‘রিপোর্টার থেকে সম্পাদক’- পর্ব-১

0
145

শাহজাহান সরদার:

আমার লেখা ‘রিপোর্টার থেকে সম্পাদক’ বইটি এই ‘করোনাকালের’ অবসরে ধারাবাহিকভাবে একদিন পর পর পোস্ট করা হবে। আশা করি আপনারা বইটি পড়ে দেশের সংবাদপত্র ও রাজনীতির ভেতরের অনেক খবর জানতে পারবেন।

(পর্ব- ১)

১৯৯৮ সাল। তারিখ মনে নেই। শেখ হাসিনার প্রথম মেয়াদের সরকারের মাঝামাঝি সময়। ইত্তেফাক অফিসে রাতে কাজ করছি। মোবাইল ফোন বেজে উঠলো। ধরতেই ও প্রান্ত থেকে খবর সম্পাদক মিজানুর রহমান মিজানের কণ্ঠ। কেমন আছ শাহজাহান? ভাল বলার পর কুশলাদি জেনে ফোন দিলেন অন্য আরেকজনকে। বললেন কথা বল। ও প্রান্ত থেকে যিনি কথা বলছেন তিনি প্রথমেই সালাম দিয়ে বলেন, এই শাহজাহান ভাই, কেমন আছেন, আপনি এখন কোথায়? আপনি কি এখন আসতে পারবেন? অপর প্রান্ত থেকে যিনি কথা বলছেন তিনি যমুনা গ্র“পের চেয়ারম্যান নূরুল ইসলাম বাবুল। আমিও সালাম দিয়ে বললাম, কোথায়? জানতে চাইলাম কেন। বাবুল সাহেব বললেন, প্রয়োজন আছে। জরুরি প্রয়োজন। আমি দৈনিক খবর অফিসে আছি। আমি তখনও রিপোর্ট লিখছি। শেষ না করে বের হওয়া সম্ভব নয়। ইত্তেফাক টিকাটুলি আর খবর অফিস তেজগাঁও। দূরত্ব কম নয়। বাবুল সাহেবকে বললাম, কাল সকালে অফিসে আসি। এখন তো সম্ভব হচ্ছে না। তিনি বললেনÑএখন আসলে ভাল হতো, আচ্ছা যদি না পারেন তবে সকালেই অফিসে আসেন। আর শোনেন, আমি কিন্তু ‘দৈনিক খবর’ কিনে নেব। বড় আকারে বাজারজাত করব। এজন্য কী করতে হবে চিন্তা করেন। রিপোর্ট লেখা নিয়ে বেশি ব্যস্ত ছিলাম, তাই কাজের মধ্যে আমি ঠিক আছে বলে ফোন রেখে দিলাম। রিপোর্ট লেখা শেষ করে বাবুল সাহেবকে ফোন করে জানতে চাইলাম আসলে ঘটনাটা কী। হঠাৎ কেন পত্রিকা প্রকাশের সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি বললেন, বিশেষ কারণ আছে, শীঘ্রই পত্রিকা বের করতে হবে। আপনি সকালে আসেন। তার কাজ জেদের কাজ। বাবুল সাহেবকে যারা চেনেন তারা অবশ্যই জানেন তিনি জেদি মানুষ। এই জেদই যেন তার শক্তি। যা বলেন তা করার চেষ্টা করেন। করেও ফেলেন।

পরদিন ঠিক সকাল ১০টায় আমি বাবুল সাহেবের অফিসে। তখন অফিস ছিল মতিঝিল সেনাকল্যাণ ভবনে। সবসময়ই তিনি সকাল সকাল অফিসে আসেন। তিনি পৌঁছেন আমার আগেই। সে-সময় আমার সাথে তার নিয়মিত যোগাযোগ হতো। রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ইত্যাদি নানা বিষয়ে দীর্ঘ আলোচনা হতো। ইত্তেফাকে যাবার পথে প্রায়ই তার অফিসে যেতাম। একটি দৈনিক পত্রিকা প্রকাশ করবেন আগেও দু-একবার বলেছেন। কিন্তু এত সিরিয়াস ছিলেন না। আমি প্রশ্ন কারলাম, হঠাৎ আপনি এত সিরিয়াস কেন? আর খবরই বা কেন কিনতে যাবেন? পত্রিকা বের করলে নতুন পত্রিকা বের করেন। তিনি বললেন, তাড়াতাড়ি বের করব। কারণ আছে। বললাম, কারণটা কী শুনি।

