অসমাপ্ত যুদ্ধ এবং ভয়

0
630

অঘোর মন্ডল , এডিটর, দীপ্ত টিভি

অবরুদ্ধ পৃথিবী। স্তব্ধ সময়। তার ভেতরও অস্ফুট স্বর ভেসে আসছে, ‘পালাও, পালাও!’ অদৃশ্য এক যুদ্ধে বিপন্ন মানবতার স্বরই যেন ‘পালাও’। শত্রুর হাত থেকে বাঁচতে লুকাও। করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে মানুষ এখনও নিরস্ত্র। তার একটাই রণকৌশল। শত্রুর কাছ থেকে নিজেকে লুকিয়ে রাখা। পৃথিবীজুড়ে মানুষ লুকাচ্ছে। নিজের ঘরে। কিন্তু কতক্ষণ! ঘরের দরজায় প্রতিনিয়ত কড়া নাড়ছে শত্রু। সত্যিই গোটা পৃথিবী এখন যুদ্ধরত। যেখানে সব মানুষ আপাত অস্ত্রহীন। কিন্তু এক রণকৌশল অনুসরণ করছে। ঘরবন্দি থাকা। আপাতত এই কৌশলের কোনো বিকল্পও নেই।

কিন্তু তারপরও একটা বিষয় পৃথিবীকে হতভম্ব করেছে। এত সতর্কতা সত্ত্বেও এই ভাইরাসটি কী করে এত দ্রুত ছড়াচ্ছে? সম্প্রতি ‘নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিন’-এ যা বলা হয়েছে তাতে আপনি ঘরবন্দি থাকলেও পুরোপুরি নিরাপদ তা ভাবার কোনো কারণ নেই। করোনাভাইরাস এখন শুধু মানুষের মাধ্যমে ছড়াচ্ছে তা নয়। ভাইরাসটি বাতাসেও তিন ঘণ্টার বেশি স্থায়ী। যার অর্থ; বাতাসবাহিত ভাইরাসও এটি। আর প্লাস্টিক কিংবা স্টিলের ওপর তিন থেকে চারদিন বেঁচে থাকে। সুতরাং সতর্কতা, সাবধানতা, সচেতনতা- এই তিনের কোনো বিকল্প নেই নিজেকে খানিকটা নিরাপদ রাখতে।

করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধে জেতার অস্ত্র যখন নেই, তখন অন্তত কৌশলটা সঠিক হতে হবে। সঠিক কৌশল ছাড়া এই যুদ্ধে জেতার আপাতত কোনো উপায় নেই। ঘরবন্দি থেকে, সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলা ছাড়া কী-ই বা করার আছে! সেই কৌশল হিসেবে সরকার সাধারণ ছুটি দিয়েছে। কিন্তু বাঙালির কাছে এই ছুটি যেন ‘করোনা উৎসব’-র ছুটি! রেল-লঞ্চ-বাস টার্মিনালের চেহারা সেই কথাই বলছিল।

কোথায় সচেতনতা, কোথায় সতর্কতা, কোথায় সাবধনতা? সবকিছু হাওয়া! করোনা ছুটির হাওয়া গায়ে লাগাতে সবাই ছুটেছে বাড়ি। এই বাড়ি ফেরার পেছনে অর্থনৈতিক সম্পর্ক একটা জড়িয়ে আছে। দিন আনা দিন খাওয়া মানুষগুলো ঢাকায় বসে খাবেন কী? জনহীন-কর্মহীন ঢাকা। এই ঢাকা তাদের মুখে দু’বেলা আহার তুলে দেয়ার ক্ষমতা রাখে না। নিম্ন আয়ের মানুষ কিংবা আয়হীন মানুষকে দু’বেলা খাবার দেয়ার সার্মথ্য সরকারের থাকলেও সেই সিস্টেম এখনও গড়ে ওঠেনি এই সমাজে। তাই যে যেভাবে পারে, প্রাণ বাঁচাতে ছুঁটেছে বাড়িতে। কিন্তু সেখানে? সেখানে কে খাওয়াবেন? কী খাবেন? এই খাবারের খোঁজে যিনি ছুটে গেছেন গ্রামে, কে জানে তিনিও কি বহন করে নিয়ে গেছেন মারণাস্ত্র করোনা! একজনের কারণে কতজন মরবেন সেটাও বড় এক প্রশ্ন!

