করোনা নিয়ে কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালে আমাদের পরিবারের অভিজ্ঞতা!

0
5968


লুৎফুন নাহার (মুন্নী):

আমার নারায়নগন্জ নিবাসী বড়ভাবী যাকে আমরা ‘বৌমনি’ বলে ডাকি তিনি গত ১লা এপ্রিল, গায়ে জ্বর জ্বর ও সারা শরীরে ব্যাথা সংক্রান্ত সমস্যা নিয়ে তিনদিন বাড়ীতে অবস্থান করার পর ফোনে ডা: এর পরামর্শ নিয়ে জ্বরের ঔষধসহ এন্টিবায়োটিক খেতে শুরু করেন । ভেবেছিলেন সাধারন জ্বর সেরে যাবে। যখন ৫ দিন পর কাশি শুরু হলো তখন এটা করোনা কিনা তা নিয়ে আমরা তাকে টেষ্ট করাতে বলি। আমার বড় ভাই যাকে আমরা ‘দাদু’ বলে সম্ধোধন করি তিনি আমাদেরকে জানান নারায়নগন্জে করোনা টেষ্ট তখনো শুরু হয়নি ।ইনফরমেশন জানার জন্য করোনা ভাইরাস কন্ট্রোল রুম, নারায়নগন্জ ও ঢাকার হটলাইনে আমার দাদু হাজার চেষ্টা করেও লাইন পাননি। তিনি নিরাশ হয়ে যান যে কোথায় যাবেন টেষ্ট করাতে!এদিকে বন্ধুদের সহযোগিতায় নারায়নগন্জের সিভিল সার্জন স্যারের মোবাইল নাম্বার সংগ্রহ করে কানাডা হতে আমি ফোন করলাম বাট কেউ ফোন রিসিভ করেন নি । পরেরদিন আবারো চেষ্টা করে সিভিল সার্জন স্যারকে পেলাম তিনি জানালেন যে বন্দরে যারা টেষ্ট করাবে তারা যেনো বন্দরে যোগাযোগ করে । আমি নাম্বার জানতে চাইলে তিনি বলেন অনলাইনে সার্চ করতে! তারপর ফোনটা রেখে দিলেন। আমি ভাবলাম উনি কি করে নিশ্চিত হলেন যে সবার অনলাইনে সার্চ করে ফোন নম্বর নিয়ে তারপর যোগাযোগ করার মতো সক্ষমতা বা দক্ষতা রয়েছে? উনার কাছে কি সত্যি কোন নম্বর ছিলো না যেখানে ফোন করলে আমরা ইনফরমেশন পেতে পারি? এদিকে নারায়নগন্জের বিভিন্ন জায়গায় লকডাউনের মহোৎসব চলছে! আমার দাদু ছাড়া আমরা সবাই দেশের বাইরে থাকি তাই দাদুকে কাছে থেকে সাহস দেয়ার সেই সুযোগ আমাদের ছিলো না, দূরে থেকে ফোনে বা ভিডিও কল করে মনের মধ্যে সাহস যোগানোর কাজ করে যাচ্ছিলাম আমরা তিন ভাইবোন ও আম্মা। এরই মধ্যে শুনতে পাই না:গন্জের সিভিল সার্জনসহ করোনা সংক্রান্ত কমিটির আরো তিনজন করোনায় আক্রান্ত ! বন্ধুদের মাধ্যমে জানলাম এখানো না: গন্জে ৩০০ শয্যা হাসপাতালে টেষ্ট শুরু হয়নি ! তো কোথায় যাবো আমরা? নারায়নগন্জের ভয়াবহ পরিস্থিতি দেখে সবাই বললাম যে ঢাকা গিয়ে টেষ্ট করিয়ে কনফার্ম হওয়াটা জরুরী। এদিকে ঢাকা – নারায়নগন্জের সব পরিবহন বন্ধ ! ঢাকায় যাওয়া যাবে না। অনেক কষ্ট করে বৌমনিকে নিয়ে ঢাকায় গিয়ে পুরানো বেতার ভবন করোনা টেষ্ট ইউনিটে খুব সকালে দুজনেরই স্যাম্পল দিয়ে না: গন্জের বাড়িতে আসেন