স্মৃতির পাতায় চলে গেলো বন্ধু স্বপন

0
1677

শওকত ওসমান রচি:
২০১৪’র মার্চ। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ভারত সফর। কলকাতা থেকে দিল্লীতে গিয়ে পৌঁছলাম। সেদিন ঘুম থেকে উঠতেই স্বপনের ফোন। ফেইসবুক ম্যাসেঞ্জারে ফোন। অজানা শংকায় কল রিসিভ করলাম। বেশ উত্তেজিত। জানতে চাইলাম কি হয়েছে। সে বললো প্রধানমন্ত্রীর সাথে এটাচ ফটোগ্রাফার ছাড়া নাকি অন্য কোন ফটো সাংবাদিক জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশন কভার করতে পারেনা। আমি জানালাম কেন পারবেনা। সে বললো, দোস্ত তুমি আমার আমেরিকা যাওয়ার ব্যবস্থা করো। আমি বিষয়টাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছি। আমি তাকে শান্তনা দিয়ে বললাম, ওকে আমি দেশে ফিরি। তারপর। আর সেই অধিবেশনতো সেপ্টেম্বরে। সময় আছে। এরপর সে প্রতিদিনই সকাল-বিকেল ফোন দিতে থাকলো বিষয়টা নিয়ে। জাতীয় প্রেসক্লাবে ফটোসাংবাদিকদের আড্ডায় এ নিয়ে কারো সাথে মনে হয় তার বাহাস হয়েছে। মার্চের শেষ সপ্তাহে দেশে ফিরলাম। সে আমাকে ফোনে অস্থির করে ফেললো। প্রেসক্লাবে দেখা। তারপর গেস্টরুমে বসে আড্ডা। জানালো তার বড় ভাই মতিন নিউইয়র্ক থাকেন। যেতে পারলে থাকার কোন সমস্যা নেই। আমি এর আগে ২০১২ তে প্রথম জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশন কভার করতে প্রথম আমেরিকায় যাই। এরপর ২০১৩ তে ভিসা নেই। একারনে স্বপন বন্ধুর উপর বেশ আত্মনির্ভরশীল।



এ হাই স্বপনের সাথে আমার প্রথম পরিচয় ধানমন্ডি গভ: বয়েজ হাই স্কুলে। তখন ৬ষ্ঠ শ্রেনীর ছাত্র। দু’জনের দু’সেকশন। তবে আমরা খেলাধুলা করতাম একসাথে। স্কুল জীবন পেরিয়ে আমরা ঢাকা কলেজে। এরপর সে মস্কোতে পড়ালেখা করতে চলে যায়। এরপর বড় গেপ। ১৯৯৪ তে বাংলাবাজার পত্রিকায় কাজ করতে গিয়ে আবারো স্বপনের সাথে দেখা। আমি রিপোটিংয়ে, সে ফটো সাংবাদিকতায়। তারপর কাজ করতে গিয়ে তার সাথে অনেক স্মৃতি। একটা স্মৃতির বিষয় না বলেই পারবোনা। ’৯৬ এর নির্বাচনের আগে সারাদেশে চরম আন্দোলন, জ্বালাও-পোড়াও। আমার বাসা যেহেতু মিরপুর সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী আমাকে মিরপুর এলাকাতেই বেশিরভাগ সময় হরতাল ডিউটি দিতেন। এছাড়া স্থানীয় আওয়ামীলীগ-বিএনপি নেতা-কর্মীরাও আমাকে বেশ চিনতো। মিরপুরে বেশ ক’দিন ধরে দু’দলে সংঘর্ষ চরম পর্যায়ে পৌঁছেসে। একদিন ওপেন আর্মস নিয়ে সংঘর্ষ। চারিদিকে বোমার শব্দে প্রকম্পিত। আমার সাথে সবসময় স্বপনেরও ডিউটি। মিরপুর এক নম্বর সেকশন বাসস্ট্যান্ড এলাকায় গোলাগুলি। এরআগে বেশ কয়েকটি গাড়িতে আগুন। বর্তমানে প্রিন্স বেকারী’র সামনে মেইন রাস্তায় স্বপনের মটরসাইকেল। গোলাগুলির কারনে অন্যান্য ফটো সাংবাদিকদের সাথে স্বপনও একটি ভবনে আশ্রয় নিয়েছে। আমি ছিলাম পাশের একটি ভবনে। হঠাৎ দেখি দু’টো ছেলে এগিয়ে যাচ্ছে স্বপনের ইয়ামাহা মটর সাইকেলের দিকে। একজনের হাতে দলা করা কাগজে আগুন। আমি ওদের পরিকল্পণা বুঝে ফেললাম। দৌঁড়ে বের হয়ে ওই দু’জনকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে মটর সাইকেলে বসে পড়লাম। একজন আমাকে চিনতো। দেখি মটরসাইকেলের ঘাড় তালা দেয়া নাই। ঠেলে সনি সিনেমা হলের দিকে দ্রুত হাটতে লাগলাম। আশপাশ দিয়ে রাস্তার ওপর দিয়ে গুলি যা”েছ। গুলি যে আমার গয়ে লাগতে পারে তখন সে চিন্তাই ছিলনা। চিন্তা একটাই, আমার এলাকায় আসছে স্বপন। ওর মটরসাইকেলের যাতে কোন ক্ষতি না হয়। যাক জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সে যাত্রায় মটরসাইকেলটা রক্ষা করতে পেরেছিলাম।


