দালালের প্রলোভনে পড়ে স্থানীয় এজেন্সির মাধ্যমে সৌদি আরব গিয়ে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্মম নির্যাতনের শিকার হবিগঞ্জের আব্দুল আহাদ মিয়া নামের এক যুবক। দালালের বিরুদ্ধে মামলা করেও কোন প্রতিকার পাচ্ছে না তার পরিবার। তাকে দেশে ফিরিয়ে আনাসহ দালালের বিরুদ্ধে দ্রুত আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানিয়েছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও ভুক্তভোগী পরিবার।

জানা যায়, হবিগঞ্জের চুনারঘাট উপজেলার আহমদাবাদ ইউনিয়নের গঙ্গানগর গ্রামের হতদরিদ্র পরিবারের ছেলে আব্দুল আহাদ (২৮)। অভাব অনটন থেকে মুক্তি পেতে রঙিন স্বপ্ন নিয়ে একই গ্রামের দালাল মাসুক মিয়ার মাধ্যমে মরুর দেশে ফাঁড়ি জমান তিনি। প্রায় ৬ মাস আগে ৪ লাখ টাকার বিনিময়ে স্থানীয় এজেন্সি সান ফ্লাওয়ার ট্রাভেলস এর মাধ্যমে সৌদি আরব যান আহাদ।

কিন্তু কথায় আছে, ‘অভাগা যেদিকে যায় নদী শুকিয়ে যায়।’ সৌদি আরব যাওয়ার পর ভাল কাজ পাওয়া তো দুরের কথা, মরুভূমিতে বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন স্বপ্নবাজ এই তরুণ। সেখানে যাওয়ার কয়েকদিন পরই পরিবারের সাথে সম্পূর্ণ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে আহাদের। নিখোঁজের অনেকদিন পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে তার আর্তনাদের একটি ভিডিও প্রচার হয়। ভিডিওটি ব্যাপক সাড়া ফেলে হবিগঞ্জবাসির মাঝে। ভিডিওটিতে দেখা যায়, আব্দুল আহাদ মরুভূমির উপর বসে বাঁচার জন্য আর্তনাদ করছেন। নিজের জীবন বাঁচাতে পরিবার, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ সরকারের কাছে সহযোগিতা চাচ্ছেন।

এদিকে, মাস খানেক আগে আহাদের পিতা বাদী হয়ে দালাল মাসুক মিয়ার বিরুদ্ধে মানবপাচার আইনে আদালতে মামলা দায়ের করেন। আদালত মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব দেয় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)কে। কিন্তু দীর্ঘ এক মাসেও মামলার কান অগ্রগতি হয়নি। এতে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন স্থানীয়রা। সেই সাথে আব্দুল আহাদকে দেশে ফিরিয়ে আনতে সরকারের কাছে সহযোগিতা কামনা করছেন তার স্বজন ও এলাকাবাসী।

এ ব্যাপারে আহাদের পিতা নুরুজ আলী বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে এলাকার ময়-মুরব্বিদের নিয়ে সালিশ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। বৈঠকে মাসুক মিয়া আমার ছেলেকে দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য অনেকবার তারিখ দিয়েছে। কিন্তু তারিখ আসলে সে আর ফোন রিসিভ করে না। এমনকি এলাকায়ও তাকে পাওয়া যায় না।’

ছেলে কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন আব্দুল আহাদের মা সগিরা খাতুন। তিনি বলেন, ‘মাসুক মিয়া আমার ছেলেকে আঙুর বাগানে চাকরি দেবে বলে ৪ লাখ টাকার বিনিময়ে সৌদি আরব পাঠায়। কিন্তু আমার ছেলেকে চাকরি না দিয়ে মরুভূমিতে ফেলে রেখেছে সে। আমার ছেলের দুটি বাচ্চা আছে। তারা কান্নাকাটি করে। ঠিকভাবে খাওয়া দাওয়া করে না।’

দালাল মাসুক মিয়ার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির পাশাপাশি আহাদকে দ্রুত দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য সরকারের নিকট জোর দাবি জানান এলাকাবাসীসহ স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। আহমদাবাদ ইউপি চেয়ারম্যান আবেদ হাসনাত চৌধুরী সন্জু বলেন, ‘মানব পাচার একটি ভয়ংকর অপরাধ। তাই মাসুক মিয়াকে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া উচিৎ।’

একসঙ্গে আব্দুল আহাদকে দেশে ফিরিয়ে আনতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন তিনি।

এ ব্যাপারে জানতে অভিযুক্ত দালাল মাসুক মিয়ার বাড়িতে গিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি। তবে আব্দুল আহাদকে সৌদিআরব পাঠানোর কথা শিকার করে মাসুক মিয়ার মা শ্যামলী চাঁন বলেন, ‘আব্দুল আহাদকে দেশে ফিরিয়ে আনতে আমার ছেলে মাসুক মিয়া চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।’

এদিকে, আব্দুল আহাদের মামলার তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে তদন্ত কর্মকর্তা নবারুণ গুপ্তের কাছে জানতে চাইলে তিনি এ ব্যাপারে কথা বলতে রাজি হননি। বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন মানবাধিকার কর্মীরা। তারা বলছেন, ‘এ ব্যাপারে সরকারের যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া উচিত। যাতে মানবাধিকার লঙ্ঘন না হয়। সেই সাথে দালালের ব্যাপারে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণসহ সংশ্লিষ্ট সকলের পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত।’

এসোসিয়েশন ফর ল’ রিফরর্মস এন্ড হিউম্যান রাইটস (এলার্ট) হবিগঞ্জ জেলা শাখার সভাপতি অ্যাডভোকেট মনসুর উদ্দিন আহমেদ ইকবাল বলেন, ‘শুধু আহাদ নয়, দালালদের খপ্পরে পড়ে আহাদের মতো অনেক যুবক বিদেশ গিয়ে নির্মম নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। তাই সরকারের উচিত এখনই এসব দালালদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া।’

এ সময় পরিবারকে স্বাবলম্বী করার জন্য বেশি লাভের আশায় না জেনে বুঝে বিদেশ যাওয়া এসব যুবকদের আরও সচেতন হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here