বিকালে জানতে পারেন দুজনেই করোনা পজেটিভ। বাড়ীতে আমাদের ফ্লাটে তিনজনই বসবাস করতেন। গৃহকর্মী আর গৃহ শিক্ষককে ১৫ দিন আগেই ছুটি দিয়ে দেয়া হয়েছিলো। আমরা সবাই এখন আমার ভাইয়ের একমাত্র সন্তানকে নিয়ে চিন্তিত হয়ে যাই কারন তারও পজেটিভ হবার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই সকালে খুব ভোরে দাদু, বৌমনি ও ভাতিজাকে নিয়ে ঢাকায় উওরাস্থিত কুয়েত- বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালে ভর্তি হবার জন্য ১৩ এপ্রিল চলে আসেন । এক ডাক্তার আত্বীয়ের বন্ধু আছেন সেখানে আপাতত সেটাই মাথায় রেখে আড়াই থেকে তিনঘন্টা সময় নিয়ে ভর্তি হয়ে যান! আর আমরা নি:শ্বাস ছেড়ে ভাবলাম বুঝিবা প্রান ফিরে পেলাম! শুরু হলো সরকারী হাসপাতাল নামক প্রতিষ্ঠানটিকে কাছে থেকে দেখার ও জানার এবং ফ্রনটলাইনে থাকা আমাদের বিপদের বন্ধু, যারা জীবন বাজী রেখে সার্ভিস দিচ্ছেন তাদেরকে চেনা জানার অভিজ্ঞতা! হাসপাতালে ভর্তি হয়ে ৫ম তলায় আইসোলেশন ফ্লোরে তিনজনকে রাখা হলো। যথারীতি নোংরা পরিবেশ। যাই হোক এটা আমাদের জীবনের সাথে মিসে গেছে! সয়ে যেতে হবে সারাজীবন প্রতিটি নাগরিককেই ! নিজেদের উদ্যোগে আর ওয়ার্ড বয়দের কিছু বকশিস দিয়ে পরিস্কার করে নি:শ্বাস নেয়ার উপযোগী করা হলো । এরই মধ্যে ফ্লোরে তাদেরকে লক করে দেয়া হলো “ আমার দাদু শুধু আমাদেরকে মেসেজ দিলেন “ They locked the floor”. দাদু, বৌমনি ও ১১ বছরের ভাতিজা ভয় পেয়ে গেলো! তালা বন্ধ করবে কেন????? আমি শুনে সাহস জুগিয়ে বললাম মনে হয় কোনো করোনা রুগী পালিয়ে যেতে পারে তাই হয়তো তালা বন্ধ করে রেখেছে যদিও এটা করার কথা নয়! আপনারা কি বুঝতে পারছেন যে একজন মানুষের শরীরে করোনার জীবানু আছে বলে তাকে তালা দিয়ে আইসোলেশনে রাখতে হবে ? যখন মানুষ বাঁচার আশায় হাসপাতালে ভর্তি হয়, তখন রোগীর মানসিক অবস্থার বেরোমিটার কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়??? পরেরদিন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আমার ভাইয়ের ছেলের শরীরে করোনা ভাইরাস আছে কিনা সেটা পরিক্ষা করানোর জন্য আই ডিসিআর থেকে টেকনিশিয়ান এসে সেম্পল নেন ।আমরা আশায় বুক বেঁধে আছি হয়তো পরেরদিনই রিপোর্ট পাবো কিন্তু বিষয়টা যত সহজ মনে হয়েছিলো বাস্তবে তা নয়। তাই ভয় আর আতংকের মধ্যে আমাদের দিন কাটতে লাগলো কারন আমরা ভেবেছিলাম সে নেগেটিভ হলে বাসায় তাকে আইসোলেশনে রাখা হবে। তাই বাধ্য হয়ে সে হাসপাতালেই বাবা মায়ের সাথে রয়ে গেলো!
