আবারও বুক চিতিয়ে উপকূলবাসীকে রক্ষা করেছে সুন্দরবন

0
130

বাংলা খবর ডেস্ক:
ভয়ংকর আম্ফান তছনছ করেছে গাছপালা, মানুষের ঘরবাড়ি। আম্ফান উপকূলে আছড়ে পড়ার আগেই গতকাল বুধবার সন্ধ্যা পর্যন্ত উপকূলীয় নদ-নদীগুলোর পানি ৩ থেকে ৬ ফুট বেড়ে যায়। এ কারণে পটুয়াখালী, বরগুনা, পিরোজপুরসহ বিভিন্ন জেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। রাত পর্যন্ত শতাধিক গ্রাম তলিয়ে হাজার হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়ার খবর পাওয়া গেছে। আম্ফান যখন উপকূলে আছড়ে পড়ে, তখন ৫-১০ ফুট পর্যন্ত জলোচ্ছ্বাস হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। পুরো অঞ্চলজুড়ে লাখ লাখ মানুষের বাড়ির বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে টেলিফোন ও ইন্টারনেট সংযোগ।
সুপার সাইক্লোন আম্ফান কেড়ে নিয়েছে অন্তত ১০ জনের প্রাণ। নিহতদের মধ্যে যশোরের চৌগাছায় ২, পটুয়াখালীতে ২, ভোলায় ২, বরগুনায় ১, সাতক্ষীরায় ১, সন্দ্বীপে ১ ও পিরোজপুরে একজন রয়েছে। এদের বেশিরভাগই ঝড়ের আঘাতে গাছ চাপা পড়ে মারা যান। এছাড়া এর প্রভাবে দেশের বিভিন্ন স্থানে অনেক ঘর-বাড়ি ও গাছপালা ভেঙে পড়েছে। দক্ষিণাঞ্চলের বেশির ভাগ এলাকা বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। কয়েক ফুট বেড়েছে নদনদীর পানি।

আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের ব্যাস ছিল ৪০০ কিলোমিটার। এর প্রভাবে বুধবার রাত থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বৃষ্টি হতে পারে। ঘূর্ণিঝড়কেন্দ্রের ৭৪ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের একটানা গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১৬০ কিলোমিটার। যা দমকা অথবা ঝোড়ো হাওয়া আকারে ১৮০ কিলোমিটার পর্যন্ত বেড়েছে। তিনি বলেন, আম্ফানের প্রভাবে মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরে ১০ নম্বর মহাবিপত্সংকেত বহাল আছে। এ ছাড়া উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখলী, বরিশাল, ভোলা, লক্ষ্মীপুর, চাদপুর এবং এসব জেলার দ্বীপ ও চরগুলো ১০ নম্বর মহাবিপত্সংকেতের আওতায় রয়েছে। এর বাইরে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার সমুদ্রবন্দরকে ৯ নম্বর সতর্কসংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। ওদিকে বিবিসি বাংলার খবরে বলা হয়, ঘূর্ণিঝড় আম্ফান ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে। সেখানে অন্তত ১২ জনের মৃত্যু হয়েছে।

আম্ফানের প্রভাবে বৃষ্টিপাত ও দমকা বাতাসের কারণে উপকূলীয় নদ-নদীগুলো উত্তাল হয়ে ওঠায় সাতক্ষীরা, খুলনা, বরগুনা, পটুয়াখালী, লক্ষ্মীপুরসহ বিভিন্ন জেলায় বেড়িবাঁধে ভাঙন দেখা দেয়। অনেক স্থানে ফাটল ধরেছে বাঁধে। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোর অন্তত ২৪ লাখ মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছে।

আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার পথে গতকাল দুপুরে বরগুনায় এক ব্যক্তি প্রাণ হারিয়েছেন। এ ছাড়া ঝোড়ো বাতাসে গাছ ভেঙে পড়ে ভোলার চরফ্যাশনে মারা গেছেন একজন। একইভাবে পটুয়াখালীর গলাচিপায় মারা গেছে এক শিশু। জেলার কলাপাড়ায় নৌকা ডুবে মারা গেছেন সিপিপির এক টিম লিডার। গাছের ডাল ভেঙে পড়ে সাতক্ষীরা সদরের কামালনগরে মারা গেছেন এক নারী। পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায় ঘরের দেয়াল ধসে চাপা পড়ে মারা গেছেন একজন।

