তহবিলের ৩০ হাজার কোটি টাকা যেভাবে বিতরণ হবে

0
72

বাংলা খবর ডেস্ক: করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে দেখা দেওয়া সংকট থেকে দেশের শিল্প উদ্যোক্তাদের রক্ষা করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৩০ হাজার কোটি টাকার তহবিল গঠনের ঘোষণা বাস্তবায়নে সক্রিয় হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

রবিবার (১২ এপ্রিল) বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে এই তহবিল গঠন করার নির্দেশনা দিয়ে একটি সার্কুলার জারি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। দেশের সব বাণিজ্যিক ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীর কাছে পাঠানো এই সার্কুলারে বলা হয়েছে, ব্যাংক ও গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে এই প্যাকেজ থেকে ঋণ দিতে পারবে ব্যাংক।

প্রসঙ্গত, করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে বাংলাদেশে সম্ভাব্য অর্থনৈতিক প্রভাব মোকাবিলায় গত ৫ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী ক্ষতিগ্রস্ত শিল্প ও সার্ভিস সেক্টরের প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল হিসেবে ৩০ হাজার কোটি টাকার আর্থিক সহায়তা ঘোষণা করেন। এতে বর্তমানে চলমান সুদ বা মুনাফার হার ৯ শতাংশের বিপরীতে সরকার ৪.৫০ সুদ ভর্তুকি হিসেবে দেবে।

বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, প্যাকেজের সুবিধা দেওয়ার আগে ব্যাংকের নিজস্ব ঋণ নীতিমালা অনুযায়ী ঋণ মঞ্জুরি অনুমোদিত হতে হবে। তবে প্রতিটি ঋণ বিতরণের আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগ হতে সম্মতিপত্র গ্রহণ করতে হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, ব্যাংকিং সেক্টর কর্তৃক শিল্প ও সার্ভিস সেক্টরে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল হিসেবে প্রদত্ত ঋণের বিপরীতে গত ৩১ ডিসেম্বর স্থিতির মধ্যে স্ব স্ব ব্যাংকের অবদান এবং সম্ভাব্য ঋণের চাহিদার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে প্রতিটি ব্যাংক এই প্যাকেজের আওতায় ঋণের নিজস্ব চাহিদা নির্ধারণ করবে। যা এ প্যাকেজের আওতায় সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের ঋণ/বিনিয়োগের প্রাথমিক সীমা হিসেবে বিবেচিত হবে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রয়োজনে ঋণ বিতরণের সীমা বৃদ্ধি বা হ্রাস করতে পারবে।

সার্কুলারে বলা হয়েছে, এ প্যাকেজের আওতায় ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে ৩১ ডিসেম্বর তারিখের স্থিতিভিত্তিক শিল্প ও সার্ভিস সেক্টরের বিভিন্ন সাব-সেক্টরে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল হিসেবে প্রদত্ত ঋণের স্থিতির আনুপাতিক হারের সঙ্গে সামঞ্জস্যতা রক্ষা করতে হবে। এ প্যাকেজের মেয়াদ হবে ৩ বছর। তবে, এ প্যাকেজের আওতায় কোনও একক গ্রাহকের অনুকূলে প্রদত্ত ঋণের জন্য সর্বোচ্চ এক বছর মেয়াদে সরকার থেকে ভর্তুকি পাওয়া যাবে।

ঋণ পাওয়ার যোগ্যতা

যেসব শিল্প ও সার্ভিস সেক্টরের প্রতিষ্ঠান করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শুধুমাত্র সেসব প্রতিষ্ঠান এ সুবিধার আওতাভুক্ত হবে। এর জন্য কয়েকটি শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, ঋণ খেলাপিরা এ প্যাকেজের আওতায় ঋণ পাবে না। এছাড়া কোনও ঋণগ্রহীতা প্রতিষ্ঠানের কোনও ঋণ মন্দ বা ক্ষতিজনক মানে শ্রেণিকৃত হওয়ার পর এর আগে তিনবারের বেশি পুনঃতফসিলকৃত হলে তারাও এই প্যাকেজ থেকে ঋণ পাবে না।

নতুনদের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, নতুনভাবে ঋণ গ্রহণে ইচ্ছুক আবেদনকারী (যারা এ যাবত নিজস্ব পুঁজির মাধ্যমে ব্যবসা পরিচালনা করে আসছেন কিন্তু করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় ব্যাংক ঋণের ওপর নির্ভরশীল হতে হচ্ছে) এবং বিদ্যমান ঋণ গ্রহীতা-উভয়ের ক্ষেত্রেই গাইডলাইন অব ইন্টারন্যাশনাল ক্রেডিট রিস্ক রেটিং সিস্টেম ফর ব্যাংক (আইসিআরআরএস) অনুযায়ী সর্বশেষ সমাপ্ত হিসাব বছরের নিরীক্ষিত আর্থিক বিবরণীর (কিংবা ঋণ গ্রহণের আবেদনের সময় সর্বশেষ হিসাব বছর শেষ হওয়ার ছয় মাস অতিবাহিত না হলে পূর্ববর্তী হিসাব বছরের নিরীক্ষিত আর্থিক বিবরণী) তথ্যের ভিত্তিতে রেটিং ন্যূনতম মারজিনাল হতে হবে।