হাসপাতালের প্রতিদিনের কঠিনতম অভিজ্ঞতার সাথে পরিচিত হচ্ছিলেন আমার দাদু পরিবার! এদিকে প্রতিদিন করোনা আক্রান্ত/মৃত্যুর পরিসংখ্যান আমাদেরকে প্রতিনিয়ত হিম করে দিচ্ছিলো! বাইরে থেকে যতটুকু পারা যায় খাবার ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র পাঠিয়ে উনাদের শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো ও গরম পানির ভাপ নেয়া, গরগরা করা, চা খাওয়া এসব টোটকা চালিয়ে যাবার প্রানান্ত চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন তারা। দিন গড়াচ্ছে হাসপাতাল থেকে দেয়া ঔষধ খেয়ে যাচ্ছেন আমার দাদু ও বৌমনি । ইতোমধ্যে বৌমনির জ্বর, ডায়রিয়া ও কাশি শুরু হয়ে গেছে। দুইদিন টানা কাশিতে বৌমনির মাথা প্রচন্ড ব্যথা শুরু হয়ে বৌমনি নেতিয়ে পড়েছেন। আমরা সবাই বৌমনির মনোবল বাড়ানোর জন্য বার বার খাওয়া আর গরম পানির গরগরা ভাপ নেয়া অব্যাহত রাখতে বললাম। আমার এক বড়ভাই, শুভাকান্খী উনি ডাক্তার, অনেক ভালো পজিশনে জব করেন তিনি নিয়মিত সেখানে ফোন করে আমাদেরকে রোগীর অবস্থা জানাচ্ছেন, বন্ধু, আত্বীয়স্বজন এতো কঠিন অবস্থার মধ্যেও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র পৌছে দিতে পারছেন বলে আমরা নি:শ্বাস নিতে পারছি । তাদের কাছে আমার কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা নেই!
আমার দাদু অভিজ্ঞতা অর্জন করে যাচ্ছেন কিভাবে হাসপাতালে ভর্তি হবার ১০ম দিনেও একবারের জন্যও বৌমনির ফুসফুস কেমন আছে এত কাশির সময়েও একবারের জন্যও ডা: নার্স এসে স্টেথস্কোপ দিয়ে দেখার প্রয়োজন মনে করেননি! পাশের এক রোগীর শ্বাসকষ্টের সময় প্রায় ১:৩০ ঘন্টা পরে অক্সিজেন সিলিন্ডার ওয়ার্ডবয় নিয়ে এসে ঐ রোগীকে বলেন নিজেই নাকে পাইপ লাগানোর জন্য ! মনে হয় রোগীরা এ বিষয়ে সিদ্ধহস্ত! হাসপাতালে রোগীর কোন হিষ্ট্রির ফাইল বেডে নেই যা দেখে নতুন ডাক্তার এসে রোগীর কন্ডিশন বা উন্নতি বুঝতে পারবেন। প্রতিদিনই নতুন করে রোগের ইতিহাস দিতে হয়।অনেক সময় কোন রুমে কোন রোগী আছেন তারা তাও জানেন না। ৫তলার রোগীর ঔষধ ৪ তলায় অন্য রোগীর কাছে !এক ধরনের অবহেলা আর সমন্বয়হীনতাই চোখে পড়েছে। এদিকে অপরিস্কার বাথরুম। হাসপাতালের ওয়াসরুমের উপর ছাদ থেকে নোংরা পানি লিকেজ হয়ে রোগীর মাথার উপর পড়ছে! ডাক্তার, নার্সগন পি পি ই পড়েও রোগীর সাথে সামাজিক দূরত্বের চাইতেও বেশী দূরত্বে অবস্থান করেনছেন! এ কোথায় আছি আমরা!
এদিকে আমরা প্রতিদিন অপেক্ষা করতে থাকি কবে আমার ভাইয়ের ছেলের করোনা টেষ্ট রিপোর্ট পাবো কারন সে আরো পাঁচজন পজেটিভ রোগীর সাথে আছে। যদি সে নেগেটিভ থাকে তাহলেতো এই সময়ের মধ্যেই পজেটিভ হয়ে যাবে! চিন্তা করা যায়, সেম্পল দেবার পর ৬ষ্ঠ দিন ২০ তারিখে আমরা জানতে পারলাম আল্লাহর অশেষ রহমতে তার করোনা নেগেটিভ এসেছে! কিন্তু এতো বিরম্বনা ও অসহনীয় মানসিক চাপের পর ভালো খবর শুনেও খুশী হতে পারিনি কারন রিপোর্ট পেতেই তো ৬ দিন চলে গেলো!
