দুনিয়া কাঁপানো ভাইরাসগুলো শুরুতে অনেক শক্তিশালি হয়ে আসে। এক পর্যায়ে এদের তান্ডব আর থাকে না, দুর্বল হয়ে যায় বিভিন্ন কারণে। তবে পৃথিবী থেকে একদম নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় না। ‘কোভিড-১৯’ করোনা ভাইরাস গোত্রের নতুন শক্তিশালি সংস্করণ মাত্র। ভাইরাস হিস্ট্রি মোতাবেক, সামনের দিনগুলোতে ‘করোনার’ এই দানবিয় দাপট থাকবে না, নিজে নিজেই দুর্বল হতে থাকবে। যেমন থেমে গেছে দুনিয়া কাঁপানো আগেকার সব ভাইরাস। ‘কোভিড-১৯’ এতটা ভয়ঙ্কর কেন? ২৭ ডিসেম্বর ২০১৯ চীনের উহানে এটি প্রথম শনাক্ত হয়। তারপর থেকে এর তান্ডব চলছে। চিকিৎসা বিজ্ঞানিরা বলছেন, কোভিড-১৯ ভাইরাস মানব দেহে একবার ঢুকে গেলে সে নিজে নিজে ভাইরাস জন্ম দেয়। লন্ডনে ১৯৬৪ সালে ডা: জুন আলমেইডার আবিষ্কার করা ‘করোনা ভাইরাস’ গোত্রের নতুন শক্তিশালি সংস্করণ ‘কোভিড-১৯’ । ভাইরাসটির দুটি মারাত্মক ক্ষমতা রয়েছে, তা হলো- ৭-১৪ দিন মানুষের ভেতর সুপ্ত থাকতে পারে। এই সময় অনেকের মধ্যে উপসর্গ দেখা যায় না। প্রথমে গলার কোষে রক্ত চলাচলে বিঘœ ঘটায়, তাতে গলা ব্যথা হয়, শুষ্ক কাশি হয়। ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত করে। দ্বিতীয়ত সামাজিকভাবে দ্রুত সংক্রমণ ঘটাতে পারে। এই দুই কারণেই মানুষ আক্রান্ত হয় বেশি এবং কিছুদিনের মধ্যে মারা যায়। ফুসফুস আক্রান্ত হলে পানি জমে শ^াসকষ্ট তৈরি হয়। এসময় জটিল রোগির জন্য ভ্যান্টিলেটর খুব দরকার। ভ্যান্টিলেটর রোগির ফুসফুসে অক্সিজেন প্রবেশ করিয়ে, কার্বনডাইঅক্সাইড বের করে নিয়ে আসে। করোনা উপসর্গ দেখা দিলে সাহস নিয়ে, অধিক সতর্কতা অবলম্বন করলে শুরুতেই ভাইরাসটিকে পরাজয় করা সম্ভব। ঘরে থেকে সেই সুরক্ষা নিতে হবে। এতে ভয় বা আতঙ্ক ছড়ানো যাবে না। করোনা ভাইরাসে অল্প সময়ে মানুষ মারা না গেলে এই ‘করোনা’ আক্রান্তের বিশাল সংখ্যা কোনদিনই সমাজে পাত্তা পেত না, কোন তোলপাড়ও হতো না। মানুষ কি নিজের ‘হাতের কনুই’ নিজে কামড়াতে পারে ? কোন দিন কি তা সম্ভব ? সৃষ্টিকর্তা সেই মাপেই সব তৈরি করেছেন।
ভাইরাস হিস্ট্রি কি বলছে ?
