করোনায় অমানবিকতা ও ব্যর্থতা

0
47

সায়ন্থ সাখাওয়াৎ

ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছি, বিপদে বন্ধু চেনা যায়। আর এখন দেখছি, করোনায় অমানুষ চেনা যায়। এক ভাইরাস পুরো বিশ্বকে উলঙ্গ করে দিল। কত মানুষের মুখোশ খুলে দিল। দায়িত্বশীলদের দায়িত্বহীন ভূমিকা আর কিছু মানুষের অমানবিক আচরণে বিস্মিত না হয়ে থাকা কঠিন। বিশেষ করে বাংলাদেশে করোনা প্রতিরোধে নেওয়া সরকারের পদক্ষেপ, ব্যবসায়ীদের আচরণ ও কিছু মানুষের অমানবিকতায় অনেককেই আহত করেছে।

করোনাভাইরাস একটি বৈশ্বিক সমস্যা। সারা পৃথিবী আক্রান্ত। ওয়ার্ল্ডওমিটারের দেওয়া হিসাবে গতকালই (০১ এপ্রিল) সারা বিশ্বে প্রায় নয় লাখ মানুষ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। আর এতে মারা গেছেন প্রায় সাড়ে বেয়াল্লিশ হাজার। সংক্রমিত হলেও সুস্থ হয়ে উঠেছেন প্রায় পৌনে দুই লাখ। বাকি ইনফেকটেড প্রায় সাড়ে ছয় লাখের মধ্যে পাঁচ শতাংশ, মানে আরও প্রায় ৩ হাজার ৩০০ জন মানুষ খুবই সিরিয়াস অবস্থায় আছেন। প্রতিদিন হুহু করে বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা। বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যাও। এর শেষ কোথায় কেউ জানে না। এ যুদ্ধে প্রায় বিপর্যস্ত বিশ্বের অনেকগুলো শক্তিধর রাষ্ট্র। ইতালি, স্পেন, চায়না, ইরান, আমেরিকা, ব্রিটেন, জার্মানি, ফ্রান্সসহ বহু দেশে চলছে মৃত্যুর মিছিল। এ ক্ষেত্রে এখনো অনেকটা স্বস্তিতে আছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো। ইউরোপ-আমেরিকার মতো এই অঞ্চলে মৃত্যুর সংখ্যাটা এখনো ঝাঁকি দেয়নি। অন্যান্য দেশের অবস্থা দেখে আগেভাগেই ব্যাপক সতর্কতা নিয়েছে অনেক দেশ। এখন পর্যন্ত সেই সতর্কতার সুফলও তারা পাচ্ছে। আবার শুরুতে সিরিয়াস না হয়ে শিথিলতা দেখানো রাষ্ট্রগুলো তার খেসারতও দিচ্ছে। যার অন্যতম হলো ইতালি।

যেসব রাষ্ট্রকে আমরা আদর্শ বলে জেনে আসছি, সেখানেও করোনা ক্রাইসিসে প্রয়োজনীয় দ্রব্যের অভাব ও মূল্যবৃদ্ধির ঘটনা হতবাক করেছে। আর বাংলাদেশে তা বরাবরের মতোই লাগামহীন। করোনার আঘাতে লণ্ডভ- পুরো বিশ্ব। সব থমকে গেছে। এই ভাইরাস কাকে নিয়ে যাবে আর কাকে রেখে যাবে, তা আমরা কেউ জানি না। তবু কিছু মানুষের বোধোদয় নেই। যে দ্রব্যটি করোনা ক্রাইসিস শুরুর আগেই উৎপাদিত, হঠাৎ করেই তার মূল্য কোন বিচারে বাড়তে পারে? তাও বহু গুণ! যারা এভাবে মূল্য বাড়িয়ে দিয়ে অধিক মুনাফার লোভের সিঁড়িতে পা রাখলেন, তাদের মনে একবারও ভয় এলো না! একবারও মনে হলো না যে এই ভাইরাস আমাকেও তো নিয়ে যেতে পারে! তখন কে খাবে এই অধিক মুনাফার অর্থ?

করোনাভাইরাসের বিষয়ে আমরা এখনো যতটা জানি, তা কতটুকু সঠিক এবং তার বাইরে কতটা অজানা রয়ে গেছে, সে সন্দেহ সারা বিশ্বেই প্রবল। সে কারণেই এ ভাইরাসটি নিয়ে আতঙ্ক মাত্রাহীন। সে আতঙ্কই আমাদের ক্ষেত্রবিশেষে অমানবিক করে তুলেছে। আমরা কতটা অমানবিকতা দেখিয়েছি, তা বুঝতে সাহায্য করবে এই সংবাদ শিরোনামগুলো। দেশের প্রথম সারির সংবাদমাধ্যমগুলোতে গত কয়েক দিনে ছাপা হওয়া নিউজ হেডলাইনের কয়েকটি ছিল ‘তীব্র জ্বরে আক্রান্ত তরুণের মৃত্যু’, ‘শিবগঞ্জে সেই ব্যক্তির লাশ দাফনেও বাধা!’, ‘করোনা সন্দেহে ফেলে গেল বাসস্ট্যান্ডে’, ‘দেখেও কাছে ঘেঁষলেন না কেউ’, ‘করোনা সন্দেহে চিকিৎসা দেয়নি পাঁচ হাসপাতাল’, ‘ধুঁকে ধুঁকে যুবকের মৃত্যু’, ‘অ্যাম্বুলেন্সে ১৬ ঘণ্টায় ৬ হাসপাতালে ছোটাছুটি, অতঃপর বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু, ‘করোনার আতঙ্ক আকুতি পেছনে ফেলে মারা গেলেন মানুষটি’, ‘প্রবাসী সন্দেহে বৃদ্ধকে গ্রামবাসীর গণধোলাই’, ‘করোনার লক্ষণ, তাই এমন দাফন’, ‘এক ঘণ্টায় মেলেনি অক্সিজেন, শ্বাসকষ্টে মারা গেলেন স্কুলশিক্ষিকা’।

