করোনা পরবর্তী এক অচেনা বাংলাদেশ দেখতে যাচ্ছি ?

0
46

আসিফ হাসান রাজু

চীনের উহানে জন্ম নেওয়া করোনাভাইরাস কোভিড-১৯ এর কারণে বর্তমান পৃথিবীর মানুষ যেন সভ্যতার এক ক্রান্তীকাল অতিক্রম করছে। এর আগে আধুনিক বিশ্বের মানুষ মহামারির সম্মুখীন হয় ১৯১৮ সালে, যা স্প্যানিশ ফ্লু নামে পরিচিত ছিল। এতে পৃথিবী জুড়ে ৫০০ মিলিয়ন মানুষ আক্রান্ত হয়। আর মৃত্যুবরণ করে প্রায় ৫০ মিলিয়ন মানুষ (সিডিসি)। এ ছাড়া ২০০৩ সালে চীন থেকে মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ে সার্স ভাইরাস। সেই সময় পৃথিবীর ২৬টি রাষ্ট্রের মানুষ আক্রান্ত হয় ভাইরাসটিতে।

ওই দুই মহামারির পরবর্তী সময়ে খাদ্যের তীব্র সংকটে ভুগেছে বিশ্ব। এর প্রভাব সব থেকে বেশি পড়েছিল দরিদ্র্য জনগোষ্ঠীর ওপর। উন্নত প্রযুক্তির কল্যাণে ইতিমধ্যেই করোনার ক্ষতির সক্ষমতা, মৃত্যুর হার, ছড়ানোর মাধ্যম সম্পর্কে কম-বেশি সকলেই জেনে গেছে। প্রতিদিনই কোভিড-১৯ ক্ষয়ক্ষতির চমক দেখিয়ে চলেছে। এর শেষ কোথায় আমারা সেটা কেও জানি না। চিকিৎসা বিজ্ঞান ভাইরাসটির প্রতিষেধক আবিষ্কারের জন্য প্রাণপণ কাজ করে যাচ্ছে। যার ফলাফল স্বরূপ হয়তো বিশ্ব এই ভাইরাসের হাত থেকে রক্ষা পাবে, সেই আশা হয়তো আমরা করতে পারি।

করোনা মহামারি পরবর্তী এক নতুন বিশ্বে রূপ নেবে সেই অনুমানও করছেন গবেষকরা। বিশেষ করে অর্থনীতিতে এর প্রভাব পড়বে সব থেকে বেশি। বর্তমান অবস্থা বিবেচনায় বলা যায় যে, করোনা যেন পুঁজিবাদকে ধংসের দ্বার প্রান্তে পৌঁছে দিবে। বিশ্ব অর্থব্যবস্থা অচল প্রায়। ফলে বিশ্ব শুধু স্বাস্থ্যব্যবস্থা নিয়েই চিন্তিত নয়। তার সাথে চিন্তার জায়গা করে নিয়েছে করোনা পরবর্তী অর্থনীতি ব্যবস্থা কী হবে? কোন পথে গেলে এ অচলাবস্থা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে।

উন্নত রাষ্ট্রের তুলনায় উন্নয়শীল বা তৃতীয় বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোর বিপর্যয় আরও বেশী হবে। লকডাউনের ফলে সারা বিশ্বের অধিকাংশ কোম্পানির কারখানার উৎপাদন বন্ধ রাখা হয়েছে, যা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়। এ অবস্থা চলতে থাকলে বিশ্ববাজারে বড় ধরনের বিপর্যয় দেখা দেবে, যার প্রভাব আমাদের দেশের ওপরও পড়বে। যদিও অর্থনৈতিক ক্ষতি কিছুটা কাটিয়ে উঠতে ইতোমধ্যে আমাদের গার্মেন্টস খুলে দেওয়া হয়েছে। জেপি মর্গানের মতে, ‘পরপর আগামী দুই প্রান্তিকে বিশ্ব অর্থনীতিতে ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি দেখা দেবে করোনার প্রভাবে।’ এ ছাড়া বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর সংগঠন ওইসিডি জানিয়েছে, ‘চলতি বছরে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হবে ২০১৯ সালের প্রবৃদ্ধির অর্ধেক।’ এ ছাড়া ব্লুমবার্গের এক প্রতিবেদন দেখে আঁতকে উঠতে হয়! যেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, করোনা বিশ্ব অর্থনীতিতে দুই দশমিক সাত ট্রিলিয়ন ডলারের লোকসান ঘটাবে। ফলে এ থেকে সহজে অনুমেয় আমাদের মত উন্নয়নশীল দেশের অর্থনীতি কোন অবস্থায় দাঁড়াবে।

বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান দুই চালিকাশক্তি রপ্তানি ও রেমিট্যান্স। ফলে এ দুটি খাতের আয় কমে গেলে তার প্রভাব পড়বে গোটা জাতির ওপর। রপ্তানি আয় কমে গেলে দেশের শিল্প কারখানাগুলোতে শ্রমিকদের আয় কবে যাওয়ার পাশাপাশি কর্মসংস্থানের অনিশ্চয়তা তৈরি হবে। যা ইতোমধ্যে দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে। বেশ কিছু গার্মেন্ট তাদের শ্রমিক ছাটায় করেছে। এসব কিছু পত্র-প্রত্রিকা, সোস্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে জানা গেছে।

অন্যদিকে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখার দ্বিতীয় উৎস রেমিট্যান্স। বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা রেমিট্যান্স যোদ্ধারা টাকা পাঠানো কমিয়ে দিলে তাদের পরিবার আর আগের মতো জীবনযাপন করতে পারবে না। ফলে তার প্রভাব তাদের পারিবারিক জীবনের পাশাপাশি সামাজিক জীবনে গিয়েও বর্তাবে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে ব্যবসা বাণিজ্যের ওপর। কমে যাবে বেচাকেনা। ফলে চাহিদা কমে গেলে ভোক্তা পণ্য প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষতির মুখে পড়বে। অন্যদিকে সবমিলিয়ে চলতি বছরে জিডিপির লক্ষ্য পূরণে বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবে রাষ্ট্র। ইতোমধ্যে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ইঙ্গিত দিয়েছে বাংলাদেশের জিডিপি সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতিতে এক দশমিক এক ভাগ কমে যেতে পারে। ডেইলি স্টারের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে এই ক্ষতির পরিমাণ হতে পারে, ৩০০ কোটি ডলারের মত। আর চাকরি হারাতে পারে আট লাখ ৯৪ হাজার ৯৩০ জন মানুষ। এ থেকে বোঝা যায় করোনা পরবর্তী আমরা এক অচেনা বাংলাদেশ দেখতে যাচ্ছি।

লকডাউনের কারণে ইতোমধ্যে আমাদের দেশে বর্তমানে করোনার চেয়ে ভয়াবহ হয়ে উঠতে শুরু করেছে খাদ্যের সংকট। বৈশ্বিক গবেষণা বলছে, বিশ্ব জুড়ে এ ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার ফলে দেশীয় খাদ্য নিরাপত্তাসহ সামগ্রিক জীবনযাত্রা, কর্ম হারিয়ে বেকার হয়ে পড়ার পাশাপাশি দ্রব্যমূল্য ও দেশগুলো খাদ্য সংকটে পড়তে পারে। করোনা পরবর্তী বাংলাদেশের অবস্থা কিরূপ হতে পারে সেই অবস্থাকে ব্যাখ্যা করি তাহলে দেখা যাবে, বর্তমান আর করোনা পরবর্তী বাংলাদেশের চিত্র আলাদা হতে পারে। কেননা, অর্থনীতির পরিবর্তন সামাজিক কাঠামোর পরিবর্তন করে। অর্থাৎ, শের অর্থনৈতিক আয়ের এই দুটি খাতের প্রভাব পড়ে আমাদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক জীবনে। এ থেকে করোনা পরবর্তী বাংলাদেশের চিত্র অনুমান করা যায়।

খাদ্য সংকট, বেকারত্ব, শিক্ষাব্যবস্খায় প্রভাব, সামাজিক অস্থিরতা, দুরুত্ব বৃদ্ধি পাওয়ার পাশাপাশি আইন শৃঙ্খলার অবনতির মত ঘটনা ঘটতে পারে। ফলে সময় থাকতে রাষ্ট্রকে এখনই বিভিন্ন অংশীজন ও বিশেষজ্ঞদের সাথে পরামর্শসহ সদূর প্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে সামনে অগ্রসর হতে হবে। খাদ্যে সংকটের হাত থেকে রক্ষা পেতে দেশের কৃষকদের সব ধরনের সুযোগ সুবিধা-প্রদান করতে হবে।

কৃষিখাতের পাশাপাশি শিল্পখাতের দিকে নজর দিতে হবে। এ ছাড়া অর্থনীতির চাকা সচল রাখার জন্য শ্রমিকদের স্বাস্থ্যর দিকেও দৃষ্টি দিতে হবে। বৈশ্বিক মহামারি পরবর্তী সময়ে প্রতিটি রাষ্ট্র চাইবে তার নিজ নিজ রাষ্ট্রকে নিয়ে কাজ করতে। ফলে তারা নিজেদের উন্নয়নের কথাই বেশি চিন্তা করবে। তাই বর্তমান এ মহামারির পরবর্তী সময়ের জন্য নিজেদের যে সম্পদ আছে তার সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে এখনি কার্যকরি পর্দক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। কেননা, করোনার সময়কালের চেয়ে পরবর্তী সময়ে সংকট আরও তীব্র হতে পারে। ফলে বলা চলে, করোনা পরবর্তী নতুন এক বিশ্বের মতো হয়তো নতুন এক বাংলাদেশ অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য।

লেখক : সাংবাদিক ও শিক্ষার্থী, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here