খেটে খাওয়া, দিনমজুর মানুষের কথা বাদ দিন। এই যারা ঢাকা বা দেশের বিভিন্ন স্থানে আছেন তারাও কি ঠিকঠাক মেনে চলছেন সরকারি নির্দেশনা বা চিকিৎসকের পরামর্শ? ঘরবন্দিত্বের বিকল্প নেই। সেটা আমরা জানি। তবু বাড়িতে থাকব না! মৃত্যুর কালোছায়া আজ সারা পৃথিবীতে। উন্নত বিশ্বে মৃত্যুর মিছিলে এক দেশ আরেক দেশকে টেক্কা দিচ্ছে। করোনার গর্ভধারণ যে চীনে সেই চীনকে টেক্কা দিয়েছে ইতালি, স্পেন। পিছিয়ে নেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও।

জীবাণুযুদ্ধে ধস নামতে পারে বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। এই দুশ্চিন্তায় ঘুম আসছে না মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল ট্রাম্পের। ঠিক সেই সময় করোনা আক্রান্ত জার্মান চ্যাঞ্জেলর অ্যাঞ্জেলা মরকেল গৃহবন্দি। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনেরও একই অবস্থা। এগার নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে তিনিও আছেন নিজের বাড়িতে। প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে চালাচ্ছেন সরকারি কাজকর্ম। করোনা হানা দিয়েছে ব্রিটিশ রাজ পরিবারেও। কত যুদ্ধে জয়ী ব্রিটেন কত অসহায় অচেনা-অজানা এক শত্রুর সামনে! করোনা কাউকেই করুণা করছে না!

মানুষ মরছে। আবার মানুষকে বাঁচানোর কী আপ্রাণ চেষ্টা চিকিৎসকদের। যারা প্রতিনিয়ত নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ছুটছেন অন্যকে বাঁচাতে। তারাও কেউ অনেকে ফিরছেন স্বজনের কাছে লাশ হয়ে। এটাই আজকের বাস্তবতা। চারপাশ দেখে মনে হচ্ছে যুদ্ধকালীন এক পৃথিবীতে বসবাস আমাদের। যেখানে কেউ মৃত্যুভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছেন। কেই অন্যকে বাঁচাতে ছুটে যাচ্ছেন। কেউ রোজকার রুটি-রুজির সন্ধানে অবিরাম-অক্লান্ত ছুটে চলেছেন।

ক্ষুধা যেখানে তাদের টুটি টিপে ধরছে, সেখানে গৃহবন্দি থাকা, সামাজিক দূরত্ব বাজায়ে রেখে চলা যেন এক চরম বিলাসিতা! কোনো এক অদৃশ্য ভাইরাসে আক্রান্ত ও সংক্রমণের ভয়কে পরোয়া না করে তারা হাঁটছে মৃত্যুর দিকে! আবার বিত্তবানরা পৃথিবীজড়ে মৃত্যুর কালোছায়া দেখেও বাজারে গিয়ে দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের মতো কেনাকাটা করছেন। তারা মৃত্যুর কথা ভাবতে পারছেন না। নিজেদের অমর ভাবছেন!

কতদিন চলবে এই পরিস্থিতি কেউ জানেন না। শুধু জানার আগ্রহ নিয়ে প্রতিদিন চোখ রাখছেন টেলিভিশনের পর্দায়। খবরের কাগজের পাতায়। কিন্তু দেখছেন প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্তে ঊর্ধ্বমুখী হচ্ছে মৃত্যুর গ্রাফ। পৃথিবীজুড়ে এই মৃত্যুর মিছিলে পা ফেলছে বাংলাদেশও। তবে এখনও স্বস্তি- বাংলাদেশ আছে অনেক অ-নে-ক পেছনে। কখনো কখনো পিছিয়ে থাকাও মস্ত বড় এক স্বস্তির ব্যাপার।

তবে অদৃশ্য যুদ্ধ এখনও অসমাপ্ত। মানুষের মনে ভয়। যে ভয় কোনো সাবান বা স্যানিটাইজার দিয়ে ধুয়ে ফেলা সম্ভব নয়।

লেখক: সিনিয়র জার্নালিস্ট ও কলাম লেখক।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here