ঋণের ব্যবহার
করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানসমূহের স্বাভাবিক কার্যক্রম পরিচালনার উদ্দেশ্যে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল ঋণের চাহিদার বিপরীতে এ প্যাকেজের আওতায় প্রদত্ত ঋণ ব্যবহার করা যাবে। তবে এ প্যাকেজের আওতায় পাওয়া ঋণ দিয়ে বিদ্যমান কোনও ঋণ হিসাব সমন্বয় বা পরিশোধ করা যাবে না। এছাড়া বিএমআরই-সহ ব্যবসা সম্প্রসারণ বা নতুন কোনও ব্যবসা চালুর জন্য এ ঋণ ব্যবহার করা যাবে না।

ঋণসীমা ও মেয়াদ
যেসব প্রতিষ্ঠান বর্তমানে ব্যাংক হতে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল ঋণ সুবিধা ভোগ করছে সেসব প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে এ প্যাকেজের আওতায় ঋণসীমা হবে বিদ্যমান ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল বাবদ মঞ্জুর হওয়া বা প্রদত্ত সীমার সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ। যেসব প্রতিষ্ঠান বর্তমানে ব্যাংক হতে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল ঋণ সুবিধা ভোগ করছে না সেসব প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে ঋণ প্রদানকারী ব্যাংকের বিদ্যমান নীতিমালার আওতায় ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল বাবদ ঋণ প্রাপ্যতা সীমা নির্ধারিত হবে। এ প্যাকেজের আওতায় ঋণ সীমা হবে উল্লিখিত প্রাপ্যতা সীমার সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ। এছাড়া এ প্যাকেজের আওতায় প্রদত্ত ঋণ একটি চলমান ঋণ হিসেবে বিবেচিত হবে। চলমান ঋণ ‘ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল আন্ডার স্টিমুলাস প্যাকেজ’ নামে অভিহিত হবে এবং সিএল-২ বিবরণীতে রিপোর্ট করতে হবে। প্রতিটি ঋণের মেয়াদ হবে সর্বোচ্চ ১ বছর। কোনোভাবেই আলোচ্য প্যাকেজের আওতায় এ ঋণ সুবিধা নবায়ন করা যাবে না। তবে ঋণগ্রহীতা প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায়িক লেনদেন সন্তোষজনক হলে ব্যাংকার-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে ঋণ সুবিধাটি নবায়ন করা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে পরবর্তী সময়ের জন্য সরকারের কাছ থেকে সুদ/মুনাফা বাবদ কোনও ভর্তুকি প্রাপ্য হবে না।

ঋণের সুদহার
এ ঋণের সুদ হার হবে সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ। প্রদত্ত ঋণের ওপর আরোপিত সুদ অর্ধেক অর্থাৎ সাড়ে ৪ শতাংশ ঋণ গ্রহীতা প্রতিষ্ঠান পরিশোধ করবে এবং অবশিষ্ট ৪.৫০ শতাংশ সরকার ভর্তুকি হিসেবে সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে প্রদান করবে। এক্ষেত্রে কোনও একক ঋণ গ্রহীতা প্রতিষ্ঠান সর্বোচ্চ এক বছরের জন্য সরকার হতে ভর্তুকি প্রাপ্য হবে। ঋণের ওপর ৯ শতাংশ হারে সুদ আরোপিত হলেও সরকার হতে প্রাপ্য ভর্তুকির সমপরিমাণ অর্থ ঋণগ্রহীতার দায় হিসেবে বিবেচিত হবে না।