বাবুল সাহেব যা জানালেন তা অনেকটা এরকম তারই একসময়ের ঘনিষ্ঠ একজন একটি দৈনিক পত্রিকার মালিক-সম্পাদক। মতিঝিলেই অফিস। গতকাল অফিস থেকে ফেরার পথে পূর্ব-আলোচনার ভিত্তিতে সন্ধ্যায় তিনি সেই পত্রিকা অফিসে গিয়েছিলেন। কিন্তু তাকে রিসিপশন থেকে জানানো হয়, মালিক-সম্পাদক অফিসে নেই। এতে বাবুল সাহেব মনঃক্ষুণ হন। সময় দিয়ে না-থাকার বিষয়টি তিনি সহজভাবে নিতে পারেননি। ওই মালিক-সম্পাদকের সাথে তিনি ফোনে কথাও বলেছেন। তার জবাবে তিনি সন্তুষ্ট নন। সেখান থেকেই তিনি সরাসরি খবর অফিসে যান। মিজান সাহেবের সাথে কথা বলে আমাকে ফোন করেন। আগেই বলেছি বাবুল সাহেব জেদি মানুষ। এখন জেদে পত্রিকা করবেন। আমাকে বললেন, আপনি ব্যবস্থা করেন, কীভাবে কী করবেন। আমি বললাম, ডিক্লারেশন নিয়ে নতুন পত্রিকা করা ভাল। পুরানো পত্রিকা চালু করা কঠিন। তিনি রাজি হলেন। এখন প্রশ্ন, সম্পাদক কে হবেন? ভাল একজন সম্পাদক নিতে হবে। যাকে মানুষ চেনে, জানে। সেখানে বসেই সম্ভাব্য সম্পাদকের নাম নিয়ে আলোচনা হলো। আমি একটি নামই বললাম, গোলাম সারওয়ার অর্থাৎ আমাদের সারওয়ার ভাই। ইত্তেফাকের বার্তা সম্পাদক। বাবুল সাহেবের সাথেও তার অল্পবিস্তর পরিচয় ছিল। তিনি বললেন, আপনি কথা বলেন। পরে আমি কথা বলব। আমি ইত্তেফাকের রিপোর্টার, সারওয়ার সাহেব বার্তা সম্পাদক। রাতে অফিসে তিনি খুবই ব্যস্ত থাকেন। কথা বলা সম্ভব নয়। তাই আমি বাবুল সাহেবের সামনে থেকে সারওয়ার সাহেবকে ফোন করি। ও প্রান্ত থেকে ভরাট গলা, শাহজাহান, কী কোনো খবর আছে? আসলে কোনো গুরুত্বপূর্ণ খবর থাকলেই বার্তা সম্পাদককে ফোনে জানাই। তিনি মনে করেছেন হয়তো এমনই কোনো খবর দিব। আমি বললাম, সারওয়ার ভাই এমন কোন গুরুত্বপূর্ণ খবর নেই। তবে আপনার সাথে একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা আছে। আপনি অফিসে কখন আসবেন? তিনি উত্তরা থাকেন। তখন ১১টা। বললেন, আমি রাস্তায় আছি, ১২টার মধ্যে অফিসে আসব। আমিও আসছি বলে টেলিফোন রেখে বাবুল ভাইয়ের সাথে আবার পত্রিকা নিয়ে আলোচনা। বারবার জানতে চাই, সিরিয়াস কি-না। আগেও আলোচনা হয়েছে। পত্রিকা করবেন, আমিও বলেছি সময় নিয়ে করেন। আর বিনিয়োগ করতে হবে বেশ। জনপ্রিয়তা অর্জনও কঠিন। প্রচারসংখ্যা বেশি না থাকলে লাভ হবে না। লোকসান গুনতে হবে। এভাবে তাকে আমি বিভিন্ন সময় নিরুৎসাহিত করতে চেয়েছি। তখন তার পত্রিকা বের করার পেছনে ছিল ভিন্নরকম চিন্তা। যা আমি পরে উল্লেখ করব। আর এখন অন্যরকম। ওই যে বলেছি তার জেদ।

সেনাকল্যাণ ভবন আর ইত্তেফাক কাছাকাছি। বাবুল সাহেবের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমি ইত্তেফাকে পৌঁছে দেখি সারওয়ার সাহেব এসে গেছেন। তার রুমেই আছেন। পত্রিকা দেখছেন। আমিও গিয়ে বসি। ফাইল রেখে জিজ্ঞাসা করলেন, দেশের কী খবর, রাজনৈতিক পরিস্থিতি কী ইত্যাদি। এ বিষয়গুলো নিয়ে টুকটাক কথা হওয়ার পর সারওয়ার সাহেবকে জানাই নতুন একটি পত্রিকা বের হবে। আপনি ইত্তেফাক ছাড়বেন? অনুমতি না নিয়েই আমি আপনাকে সম্পাদক করার প্রস্তাব করেছি। রাজি হলে উদ্যোক্তার সাথে বসতে পারি। জানতে চাইলেন, কারা। বিনিয়োগ করতে পারবে কি-না ইত্যাদি। আমি নাম বলতেই তিনি বললেন, অনেকদিন শুনেছি তিনি পত্রিকা বের করবেন। কেউ একজন আমার সাথে কথাও বলেছিল। পরে আর যোগাযোগ করেনি। বললাম, কয়েকজন সংবাদিকের সাথে তার যোগাযোগ আছে, হয়তো অন্য কারও সাথে আলোচনা করেছিলেন। তবে এখনকার পরিস্থিতি ভিন্ন। সারওয়ার সাহেব বললেন, তোমার সঙ্গে তার সম্পর্ক ভাল জানি। কিন্তু পত্রিকার ব্যবসা আর অন্য ব্যবসা তো এক নয়। কাজেই বুঝে-শুনে নামতে বল। বললাম, তিনি সিরিয়াস। আর বিনিয়োগ সম্পর্কে ধারণা দিয়েছি। বলেছেন সমস্যা হবে না। সারওয়ার সাহেব বললেন, আলোচনা করা যায়। বসতে পারি। কথা বল। সারওয়ার সাহেবের সঙ্গে আগেও একবার বাবুল সাহেবের সাক্ষাৎ হয়েছে। সারওয়ার সাহেবের একটি ব্যক্তিগত কাজে আমিই নিয়ে গিয়েছিলাম। দু’জন কথা শেষ করে আমি বের হয়ে যাই। একটি অ্যাসাইনমেন্ট শেষ করে সন্ধ্যায় আবার অফিসে যাই। তখনও বাবুল সাহেবের সাথে যোগাযোগ হয়নি। রাতে তিনিই ফোন করলেন। জিজ্ঞেস করলেন খবর কী? আমি বললাম কথা বলেছি, কাল সকালে এলে বিস্তারিত আলোচনা করব। জানতে চাইলেন আলোচনা ইতিবাচক কিনা। আমার জবাব মাঝামাঝি। তিনি বললেন, তাড়াতাড়ি করতে হবে। সেদিন এখানেই কথা শেষ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here