মানুষের যান্ত্রিক বেপরোয়া জীবন যাপন, নিষিদ্ধ খাবারের প্রতি আকর্ষণ, নিষিদ্ধ জীবন আচার চর্চার মাধ্যমে নতুন নতুন ভাইরাস উৎপত্তি হয়। পৃথিবীতে নরমালি প্রতিদিন মানুষ মারা যাচ্ছে ১ লাখ ২৫ হাজার থেকে ৩০ হাজার। প্রতিদিন জন্ম নিচ্ছে ৩ লক্ষাধিক নবজাতক। সিজনাল ফ্লোতে এ বছর মৃত্যু হয়েছে ১ লাখ ৪৪ হাজার ৬৬৩ জন, সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে এ বছর ৯১ হাজার ৯২৫ জন মায়ের মৃত্যু হয়েছে, এ বছর ম্যালেরিয়া ভাইরাসে ২ লাখ ৯১ হাজার ৭২২ জন মারা গেছেন, ধূমপানে এ বছর ১ লাখ ৪৮ হাজার ৫৭৫ জনের মৃত্যু হয়েছে (১৮ এপ্রিল ২০২০ পর্যন্ত)। কই এতো মৃত্যু নিয়ে কোন হৈ চৈ নাইতো। সূত্র: ওয়ার্ল্ডোমেটার।
ভাইরাস নিয়ে একটি বাস্তব ঘটনা বলছি। সিনথিয়া’র বয়স মাত্র ২১। গায়ের রং কালো। আফ্রিকার কালো মেয়েরা উচ্চতায়, শারীরিক সুঠাম সুন্দর গঠনের অধিকারিণি হন। কারণ মেয়েদেরকে শক্ত হাতে পরিবারের হাল ধরতে হয়। সিনথিয়ার বয়স যখন ১৬ বছর, সেই থেকেই সে ‘এইচআইভি’ পজেটিভ। রাতে তার প্রথম নবজাতকের জন্ম হতে যাচ্ছে হাসপাতালে। খবরটি জানার পর জাতিসংঘ শান্তি মিশনে কর্মরত মেজর ডা: এনায়েত সাহেব মিডিয়া কর্মী হিসেবে আমাকে সঙ্গে নিয়ে যাবেন সিনথিয়ার বাচ্চাকে দেখতে, তাদের খোঁজ নিতে। এমনটাই আমাদের পরিকল্পনা। নবজাতক শিশুটি ‘এইচআইভি’ ভাইরাস পজেটিভ কিনা তাও জানা যাবে। পৃথিবীতে সদ্য আসা একটি নবজাতক ‘এইচআইভি’ পজেটিভ হবে তা-ই আমার কাছে তখন বিস্ময়কর এক ব্যাপার। এটি ভেবে রাতে আমার ঘুম হয়নি। ঘটনাটি সেন্ট্রাল আফ্রিকার দেশ দক্ষিণ সুদানের রাজধানী ‘জুবা’র কাছে ‘ইয়েই’ এলাকায়। চারদিকে গভীর জঙ্গল। একপাশে উগান্ডা, কঙ্গো এবং ইথিওপিয়ার সিমান্ত। দিনটি হলো ২০০৭ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি। ৪৪ ডিগ্রী সেলসিয়াস গরম। গৃহযুদ্ধ ছড়িয়ে পরা দেশটির চারদিকে যখন-তখন গুলাগুলি চলছে, গ্রেনেড ফুটছে। ইউএন শান্তি মিশনে এই অঞ্চলে বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর একটি ইউনিট কাজ করছে। মাঝে মাঝে সেখানে আমি ডিনারে যেতাম। এএসপি বকশি সাহেব এসে নিয়ে যেতেন। তো বিকেলে সামরিক প্রহরা নিয়ে মেজর ডা: এনায়েত সাহেব ও আমি হাসপাতালে গেলাম সিনথিয়া ও তার বাচ্চাকে দেখতে। হাসপাতালের বেডে সিনথিয়া বসে আছে। কোন টেনশন নেই। হাসি হাসি মুখ। বাচ্চাটি একদম কান্নাকাটি করছে না। ডাক্তার জানালেন, নবজাতক শিশুটি ‘এইচআইভি’ ভাইরাস পজেটিভ। শিশুটির মা সিনথিয়া তাকে বুকের দুধ পান করাচ্ছেন। সিনথিয়া কিভাবে ‘এইচআইভি’ পজেটিভ হলেন ? তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ফিলিপ, যে নবজাতকের