এমন অনেক সংবাদই মানুষকে ব্যথিত করেছে। একজন জ্বরে আক্রান্ত মানুষ। তার শ্বাসকষ্ট আছে। এটার মানেই যে তিনি করোনায় আক্রান্ত এমন তো নয়। হলেনইবা করোনায় আক্রান্ত। তাই বলে তার বিপদে আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী কেউ এগিয়ে যাবেন না! চিকিৎসক তার চিকিৎসা দিতে অস্বীকৃতি জানাবেন? ভেবে দেখুন তো? যে মানুষটি রাতভর জ্বরে কাতরাচ্ছেন, তার স্ত্রী আর শিশুসন্তান জেগে আছেন। স্ত্রী অ্যাম্বুলেন্সের জন্য বিভিন্ন জায়গায় ফোন দিয়ে সাড়া পাচ্ছেন না। হাসপাতালে নেওয়ার জন্য পাড়া-প্রতিবেশী ও পরিচিতজনদের সহযোগিতা চেয়ে পাচ্ছেন না। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, থানার পুলিশ, ফায়ার সার্ভিসে ফোন দিয়েও কোনো সাড়া না পেয়ে আইইডিসিআরের হটলাইনে ফোন দেন। কিন্তু লাইন পান না। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারেন, এমন আতঙ্কে কেউ আকুতিতে সাড়া দেননি। তারপর তিনি ব্যক্তি মারা গেলেন। মৃত্যুর পরও রেহাই নেই। তার মরদেহ কবর দিতেও বাধা দেয় এলাকার মানুষ! এরা সত্যি মানুষ তো! কেউ ভাবল না, আজ এই লোকটি যে বিপদে পড়েছে, কাল যদি সেও পড়ে এ রকম অবস্থায়! তার স্ত্রী-সন্তান রাতভর এভাবে ডেকে যদি কাউকে না পান! তারও তো এমন মৃত্যু হতে পারে। তার মৃত্যুর পরও যদি তারই স্বজনরা এভাবে বলে যে তাকে কবর দেওয়া যাবে না। তখন কেমন লাগবে তার স্ত্রী-সন্তানদের? এ রোগ তো যে কারও হতে পারে। করোনা কী আর বেছে ধরে! তবু কেউ কারও হয় না কেন এই মহামারীর দিনে? কিন্তু কথা হলো, কেন এই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল? এর দায় কী শুধু ওই অমানবিক আচরণ করা মানুষগুলোরই?

এ পর্যন্ত ইতালিতেই করোনার রোগীদের চিকিৎসা দিতে গিয়ে সর্বোচ্চসংখ্যক চিকিৎসক মারা গেছেন। এ সংখ্যা ইতিমধ্যে অর্ধশতাধিক। অন্যান্য দেশেও মারা গেছেন চিকিৎসাকাজে নিয়োজিত বহু মানুষ। সেই সংবাদ এ দেশের চিকিৎসাকাজে নিয়োজিতদের ভীত করেছে। সে ভয়কে জয় করে মানবতার কাজে এগিয়ে এসেছেন অনেক চিকিৎসক-নার্স। কিন্তু সবাই তা পারেননি। কারণ তারা তাদের নিজেদের রক্ষার জন্য ন্যূনতম সুরক্ষা পোশাকটিও (পারসোনাল প্রটেকটিভ ইকুইপমেন্ট-পিপিই) পাননি। তিন মাস সময় পাওয়ার পরও সরকার না পেরেছে বিদেশফেরতদের সঠিকভাবে কোয়ারেন্টাইনে রাখতে। না পেরেছে চিকিৎসা সেবাদানকারীদের জন্য পিপিই সরবরাহ করতে। ফলে ক্ষুব্ধ ও আতঙ্কিত হয়েছেন চিকিৎসকরা। সে আতঙ্ক বিস্তৃত হয়েছে সাধারণ মানুষের মধ্যেও। তারা ভেবেছে, চিকিৎসকরা পর্যন্ত মারা যাচ্ছেন, সেখানে আমরা বাঁচব কী করে! এই ভয়ে তারা জড়সড়।