আবহাওয়া অফিসের দেওয়া তথ্য অনুযায়ি, ভারতের সমুদ্র উপকূল দিঘা, বকখালী, কাকদ্বীপ, তাজপুর ও সুন্দরবন অংশে তাণ্ডব চালিয়ে আম্ফানের অগ্রভাগের প্রভাব বাংলাদেশে পড়তে শুরু করে গতকাল বিকেল ৪টা থেকে। সুপার সাইক্লোনিক ঘূর্ণিঝড়টি দুর্বল হয়ে অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় আম্ফান সাতক্ষীরা-খুলনা দিয়ে প্রবেশ করে ১৬০ থেকে ১৮০ কিলোমিটার বেগে। ঘূর্ণিঝড়টি সন্ধ্যা ৬টা নাগাদ বাংলাদেশের সুন্দরবন এলাকা দিয়ে পরবর্তী তিন থেকে চার ঘণ্টায় বাংলাদেশ উপকূল অতিক্রম করে। যশোর, মাগুরা, ঝিনাইদহ, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, শেরপুর, জামালপুুর ও গাইবান্ধা হয়ে আবার ভারতের পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশ করে রাত ১টার দিকে।

রবিবার লঘুচাপ থেকে তৈরি হয় সুস্পষ্ট লঘুচাপ। সেখান থেকে নিম্নচাপ, তারপর গভীর নিম্নচাপ থেকে সোমবার ঘূর্ণিঝড় আম্ফান সাগরে অবস্থান করে। এরপর মঙ্গলবার আম্ফান সুপার সাইক্লোনিক ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয়।

ছয় মাস আগে ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের মতো আবারও বুক চিতিয়ে উপকূলবাসীকে রক্ষা করেছে বিশ্ব ঐতিহ্যের স্থান সুন্দরবন। আম্ফান সুন্দরবন অতিক্রম করার সময় শক্তি অনেক ক্ষয় হয়ে গেছে। ২০০৭ সালের ঘূর্ণিঝড় সিডরের কেন্দ্রবিন্দু ছিল বরগুনার পাথরঘাটা। বাতাসের গতিবেগ ঘণ্টায় ২২৩ কিলোমিটার বেগে বাংলাদেশ অংশে ঢুকে ব্যাপক প্রাণহানি হয়েছিল সিডরের সময়।

পরিবেশবিদদের মতে, সিডর যদি দক্ষিণাঞ্চলের জেলা সাতক্ষীরা সুন্দরবন দিয়ে ঢুকত, তাহলে ক্ষয়ক্ষতি কম হতো। দুই বছর পর আইলার গতিপথ ছিল খুলনা-সাতক্ষীরা সুন্দরবন এলাকা। ঘণ্টায় ১১৩ কিলোমিটার বেগে আসা ওই ঘূর্ণিঝড়ে তুলনামূলক কম ক্ষতি হয়েছিল সুন্দরবনের কারণে। ঘূর্ণিঝড় আম্ফানও বাংলাদেশ অংশে ঢুকেছে সাতক্ষীরা সুন্দরবন দিয়ে। আইলার চেয়ে বাতাসের গতিবেগ বেশি থাকায় আইলার চেয়ে ক্ষয়ক্ষতি বেশি হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। যদিও ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের ক্ষতি সিডরের মতো হওয়ার আশঙ্কাটা ক্ষীণ।

ভারতের আবহাওয়া অফিসের তথ্য মতে, অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় ভারত উপকূলে আঘাত হানে দুপুর আড়াইটায়। ঝড়ের গতি ছিল ১১০ কিলোমিটারের ওপরে। আইলা, বুলবুল ফণী পশ্চিমবঙ্গের যতটা ক্ষতি করেছে, তার চেয়ে অনেক বেশি ক্ষতি করেছে আম্ফান। এমনটাই বলছে ভারতের আবহাওয়া অফিস। ভারতের আবহাওয়াবিদরা বলছেন, গত ৫০ বছরের মধ্যে এত বড় দুর্যোগ আর হয়নি যেটা আম্ফান করেছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, ঘূর্ণিঝড় আম্ফানে কৃষিতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। আম, লিচু, কাঁঠাল এখনো গাছে। কৃষকের বোরো ধান মাঠে। বাদামও মাঠে। এ বছর ৪৭ লাখ ৫৪ হাজার ৭৩৪ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে। গতকাল পর্যন্ত প্রায় ৭১ শতাংশ ধান কাটা সম্পন্ন হয়েছে। উপকূলের ১৫টি জেলায় চলতি বোরো মৌসুমে পাঁচ লাখ ৮৯ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে। গতকাল পর্যন্ত কাটা হয়েছে পাঁচ লাখ ৬৫ হাজার হেক্টর।

মন্তব্য

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here