বাবা (তখনও বিয়ে হয়নি) তিনিও এইচআইভি পজেটিভ। সিনথিয়ার তা জানা ছিল, তবে ফিলিপকে সে খুব ভালোবাসতো। সেই থেকে তাদের সংসার করার স্বপ্ন। ‘এইচআইভি’ পজেটিভ থেকে ‘এইডস’ এ পৌঁছাতে ১৮-২০ বছর সময় লাগতে পারে। যদি শরীরে ইমিউনিটি পাওয়ার যথেষ্ট থাকে। হাসপাতালের বারান্দায় আরো দুই কিশোরির সাথে আমার পরিচয় হলো। ডাক্তার বললেন, তারাও ‘এইচআইভি’ পজেটিভ। বয়স ১৫-১৬ হবে। আফ্রিকার এই অঞ্চলে এমন অনেক ভাইরাস রয়েছে যা পৃথিবীর বহু মানুষের অজানা। যেমন ‘স্লিপিং সিকনেস’ একটি ভাইরাস। এটি বাতাসে ভেসে বেড়ায়। কোন মানুষ যদি এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয় তাহলে টানা কয়েকদিন ঘুমিয়ে থাকবে এবং এক পর্যায়ে সেখানেই সে মারা যাবে। তার মরদেহটি কেউ ছুঁয়েও দেখবে না সংক্রমিত হবার ভয়ে। দূর থেকে বাঁশ বা লাঠি দিয়ে ঠেলে মাটিচাপা দেয়া হবে। সুদান, উগান্ডা অঞ্চলে আরেকটি মারাত্মক ভাইরাস হচ্ছে ‘লাসা ফিভার’ বা লাসা জ¦র। যুগযুগ ধরে চলছে এই ভাইরাস। এটি ইঁদুর থেকে সংক্রমিত হয়। এতটাই মারাত্মক যে এই জ¦রে আক্রান্ত হলে কয়েকদিনের মধ্যেই মানুষ মারা যায়। মরদেহ কোন গাড়ী বহন করে না। সে জন্য দ্রুত মাটিচাপা দেয়া হয়। আর ম্যালেরিয়া ভাইরাস তো আছেই। এ সম্পর্কে না-ই বললাম। আফ্্িরকার ঝুঁকিপূর্ণ এই অঞ্চলে ভ্রমণ করানোর আগে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল (সিএমএইচ) থেকে কয়েকটি ধাপে নির্ধারিত শারীরিক পরীক্ষা প্রক্রিয়া শেষ করতে হয়। পূর্ব সতর্কতামূলকভাবে চিকিৎসকগণ বেশ কয়েকটি ভ্যাকসিন দিয়ে থাকেন। দুনিয়ার সব ভাইরাস আফ্রিকায় হয়েছে না নয়। দুনিয়া কাঁপানো ৭টি ভাইরাসের বর্তমান অবস্থা যদি আমরা দেখি তা হলে বুঝতে পারবো আজকের দাপুটে ‘‘করোনা’’ ভাইরাসটি এক সময় এমন থাকবে না। গতি হারিয়ে অন্য রূপ নিতে পারে। এর মধ্যে মানুষ প্রতিরোধমূলক অনেক কিছু ব্যবহার শুরু করবে। এটি সময়ের ব্যাপার মাত্র।
দুনিয়া কাঁপানো ৭ ভাইরাস:
৭. হিউম্যান ইমিউনো ডিফিসিয়েন্সি ভাইরাস (এইচআইভি), যা পরে অ্যাকোয়ার্ড ইমিউনো ডিফিসিয়েন্সি সিনড্রোম (এইডস) হিসেবে দেখা দেয়। দুনিয়ায় এক প্রাণঘাতি ভাইরাস হিসেবে পরিচিত। ১৯৮০ সালে প্রথম পশ্চিমা সমকামি সম্প্রদায়ের কয়েকজন ‘এইচআইভি’ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়। তবে এর আগে ১৯২০ সালে আফ্রিকার জঙ্গলে শিম্পাজির মাধ্যমে ভাইরাসটি নিজের প্রভাব বিস্তার ঘটায় বলে হিস্ট্রি বলছে। দুনিয়া জুড়ে এই ভাইরাসটি এখন বিরাজমান। নীরবে বহু মানুষের শরীরে সংক্রমিত। তথ্য গোপন করে ভাইরাসটি নিয়ে অনেকে আমাদের মধ্যেই বসবাস করছেন। ভাইরাসটি নিয়ে ঢাকার মিডিয়ায় কাজ করার সময় আমি এমন কয়েকজন ভদ্রলোককে জানি যারা ‘এইচআইভি’ পজেটিভ। কিন্তু স্ত্রীকে কখনোই জানতে দেন না। দিব্যি সব কাজ করছেন। সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল এন্ড প্রিভেনশন- সিডিসি’র তথ্য মতে দুনিয়া জুড়ে ৬৫ মিলিয়ন মানুষ এই ভাইরাসে আক্রান্ত এবং মৃত্যু হয়েছে ২৫ মিলিয়ন মানুষ। উন্নত বহু দেশে ‘এইচআইভি’ ভাইরাস নিয়ে লাখ লাখ মানুষ সরকারীভাবে তালিকাভুক্ত। ১৯৮৯ সালে বাংলাদেশে প্রথম ‘এইচআইভি ভাইরাস’ পজেটিভ রোগি শনাক্ত হয়। একই সুঁই দিয়ে মাদক গ্রহণ করলে এটি ছড়াতে পারে। এছাড়া বহুগামি যৌন সম্পর্ক গড়লে এটি ছড়ায়। ‘ওরাল সেক্স’ এর মাধ্যমেও ছড়ায়। ‘ইউনাইটেড ন্যাশন্স এইডস’ এর তথ্য মতে বাংলাদেশে এখন ১২ হাজারের বেশি এইচআইভি পজেটিভ মানুষ রয়েছে। তবে সরকারী হিসেবে আরো কম। ইতোমধ্যে ১২৪২ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে সরকারী সর্বশেষ তথ্য মোতাবেক জানা যায়। যৌন সম্পর্ক ছাড়াও এই ভাইরাস ছড়ায়। যদি না মানুষ সতর্কতা অবলম্বন করে। বাংলাদেশে ২০১৭ সালে নতুন করে ৮৬৫ জন, ২০১৮ সালে ৮৬৯ জন এবং ২০১৯ সালে ৯১৯ জন নতুন এইচআইভি পজেটিভ শনাক্ত হয়। অর্থাৎ ভাইরাসটি দিনদিন ছড়িয়ে পড়ছে।
৬. ‘সোয়াইন ফ্লো’ ২০০৯ সালে দেখা দেয়। এর নামকরণ হয়েছিল ‘নভেল ইনফ্লোয়েঞ্জা’। সিডিসি সূত্র মতে, ২০০৯-এর ১২ এপ্রিল থেকে ২০১০ এর ১০ এপ্রিল পর্যন্ত এক বছরে এটি দুনিয়া জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। ৬০.৮ মিলিয়ন মানুষ আক্রান্ত হয়েছিল সোয়াইন ফ্লোতে। এর মধ্যে ৫ লাখ ৭৫ হাজার ৪০০ মানুষ মারা যায়। সোয়াইন ফ্লোতে শিশু এবং মধ্য বয়ষ্করাই বেশি আক্রান্ত হয়েছিলো। ২০১০ সালের ১০ আগস্টে অফিসিয়ালি এই ভাইরাসের সমাপ্তি ঘোষণা করা হলেও প্রতি বছরই পৃথিবীতে ‘সিজনাল’ ঠান্ডা, কাশি, জ¦র ‘ফ্লো’তে মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে।
৫. ১৯৫৭ সাল। ‘এশিয়ান ফ্লু’র তান্ডবে মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়েছিল। ওই বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে এটি প্রথম ধরা পরে সিঙ্গাপুরে। মূলত এইচ-২ এন-২ ভাইরাসের মাধ্যমে এটি এপ্রিল মাসে শক্তিশালি হয় হংকং-এ। তারপর এটি দুনিয়াব্যাপি ছড়িয়ে পড়ে। ওই সময় ১.১ মিলিয়ন মানুষ মারা যায়।
৪. ‘হংকং ফ্লো’ ১৯৬৮ সালে শুরু হলে সারা দুনিয়ার মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। এর অরজিন শুরু হয় ১৯৬৮ সালের জুলাই মাসে চীন থেকে। এটিও একটি ঠান্ডা, সর্দি ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস গোত্রের এইচ-৩ এন-২। এই ভাইরাসে দুনিয়া জুড়ে ১০ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার মতে ১৯৫৭ সালের ‘এশিয়ান ফ্লো’ পরবর্তীতে এন্টিজেনিক শিফট হয়ে ‘হংকং ফেøা’ মহামারি হিসেবে দেখা দিয়েছিলো।