আই ই ডি সি আরে খোঁজ নিয়ে জানা গেলো তারা বলছেন আমরা রিপোর্ট হাসপাতালে পাঠিয়ে দিয়েছি তাহলে এতো সময় লাগলো কেন একটা রিপোর্ট জানতে? কোথায় রিপোর্টটা আটকে ছিলো?
তার নেগেটিভ রিপোর্ট জানার পরও হাসপাতালের ডাক্তার, নার্স তাদের কাছ থেকে কোন নির্দেশনা পাচ্ছি না।আমার দাদু হাসপাতালের ডাইরেক্টর সাহেবকে ফোন করেছেন তিনি বলেছেন কন্ট্রোল রুমে ফোন করতে যেখানে ফোনের পর ফোন করে একই হাসপাতালে অবস্থান করেও তাদের সাথে কোনো যোগাযোগ করা যাচ্ছে না । এ কেমন ব্যবস্থাপনা? মনে হয় মৃত্যুর কারাগার! অনেকে বলছেন আইসোলেশন নাকি প্রাক-মর্গ!
ডাক্তার সাহেবরা ব্যাস্ত আছেন খুব খারাপ রোগীদের নিয়ে কিন্তু ভেবে দেখছেন না আইসোলেশনের রোগীদেরকে সঠিকভাবে ব্যাবস্থা নিলে হয়তো আই সি ইউর উপর চাপ কমতে পারে। এটা একটা পূর্নান্গ হাসপাতাল শুধু করোনার জন্যই এখন কাজ করছে কিন্তু কেন তারা রিপোর্টের জন্য এত সময় ব্যয় করছেন? গতকাল আবারো স্যাম্পল নিয়ে গেছে মনে হচ্ছে কবে পজেটিভ পাবে তারই অপেক্ষা! আমরা আমার ভাইয়ের ছেলেকে বাসায় আইসোলেশনে রেখে হোম কোয়ারেন্টাইনের ব্যাবস্থা করবো কিন্তু হাসপাতালে আর একদিনও নয়! এখানে বাতাসে বিষ! যা প্রতিটি নিশ্বাসে এই সুস্থ্য অবুঝ শিশুটি গ্রহন করছে প্রতিনিয়ত! হাসপাতালের ডাক্তার, ডাইরেক্টর বা কন্ট্রোল রুমের ব্যবস্থাপকদেকে বলছি আপনাদের ছোট্ট শিশুটিকে কি তার করোনা আছে কিনা জানতে ৯ দিন করোনা রোগীর সাথে রেখে দিবেন???? এ দায়ভার কার ???? হাসপাতালে কাছে থেকে তো জানলাম কেমন বীরের মত লড়ে যাচ্ছেন আপনারা! এ কয়েকদিনে ভূক্তভোগী হয়ে বুঝেছি আপনাদের কাজের সমন্য়হীনতা, নেই রোগীদের মৃত্যুঝুঁকি কমানোর কোন উদ্যোগ, নেই কোনো সঠিক প্রতিরোধ ব্যবস্থাপনা ! নেই টেষ্টের ব্যবস্থা! এখন বুঝতে পারি কেন মানুষ হাসপাতালের ফ্রন্টলাইন যোদ্ধাদের বা ব্যাবস্থাপনা নিয়ে অকপটে অশোভন কথা বলতে দ্বিধা করেনা অথচ আপনাদেরই সহযোদ্ধা অনেকই আছেন যাদের কাজের কথা, সেবার কথা, দায়িত্ববোধের কথা শুনে কৃতজ্ঞতায় চোখে পানি চলে আসে!
জানিনা এ অবহেলা ও অব্যবস্থার কারনে কতজনকে আপনারা মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছেন! দয়া করে সিদ্ধান্ত নিতে আর অপেক্ষা করবেন না ! যে পি পি ই পড়েও আপনি রোগীর সামনে যেতে ভয় পাচ্ছেন আজ সেই পরিবেশেই ১১ দিন ধরে করোনার ভাইরাসের মধ্যে নি:শ্বাস নিচ্ছে একটা ছোট্ট সুস্থ্য শিশু ! একটু ভাবুন!

লেখক: Works at Toronto Employment and Social Services, Client Special Services Unit

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here