, এটা সরকারের পাশাপাশি অর্থমন্ত্রী হিসেবে আমারও ব্যর্থতা। তিনি আরও বলেন, মিয়ানমার একটি সন্ত্রাসী রাষ্ট্র। তারা আমাদের সঙ্গে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। গত ৩-৬ মে ফিলিপাইনের ম্যানিলায় এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) ৫১তম বার্ষিক সভা অনুষ্ঠিত হয়। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল এতে বাংলাদেশের পক্ষে অংশ নেয়। ম্যানিলায় বাংলাদেশ প্রতিদিনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি দেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থা, সামাজিক প্রেক্ষাপট, রোহিঙ্গা ইস্যু, বাজেট বাস্তবায়নসহ বিভিন্ন বিষয়ে খোলামেলা আলোচনা করেন। টানা ১০ বছর অর্থমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকা আবুল মাল আবদুল মুহিত মনে করেন তার এই দীর্ঘ রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনে সবচেয়ে বড় সফলতা হচ্ছে, দারিদ্র্য বিমোচন ও উচ্চতর প্রবৃদ্ধি অর্জন। এ সময়ে তার বড় ব্যর্থতা হচ্ছে, ব্যাংকিং খাতের নৈরাজ্য। তিনি বলেন, এটা সরকারের পাশাপাশি অর্থমন্ত্রী হিসেবে আমারও ব্যর্থতা। দেশের উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতার স্বার্থে একটা শক্তিশালী বিরোধী দল প্রয়োজন বলে মনে করেন অর্থমন্ত্রী। তার মতে, বিএনপি শেষ হয়ে গেছে। জাতীয় পার্টির প্রধান বিরোধী দল হওয়ার মতো সক্ষমতা নেই। তিনি বলেন, মিয়ানমার একটি সন্ত্রাসী রাষ্ট্র।

অর্থমন্ত্রী বলেন, এখন দেশের মানুষ আর গরিব নেই। কম বেশি সবাই সঞ্চয় করে। এ জন্য বলি, আমার বড় সফলতা হচ্ছে, উচ্চতর জিডিপি প্রবৃদ্ধির ধারা ধরে রাখা। ৬ শতাংশের বৃত্ত ভেঙে উপরে উঠে আসা বাংলাদেশ গত ৭ দশমিক ২৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। চলতি বছর আশা করা হচ্ছে, এটা ৭ দশমিক ৬৫ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে। এ ছাড়া দারিদ্র্য বিমোচনে আমরা ব্যাপক সফলতা পেয়েছি। এক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী আমাদের সুনাম ছড়িয়ে পড়ছে। আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই দারিদ্র্যমুক্ত দেশ হিসেবে স্বীকৃতি অর্জন করব। ইতিমধ্যে আমরা উন্নয়নশীল দেশের কাতারেও প্রবেশ করেছি। ২০৪১ সালের আগেই বাংলাদেশ উন্নত দেশে পরিণত হবে। হয়তো আমি এবং আমরা কেউই তখন থাকব না। তবে এ দেশ যে একটা উন্নয়নের পথে উঠে গেছে সেই রাস্তা কেউই রুখতে পারবে না।

রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এবং টানা ১০ বছর মন্ত্রী থাকাবস্থায় সবচেয়ে বড় ব্যর্থতার কথা তিনি নিজে অকপটে স্বীকার করেন। তিনি বলেন, আমরা ব্যাংক খাতের শৃঙ্খলা ধরে রাখতে পারিনি। এখনো এ খাতে নৈরাজ্য চলছে। তবে এ খাতে আমাদের অনেক অর্জনও রয়েছে। ব্যাংকের মাধ্যমে শিল্পায়ন হচ্ছে, কর্মসংস্থান বাড়ছে। আমাদের দেশে ব্যাংকের সংখ্যা অনেক বেশি বলে যারা অপপ্রচার করে আমি কিন্তু তা মনে করি না। আমাদের ঢাকায় জনসংখ্যা দুই কোটির কম নয়। আর সারা দেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটির উপরে। তাহলে এত মানুষের জন্য ৫৬ বা ৫৭টি ব্যাংক বেশি হয় কী করে। তবে হ্যাঁ সরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর অবস্থা খুবই খারাপ। এগুলোর এনপিএল (খেলাপি ঋণ) ৩০ শতাংশ। আর বেসরকারি ব্যাংকের এনপিএল ৭ শতাংশের নিচে। অবশ্য কোনো কোনো বেসরকারি ব্যাংকের অবস্থাও অনেক খারাপ। আমাদের এ খাতটাকে নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে।