আমেরিকা যেতে হলেতো অনলাইনে লম্বা একটা ভিসা ফরম ফিলাপ করতে হয়। ২০১৪ সালের আগস্টের দ্বিতীয় সপ্তাহে স্বপনকে বললাম ফরম ফিলাপ করতে। সে জানালো পারবেনা। কি আর করার। একদিন সারারাত সে ফোনে থাকলো। আমি তার ফরম ফিলাপ করলাম। অফিসের চিঠি লাগবে। আমি চিঠি ড্রাফট করে তাকে মেইলে পাঠালাম। জানালাম বিশেষ পরিমাপের ছবি তুলতে হবে। সব ঠিকঠাক করে আমার আর স্বপনের ফাইল নিয়ে ইউএস এ্যম্বেসির মেরিনা আপার কাছে জমা দিয়ে আসলাম। প্রেস উইং থেকে সাংবাদিকদের আবেদন ফরোয়ার্ড করা হতো তখন ভিসা সেকশনে। দু’জনের ইন্টারভিউ শেষে ভিসা পেলাম। কি খুশী স্বপন। আনন্দে আত্মহারা স্বপন পাসপোর্ট হাতে নিয়েই আমেরিকা প্রবাসী বড় ভাই মতিন ভাইয়ের কাছে ফোন করলো। মতিন ভাই আমাকে স্পেশাল থ্যাংস জানালেন। তারপর একই ফ্লাইটে দু’জনের যাত্রা। নিউইয়র্ক জেএফকেতে নামার পর মতিন ভাই-ভাবী আমাদের ফুলেল শুভে”ছা জানালেন। জাতিসংঘের অধিবেশন শেষে আমি স্বপনকে নিয়ে প্রতিদিন ঘুরেছি। চেনা জায়গা ছাড়াও অচেনা অনেক জায়গায় ঘুরেছি দু’জন। একমাস পর আমি দেশে ফিরে গেলাম। স্বপন আরো কিছুদিন থেকে তারপর ফিরলো।