করোনা নিয়ে সরকারের শিথিল ভূমিকা, অব্যবস্থাপনা ও লুকোচুরি মানুষের মধ্যে এক ধরনের আস্থার সংকট তৈরি করেছে। সংবাদমাধ্যমে খবর আসছে, বিভিন্ন স্থানে করোনার উপসর্গ নিয়ে ১০ জনের মৃত্যু… করোনার সন্দেহ : শ্বাসকষ্ট, সর্দি, কাশিসহ নানা উপসর্গ নিয়ে বিভিন্ন স্থানে ১৩ জনের মৃত্যু। করোনা সন্দেহে নমুনা সংগ্রহ করে আইইডিসিআরে পাঠানো কয়েকজনের বাড়ি লকডাউন, করোনা সন্দেহে মৃতব্যক্তির লাশ দাফন, চিকিৎসকসহ ১১ জন কোয়ারেন্টাইনে, নালিতাবাড়ীতে করোনার উপসর্গ নিয়ে এক ব্যক্তির মৃত, শ্রীমঙ্গলে জ্বর, শ্বাসকষ্ট ও গলাব্যথা নিয়ে একজনের মৃত্যু, বরিশালে সাড়ে সাত ঘণ্টার ব্যবধানে করোনা ইউনিটে দুজনের মৃত্যু, করোনা ইউনিটে মারা যাওয়ায় আতঙ্ক, ২৮ বাড়ি কোয়ারেন্টাইন এমন বহু সংবাদ। আর সরকারের বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংস্থা বলছে, দেশে করোনায় আক্রান্ত মাত্র ৫৪, মৃত ৬! এটাও মানুষ বিশ্বাস করছে না। মানুষ মনে করে সরকার ‘নো টেস্ট, নো করোনা’ পলিসিতে আছে। এর ফলে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে ব্যবস্থা না নেওয়ায় ভয়াবহ এক পরিস্থিতির মুখে পড়তে পারে বাংলাদেশ। নিজ দেশে ভয়াবহ অবস্থা চলতে থাকার পরও বাংলাদেশ থেকে এক দিনে ৪২৩ জন আমেরিকানসহ বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের চলে যাওয়া অনেকের মধ্যেই এক অজানা আতঙ্ক সৃষ্টি করে। অনেকেই প্রশ্ন করেন, তবে কি আমাদের অবস্থা তাদের চেয়েও খারাপ হতে পারে?

বাংলাদেশে সরকারের সরবরাহ করা তথ্য যদি সত্য হয়ও, তাতেও নিশ্চিন্ত বোধ করার কোনো সুযোগ নেই। বিশ্ব পরিসংখ্যান বলে দেয়, এই ভাইরাসের আক্রমণ শুরুতে ধীরে হলেও একসময় তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে, করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা এক থেকে এক লাখে পৌঁছাতে ৬৭ দিন সময় লেগেছে। দ্বিতীয় এক লাখ আক্রান্ত হতে সময় লেগেছে ১১ দিন। কিন্তু তৃতীয় এক লাখ আক্রান্ত হতে সময় লেগেছে মাত্র চার দিন। আমেরিকা, ইতালি, স্পেন, ফ্রান্স, ইরান, যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশের পরিসংখ্যান বিশ্লেলষণেও দেখা যায়, প্রথম শনাক্ত থেকে প্রথম মৃত্যু হতে বেশ কিছুদিন সময় লেগেছে। আবার সে মৃত্যুর সংখ্যা তিন অঙ্কে আসতেও কয়েক সপ্তাহ লেগেছে। কিন্তু এরপর আক্রান্তের সংখ্যা ও মৃতের সংখ্যা বাড়ছে খুব দ্রুত।

তাই আমাদের জন্যও আগামী দুই থেকে তিন সপ্তাহ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সরকার কী বলল না বলল, তাদের পরিসংখ্যানে শূন্য, শূন্য, এক, দুই স্কোর দেখালেও সেটা দেখে নিশ্চিন্ত বোধ করার কোনো সুযোগ নেই। এই ভাইরাসের গতিরোধ করার একটাই পথ। তা হলো পুরো সমাজে ‘শারীরিক দূরত্ব’ মেনে চলা আর সতর্কতার সঙ্গে করোনাভাইরাস প্রতিরোধের যে নিয়মগুলো প্রতিদিন সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত হচ্ছে, তা মেনে চলা। আর সরকারের উচিত লকডাউন প্রক্রিয়া আরও অন্তত দুই সপ্তাহের জন্য বাড়িয়ে পরিস্থিতি বুঝে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করা। সেই সঙ্গে মানুষকে সঠিক তথ্য সরবরাহ করা, মানুষের মনে আস্থা ফিরিয়ে আনা ও দরিদ্র মানুষের খাদ্যদ্রব্য সরবরাহ নিশ্চিত করা।

আর আমরা সবাই যেন মানবিক হই। ভয় দিয়ে নয়, সতর্কতা ও মানবিকতা দিয়ে যেন জয় করি এই মহাদুর্যোগকে।

লেখক

চিকিৎসক ও কলামনিস্ট

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here