আগামী বাজেট নিয়ে তিনি বলেন, বাজেট বাস্তবায়ন অবশ্যই অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে। আমরা এডিপি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে মান রক্ষার চেষ্টা করছি। নতুন যে বাজেট আসছে সেটা হয়তো আমার দেওয়া সর্বশেষ বাজেট হতে যাচ্ছে। বাংলাদেশের মন্ত্রী হিসেবে টানা ১০ বার এবং সর্বোচ্চ ১২ বার বাজেট দেওয়ার রেকর্ড করতে যাচ্ছি। পরবর্তী বছর হয়তো আমি আর মন্ত্রী থাকব না। এটা নির্ভর করছে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনার ওপর। তিনি চাইলে হয়তো থেকেই যাব। নতুবা এটাই আমার শেষ। তবে মন্ত্রী না থাকলেও সরকারের সঙ্গেই থাকব।

রোহিঙ্গা সংকট আমাদের বাজেটে এক ধরনের চাপ সৃষ্টি করছে বলে জানান অর্থমন্ত্রী। ফলে এবার বাজেট দিতে কিছুটা সমস্যা হবে। রোহিঙ্গা ইস্যুর কারণে প্রতি বছর আমাদের এক বিলিয়ন ডলার বেশি অর্থের প্রয়োজন হবে। যা বাজেট থেকেই দিতে হবে। তিনি বলেন, মিয়ানমার একটা সন্ত্রাসী রাষ্ট্র। তারা বাংলাদেশকে চাপে ফেলেছে। আবার আন্তর্জাতিক মাধ্যমকেও কেয়ার করছে না। এটা তাদের সন্ত্রাসী মনোভাবের কারণে হচ্ছে। আমরা চাইলে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে ঢুকার সুযোগ নাও দিতে পারতাম। কিন্তু তাতে হয়তো মিয়ানমারের সঙ্গে যুদ্ধই লেগে যেত। এমনিতেই তো মিয়ানমার যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। তাই মানবিক দিক বিবেচনায় নিয়ে আমরা তাদের থাকতে দিয়েছি। এখন যে কোনো মূল্যে ফেরত তো নিতেই হবে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সরকারি চাকুরেদের বেতন-ভাতা আর বাড়বে কিনা—জানতে চাইলে তিনি বলেন, নতুন আর এক টাকাও বেতন বাড়ানো হবে না। তারা নতুন বেতন কাঠামোর কথা বলেছেন কিন্তু সেটা এখন নয়। কারণ, প্রত্যেকেই অনেক টাকা আয় করেন। সরকারি চাকুরেদের প্রত্যেকেই কিছু না কিছু সঞ্চয় করেন। মূল্যস্ফীতিও সহনীয় রয়েছে। ফলে এ সময় আর নতুন কোনো বেতন কাঠামো নয়। তবে তারা বছর শেষে ৫ শতাংশ হারে ইনক্রিমেন্ট পাবেন। সেটা নিয়ম অনুুযায়ী। এমন কি আর কোনো বেতন কমিশন গঠন করা হবে না। জাতীয় পর্যায়ের সার্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালুর ব্যাপারে তিনি বলেন, আসছে বাজেটে এ সংক্রান্ত একটি প্রস্তাবনা ও পরিকল্পনা আমি তুলে ধরব। সেখানে সরকারি-বেসরকারি প্রত্যেক চাকরিজীবীই যেন পেনশনের সুুবিধা পান সে ব্যবস্থা করা হবে। এ ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য বাজেটে বক্তৃতাতেই থাকবে।

দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং আগামী সংসদ নির্বাচনের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, নির্বাচন হবে সময় মতোই এবং আবারও আওয়ামী লীগই ক্ষমতায় আসবে। কেননা, মানুষ হরতাল, মারামারি পছন্দ করেন না। মানুষ চায় কাজের পরিবেশ আর উন্নয়ন। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার সেটাই করছে। জাতীয় সংসদে বিরোধী দল না থাকায় সরকারের সমালোচনাকারী কেউ নেই। এটা রাজনীতির জন্য কতটা সুখকর কিনা জানতে চাইলে অর্থমন্ত্রী বলেন, দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আর উন্নয়নের জন্য একটা শক্তিশালী বিরোধী দল খুবই প্রয়োজন। বর্তমানে সেটা নেই। এক্ষেত্রে বিএনপি শেষ হয়ে গেছে। আগামী নির্বাচনের পরও প্রধান বিরোধী হতে পারবে না। আর জাতীয় পার্টির সে সক্ষমতা নেই যে ওই দলটি প্রধান বিরোধী দলের আসনে থাকবে। তাহলে ভবিষ্যতে কী হবে? এমন প্রশ্নের জবাবে হেসে দিয়ে মুহিত বলেন, এটা এখন বলা যাবে না। কিন্তু জবাবদিহিতার জন্য সংসদে একটা কার্যকর ও শক্তিশালী বিরোধী দল থাকতেই হবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here