২০১৫’র শুরুতে দেশে সরকার বিরোধি ব্যাপক আন্দোলন। প্রায় প্রতিদিনই অবোরোধ-হরতাল। সচিবালয়ে ডিউটি। ঝুঁকি নিয়ে পত্রিকা আর বাসায় আসা যাওয়া। নানান টেনশন। বুকে ব্যাথা অনুভব করলাম। শাহবাগে ডায়েবেটিকস হাসপাতাল , সোরওয়ার্দী ও মিরপুরে হার্ট সেন্টারে পরীক্ষা করালাম। সব জায়গায় একই কথা। ওপেন হার্ট সার্জারী করতে হবে। আমি এটাকে বেশ ভয় পাই। অনলাইন ঘাটলাম। দেখলাম আমেরিকায় এ ব্যাপারে বিশেষ একটা চিকিৎসা আছে। ‘কেথারাইজেশন’ এর মাধ্যমে হার্টের সাথে থাকা আমার তিনটা ব্লক অপসারণ করা সম্ভব। অফিসের কর্মকর্তারা সায় দিলেন। ভিসা ছিল। অফিস থেকে বলা হলো চিকিৎসার ফাকে আপনি বিভিন্ন বিষয়ের ওপর রিপোর্ট পাঠাবেন। সিদ্ধান্ত নিলাম নিউইয়র্ক আসার। স্বপন শুনে বলে আমিও যাবো। বললো, তুমি চিকিৎসা নাও, আর আমারতো ভাইয়ের বাসা আছেই। ভাবলাম ১৮ ঘন্টার জার্নি। সাথে স্বপন থাকলে আর ‘বোর ফিল’ করবোনা। আমরা আবার একসাথে নিউইয়র্ক আসলাম। এখানে চিকিৎসা ব্যয় অনেক। তাই আবেদন করার পরপরই ‘আই’ ভিসার সুবাদে একটি হেলথ ইন্স্যুরেন্স কার্ড পেয়ে গেলাম। সে সাথে সোস্যাল সিকিউরিটি ও স্টেট আইডি কার্ড। স্বপনের জন্যও একসাথে প্রসেস করলাম। আমি জ্যামাইকার এক বাংলাদেশী ডাক্তারের কাছ থেকে প্রাথমিক চিকিৎসা নিচ্ছিলাম। একদিন মতিন ভাইয়ের ফোন। স্বপনতো কুইন্স হসপিটালে ভর্তি। আমি তো ‘থ’ মেরে গেছি। ছুটলাম কুইন্স হসপিটালে। বুকে ব্যাথা নিয়ে স্বপন ভর্তি। জানলাম তার কখনো হার্টের সমস্যা ছিলনা। ছিল ডায়েবেটিকস। আমি আসছি চিকিৎসার জন্য। আর স্বপন বেড়াতে। এটা কি হলো। ওই হাসপাতাল থেকে ট্রান্সফার এলমাহার্স হসপিটালে। আমি আমার চিকিৎসা ফেলে স্বপনের কাছেই পড়ে থাকলাম। ডাক্তাররা জানালো এখানেও হবেনা। বেলভিউতে ওপেন হার্ট সার্জারি করতে হবে। ছোটবেলা থেকেই তার হার্টে সমস্যা। তাকে নিয়ে এ্যাম্বুলেন্সে উঠলাম। হাসপাতাল থেকে বের হওয়ার সময় অঝোরে কাঁদছিল স্বপন। আমি টিস্যু দিয়ে মুসছিলাম তার ভেজা চোখ। ভেলভিউতে ভর্তির দু’দিন পর ওপেন হার্ট সার্জারি হলো। এখানে মতিন ভাই-ভাবী থাকলেও সবাই এখানে কর্মব্যস্ত। প্লান হলো স্বপনের স্ত্রী-বা”চার জন্য ভিসার আবেদন। আই ভিসায় স্ত্রী আসতে পারলেও বা”চারা পায়নি।