৩. ‘সার্স ভাইরাস’ ২০০৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে পূর্ব চীন অঞ্চলে দেখা দেয়। পরে দুনিয়ার ৩২টি দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। ওই সময় ৮ হাজার মানুষ এই ভাইরাসে সংক্রমিত হয়। প্রায় এক হাজার মানুষের মৃত্যু হয়।
২. দুনিয়া কাঁপানো আরেক ভাইরাস ‘স্পেনিশ ফ্লো।’ ১৯১৮ এবং ১৯১৯ সালে ‘স্পেনিশ ফ্লোর’ ভয়াবহতার শিকার হয়েছে বিশ^ জুড়ে কয়েক কোটি মানুষ। এটা ছিল একটা ‘ইনফ্লুয়েঞ্জা প্যান্ডামিক’। এতে দুনিয়াব্যাপি ৫ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল এন্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) বলছে, মোট আক্রান্ত হয়েছিল ৫০০ মিলিয়ন মানুষ। এটি মূলত পাখির মাধ্যমে ছড়াতো। ওই সময় বঙ্গ দেশে ঘরের কবুতর, হাস, খামারের মুরগী হত্যা করে গণহারে মাটিচাপা দেয়া হয়েছিল।
১. ইতিহাসের ভয়াবহ ভাইরাসের আরেকটি হচ্ছে, ‘লন্ডন প্লেগ’। এটি ১৬৬৫ সালে ছড়িয়ে পড়ার কারণে প্রাণ হারিয়েছে লাখ লাখ মানুষ। এক বছর পর ১৬৬৬ সালে আবার এই প্লেগ ভাইরাস দেখা দিলে প্রচুর জীবনহানি ঘটে। মানুষ এবং প্রাণীর মাধ্যমে এটি ছড়িয়ে পড়তো। বিস্ময়কর বিষয় হচ্ছে শতশত বছর পরও দুনিয়ার কোন না কোন অঞ্চলে ‘প্লেগ’ ভাইরাসটির অস্তিÍত্ব রয়েছে বলে সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল এন্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) সূত্রে জানা যায়।
প্রাণঘাতি ‘করোনা ভাইরাস’র জন্ম প্রাকৃতিক কিনা তা নিয়ে ডানে-বায়ে ব্যাপক গুঞ্জন আছে। লন্ডনের বিখ্যাত সেন্ট থমাস হাসপাতালে (যেখানে প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন করোনা রোগে চিকিৎসাধিন ছিলেন) প্রথম করোনা ভাইরাস ১৯৬৪ সালে শনাক্ত করেছিলেন ড. জুন আলমেইডা। এই প্রতিভাবান নারী গবেষক ঠান্ডা, সর্দি কাশি, ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের মধ্যে প্রথম ‘করোনা’কে দেখতে পান। ভাইরাসটি দেখতে অনেকটা ‘ক্রাউনে’র মতো সাদৃশ্য বিধায় তিনি এর নামকরণ করেন ‘করোনা’। তবে তার সেই গবেষণা চাপা পড়ে যায় বহু বছর আগে। ২০০৭ সালে তিনি মারা গেছেন।
সৃষ্টিকর্তার বিস্ময়কর নিদর্শন:
ভাইরাস হিস্ট্রি থেকে সংক্ষেপে বলতে গেলে সৃষ্টির শুরু থেকেই লাখ লাখ ব্যাক্টেরিয়া, ভাইরাস, জীবাণু আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে আছে। এর মধ্যেই মানুষের বসবাস। পৃথিবীতে ভাইরাস মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ার পর একটা সময় দুর্বল হয়ে সুপ্ত থাকে কিন্তু কোন ভাইরাসই সম্পূর্ণ নির্মূল হয়ে যায় না বলে তথ্য রয়েছে। শরীরের ‘ইমিউনিটি পাওয়ার’ দিয়ে আপনি, আমি বা প্রতিটি মানুষ ভাইরাস, ব্যাক্টেরিয়াকে পরাজিত করে বেঁচে আছি। যখন শরীরের ‘ইমিউনিটি পাওয়ার’ কুলিয়ে উঠতে না পারে তখন সেই মানুষটি রোগাক্রান্ত হচ্ছে। অর্থাৎ শরীরের ভেতরে অবস্থান করা ব্যাক্টেরিয়া, ভাইরাসের বিজয় হয়। মেডিক্যাল সাইন্স বলছে, স্বাস্থ্য সুরক্ষায় শরীরের ভেতর প্রহরির মতো দায়িত্ব পালন করে ‘হোয়াইট সেল’। এই ‘হোয়াইট সেল’ দ্বারা কোন ‘ভাইরাস’ যখন আক্রান্ত হয়ে মারা যায় তখন আমরা সুস্থ অবস্থায় থাকি। শরীরের রক্ত ধমনিতে ‘হোয়াইট সেল’ প্রতিনিয়ত টহল দিতে থাকে তার ‘শত্রু ভাইরাস’, ব্যাক্টেরিয়াকে খোঁজে হত্যা করার জন্য। ‘হোয়াইট সেল’ অসংখ্য ভাইরাস ও ব্যাক্টেরিয়াকে প্রতিদিন হত্যা করছে। এমনকি আমরা যখন ঘুমিয়ে থাকি তখনও স্বয়ংক্রিয়ভাবে শরীরে ঢুকে পড়া ভাইরাসকে হত্যা করে ‘হোয়াইট সেল’। যাতে শরীর আক্রান্ত না হতে পারে। প্রভুর কাছে এই কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। মানুষের শরীরের ভেতর সার্বক্ষণিক এই যুদ্ধ চলছেই। এটি মহান সৃষ্টিকর্তার দেয়া এক বিস্ময়কর চলমান পক্রিয়া। মনে করুন, চোখের খুব নিকটে একটি পোকা আসা মাত্র চোখের শাটার বন্ধ হয়ে যায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে। এটি কেন ঘটে ? এটি হয় মস্তিষ্কের নিউরণ থেকে ‘কমান্ড’ বা নির্দেশনার পায় বলে। একবার ভেবে দেখুন, কত দ্রুততার সঙ্গে এই নির্দেশনা চোখে আসে এবং তা কার্যকরি হয়। নিউরণগুলো কতটা সতর্ক প্রহরায় থাকে। বিজ্ঞানি আইনস্টাইন একবার বলেছেন, ‘একজন সুন্দরী নারীর সঙ্গে কয়েক ঘন্টা কাটাবার পর মনে হবে যেন কয়েক মিনিট মাত্র ছিলাম। আবার একটি জ¦লন্ত চুলার ওপর কয়েক মিনিট থাকার পর মনে হবে কয়েক ঘন্টা ধরে যেন আছি।’ এটি হয় পরিবেশগত অবস্থানের কারণে। মেডিক্যাল সাইন্স বলছে, মানব শরীরে ‘ইমিউনিটি পাওয়ার’ একেকজনের একেক রকম হয়। মায়ের পেটের ভেতর গর্ভধারণের ৫ম সপ্তাহ (৩৫ দিন) থেকে নবজাতকের ‘হার্ট বিট’ বা হৃদযন্ত্রের টিক টিক শব্দ শুরু হয়। সেই সময় থেকে শিশুটির যে ‘জিন’ বা ‘ডিএনএ’ গঠন হয় তার ওপর নির্ভর করে পরবর্তী জীবনে রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতার রেঞ্জ, মেধা, তার গায়ের রং, উচ্চতা, চেহারা, নাক-চোখ কেমন হবে সবকিছু। এই নিখুঁত কর্মযজ্ঞ কোন মানুষেরই নিয়ন্ত্রণে নেই এবং কোন মানুষের পক্ষেই সম্ভব নয়। ‘‘ ২০-২৩. আমি কি তোমাদের তুচ্ছ তরল পদার্থ থেকে সৃষ্টি করিনি ? তারপর এক নির্দিষ্ট কাল পর্যন্ত আমি তা রেখেছি নিরাপদ আধারে। তারপর তার গঠন ও প্রকৃতি নিরূপণ করেছি। কত নিপুণ আমার নিরূপণ ক্ষমতা ! ২৪. মহাবিচার দিবসে দুর্ভোগ তাদের জন্য, যারা সত্য অমান্য করে।” (সূরা: মুরসালাত)। মহান সৃষ্টিকর্তা অনেক দয়ালু।