ঋণের আবেদন গ্রহণ, অনুমোদন, বিতরণ ও তদারকি প্রক্রিয়া
করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত শিল্প ও সার্ভিস সেক্টরের প্রতিষ্ঠান যে কোনও তফসিলি ব্যাংকে ঋণের জন্য আবেদন করতে পারবে।
ব্যাংক কর্তৃক প্রদত্ত মোট ঋণের পরিমাণ নির্ধারিত সীমার অতিরিক্ত হলে সীমাতিরিক্ত ঋণের ওপর সরকার হতে ভর্তুকি প্রাপ্য হবে না। ঋণ নিতে ইচ্ছুক আবেদনকারী প্রতিষ্ঠানটি করোনাভাইরাসের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে- এ বিষয়টি নিশ্চিত হয়ে তফসিলি ব্যাংক স্ব-স্ব সীমার মধ্যে নিজস্ব ঋণ নীতিমালার আওতায় আবেদন করবেন। এ প্যাকেজের আওতায় ঋণ নিতে ইচ্ছুক যোগ্য আবেদনকারীদের ঋণ চাহিদা স্ব-স্ব ব্যাংকের ঋণ সীমার অধিক হলে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত বেশি ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। প্রদত্ত ঋণ সমন্বয় বা পরিশোধিত হলে অথবা নির্ধারিত মেয়াদ এক বছর অতিবাহিত হলে (যেটি আগে ঘটে) পরবর্তীতে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে একইভাবে অপেক্ষাকৃত বেশি ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। কোনও ব্যাংক এভাবে মোট তিন বছর পর্যন্ত এ প্যাকেজের আওতায় ঋণ দিতে পারবে। তবে একটি প্রতিষ্ঠান শুধুমাত্র এক বছরের জন্য আলোচ্য ভর্তুকি সুবিধা পাবে।

বাংলাদেশ ব্যাংক ওই সার্কুলারে প্রদত্ত ঋণ সুবিধা স্বল্প সংখ্যক গ্রাহকদের মধ্যে কেন্দ্রীভূত না করে ক্ষতিগ্রস্ত শিল্প ও সার্ভিস সেক্টরের অধিক সংখ্যক প্রতিষ্ঠান যাতে এ প্যাকেজের আওতায় ঋণ সুবিধা ভোগ করতে পারে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে সে বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়ারও নির্দেশ দিয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক
মনিটরিং করবে বাংলাদেশ ব্যাংক
বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারে উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগের আওতায় ‘বিশেষ মনিটরিং ইউনিট’ নামে একটি ইউনিট থাকবে। এ প্যাকেজের আওতায় ঋণ সংক্রান্ত যে কোনও প্রয়োজনে তফসিলি ব্যাংকগুলো ওই ইউনিটের সঙ্গে যোগাযোগ করবে। এছাড়া ওই ইউনিটের তত্ত্ববধানে যে কোনও সময় এ প্যাকেজের আওতায় প্রদত্ত ঋণ কার্যক্রম পরিদর্শন করা হবে। ব্যাংকের যথাযথ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক ঋণ মঞ্জুরি বা অনুমোদন হওয়ার পর উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের অনুমোদনের কপি, ঋণ গ্রহণে ইচ্ছুক আবেদনকারীর অনুকূলে ঋণ মঞ্জুরির স্বপক্ষে ব্যাংকের মতামতসহ ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী (বিদেশি ব্যাংকের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অপারেশনের প্রধান) এর স্বাক্ষরে প্রয়োজনীয় তথ্যাদিসহ ঋণ বা বিনিয়োগ করতে বাংলাদেশ ব্যাংকের সম্মতিপত্র প্রাপ্তির জন্য ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগ বরাবরে আবেদন করতে হবে।

প্রত্যেক ব্যাংকে বিশেষ সেল গঠন
বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, এতদ্সংক্রান্ত কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করার লক্ষ্যে ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীর সরাসরি তত্ত্বাবধানে একটি ‘বিশেষ সেল’ গঠন করতে হবে এবং ওই সেল এই প্যাকেজের আওতায় ঋণ কার্যক্রমের ফোকাল পয়েন্ট হিসেবে কাজ করবে এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ মনিটরিং ইউনিটের সঙ্গে প্রয়োজনীয় যোগাযোগ রক্ষা করবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের সম্মতি পত্র প্রাপ্তির পর ব্যাংক নিজস্ব ঋণ নীতিমালার আওতায় প্রয়োজনীয় কার্যক্রম সম্পন্ন করে নিজস্ব তহবিল হতে ঋণ বিতরণ করবে।

ঋণ আদায় প্রক্রিয়া
এ সুবিধা প্রাপ্তির লক্ষ্যে ঋণের বিপরীতে আরোপিত সুদ বা মুনাফাসহ ঋণের স্থিতি মঞ্জুর করা ঋণ সীমা অতিক্রম করতে পারবে না। তবে কোনও কারণে সুদ আরোপের ফলে ঋণের স্থিতি ঋণ সীমা অতিক্রম করলে প্রতি তিন মাস অন্তর পরবর্তী ৫ কর্মদিবসের মধ্যে ঋণ গ্রহীতা তা পরিশোধ বা সমন্বয় করবে। বিতরণ করা ঋণ বা বিনিয়োগ আদায়ের সব দায়-দায়িত্ব ঋণ দেওয়া ব্যাংকের ওপর বর্তাবে। ঋণ অনাদায়ে এরূপ হিসাব শ্রেণিকরণ ও প্রভিশনিং সংক্রান্ত বিদ্যমান নীতিমালা অনুযায়ী শ্রেণীকরণ করে যথাযথ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here