তিনদিন পর স্বপন মতিন ভাইয়ের বাসায় ফিরলো। পরের সপ্তাহে আমার বুকে ব্যাথা। থাকতাম সম্বন্ধি দিপু’র বাসায়। এ্যাম্বুলেন্সে কুইন্স হসপিটাল। সেখানে দু’দিন রেখে নানা পরীক্ষা শেষে এলমাহার্স হসপিটালে। সেখানে আমার অপারেশন হয়। তিনটা ব্লক টেনে পরিস্কার করা হয়।
তারপর বেশ সু¯’ হয়ে উঠেছিল স্বপন। তবে খাদ্যাভাস পরিবর্তন না করার কারনে গত একবছরে অন্ত:ত ১০ বার তাকে হাসপাতালে যেতে হয়। এরই মধ্যে আবার তার বুকে রিং পরানো হয়েছে। ধীরে ধীরে দু’টো কিডনী অচল হয়ে পড়ে। আমরা তার বন্ধু ও সাংবাদিক সহযোগিরা সিদ্ধান্ত নেই, তাকে বাঁচাতে ভারতে পাঠাতে হবে। অন্তত: একটি কিডনি প্রতিস্থাপন করতে হবে। স্থানীয় সাংবাদিক সমাজের উদ্যোগে সম্প্রতি স্বপনের জন্য একটি ফান্ড রাইজিং অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এতে প্রখ্যাত শিল্পী বেবি নাজনীন সহ প্রবাসের খ্যতনামা শিল্পীরা সংগীত পরিবেশন করেন। পরিকল্পণা ছিল স্বপনকে মার্চের ২৭ তারিখ দেশে পাঠানো হবে। সেখান থেকে যাবে ভারতে। মতিন ভাইও বিমানের টিকেট বুকিং দিয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু হঠাৎ করে করোনা এসে তছনছ করে দিল সে পরিকল্পণা, তছনছ করে দিল স্বপনের স্বপ্নের সংসার।
স্বপনকে নিয়মিত সপ্তাহে তিনদিন ডায়লোসিস করতে হতো। তিনদিন আগের কথা। বাসার কাছেই ডায়লোসিস সেন্টারে স্বপন যেতেই প্রথমে তার জ্বর মাপা হলো। ১০১ ডিগ্রী জ্বর। করোনার প্রভাব বাড়ার পর থেকেই সেন্টারে প্রবেশের আগেই সব রোগীর জ্বর পরিমাপ করার বিধান চালু করা হয়। এরপর সেন্টারের পক্ষ থেকে বলা হয় তার করোনা টেস্টের জন্য কুইন্স হসপিটালে পাঠানো হবে। শুনে স্বপন অস্থির হয়ে উঠে। সেন্টারের কর্মকর্তাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে বৃষ্টিতে ভিজে চলে যায় বাসায়। মতিন ভাইকে জানায় আমার করোনা হয়নি, অথচ তারা হাসপাতালে পাঠাতে চায় পরীক্ষার জন্য। আর এ হাসপাতালে করোনার চিকিৎসা নিতে যাওয়া বেশিরভাগ বাংলাদেশী ফেরত আসেনি। তার এ ভয় পাওয়ার মধ্যেই ডায়লোসিস সেন্টার থেকে ফোন আসে। মতিন ভাইকে বলা হয়, আপনার ভাই পালিয়ে গেছে। আমরা আর চিকিৎসা দিতে পারবোনা। মতিন ভাই এ্যম্বুলেন্স কল করেন। এ্যম্বুলেন্স এর কর্মীরা তাকে নিয়ে যেতে ব্যর্থ হন। পরের দিন স্বপনের দু’পা ফুলে যায় ডায়লোসিস না করার কারনে। এ পরিস্থিতিতে সে করোনা পরীক্ষা করতে সম্মতি জানায়। কুইন্স হসপিটালে পাঠানো হয়। সেখানে পরীক্ষা করে তার শরীরে করোনার উপস্থিতি মিলে। এরপর জরুরি বিভাগ থেকে ওয়ার্ডে। গত পরশুদিন হাসপাতালের ডাক্তার জানায় হার্টবিট পাওয়া যাচ্ছেনা, কৃত্রিম উপায়ে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে। ৩০ মার্চ দুপুর ১২:৫০ মিনিট। হাসপাতাল থেকে কল আসার পর মতিন ভাই ‘হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে ডাক্তার বললেন, ‘নো মোর স্বপন’। এভাবেই স্বপনের জীবন প্রদীপ নিভে গেল।
স্ত্রী আর এক ছেলে, এক মেয়ে স্বপনের দেশে ফেরা নিয়ে অপেক্ষায় ছিলেন। এখন এমন এক পরিস্থিতিতে করোনা আক্রান্ত রোগী বা মৃতদেহের কাছে কোন সু¯’্যলোক যেতে পারেননা। তার লাশও বাংলাদেশে পাঠানো যাবেনা। এমনকি আমরা যারা এখানে আছি আমরাও স্বপনের মুখ দেখতে পাবোনা। বিশেষ ব্যব¯’ায় কবর দেয়া হবে। সেখানে ৮ থেকে ১০ জনের বেশি লোক এলাউ করবে না।
নিউইয়র্কের পাশের স্টেট নিউজার্সিতে সংরক্ষিত বাংলাদেশ সোসাইটির কবরস্থানে তাকে আগামীকাল দাফন করা হবে। স্ত্রী, পুত্র বা কন্যা কখনো সুযোগ পেলে তাদের প্রিয়জনের কবরে এসে জিয়ারত করতে পারবে। এভাবেই স্মৃতির পাতায় চলে গেল বন্ধু স্বপন। নিউইয়র্ক, ৩১ মার্চ ২০২০

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here