গর্ভকালিন সময়টায় মায়েদের খুব সতর্কতার সঙ্গে থাকতে বলা হয়েছে। কারণ মায়ের ভালো-মন্দ সব কিছুই সন্তানের ‘ডিএনএ’-এর মধ্যে লিপিবদ্ধ হতে থাকে। জন্মের পর যে শিশু মায়ের দুধ পান করে এবং যে মা বুকের দুধ না দিয়ে শিশুকে ফিডার খেতে দেন ওই দুই শিশুর শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার পার্থক্য আকাশ পাতাল হয় বলে চিকিৎসকগণ বলছেন। মানুষের শরীরের মধ্যে মুখে এবং নাভীতে সবচেয়ে বেশি ব্যাক্টেরিয়া, ভাইরাস অবস্থান করে। একজন মানুষের মুখে প্রতিদিন দেড় লিটার পরিমাণ তরল ‘লালা’ তৈরি হয়। তা কেন হয়, শরীরে কি কাজে লাগে সে আরেক বিস্ময়। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, মানুষের খুব আকাঙ্খিত স্বপ্ন, পরিবারে কখন ছেলে হবে বা কখন মেয়ে হবে সেই জন্ম রহস্য জানা। এই জটিল প্রশ্নের বৈজ্ঞানিক ব্যাখা ১৪০০ বছর আগে হযরত মোহাম্মদ (স:) দিয়ে গেছেন। মহামারির সময় কি করণিয় তা নিয়ে নবী মোহাম্মদ (স:) তাঁর সময়েই গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। যা আজকের দিনে খুব প্রযোজ্য। যদি আমরা তা মান্য করি, তবেই সাফল্য।
করোনার তান্ডব থাকবে না:
পৃথিবীতে ভয়ঙ্কর প্রাণঘাতি ভাইরাস ছড়িয়ে পরার ঘটনা নতুন কিছু নয়। শতশত বছর আগে থেকেই এই ধারা চলে আসছে। তাই এ নিয়ে ভয় বা আতঙ্ক না ছড়িয়ে অধিক সতর্কতামূলক মানবিক অবস্থান গ্রহণ জরুরী। প্রযুক্তির বর্তমান যুগে সাহস নিয়ে, ঘৃণা না ছড়িয়ে, একজন আরেকজনের পাশে দাঁড়িয়ে কাজ করতে হবে। যে জাতি এটি করতে পেরেছে তারা টিকে থাকে। যারা উদাসিনতা বা অবহেলা দেখায় তাদেরকে চলে যেতে হয়। ইতিহাস বলছে, বহু জাতি যুগেযুগে দুনিয়া থেকে বিলুপ্ত হয়েছে তাদের গর্হিত কর্মের কারণে। বহু বছর এত বড় দুর্যোগ আর আসেনি। করোনা ভাইরাস স্মরণকালের সবচেয়ে বড় সমস্যা। তবে সাহস আর ধৈর্য্য দরকার। “৫-৬. মনে রেখো, প্রতিটি কষ্টের সাথেই রয়েছে স্বস্তি। নি:সন্দেহে প্রতিটি কষ্টের সাথেই রয়েছে স্বস্তি !” [অর্থাৎ প্রতিটি সমস্যার ভেতরেই রয়েছে তার সমাধান, প্রতিটি সমস্যার ভেতরেই রয়েছে নতুন সম্ভাবনা।]” (সূরা ইনশিরাহ)। আজকের করোনা ভাইরাসের মর্মান্তিক তান্ডব এক সময় থেমে যাবেই। এটিই চিরন্তন সত্য। তবে রেখে যাবে অনেক বেদনাময় ঘটনা। যা আগামীতে ইতিহাস হয়ে থাকবে।
লেখক : অনুসন্ধানি সাংবাদিক, টিভি রিপোর্টার