‘রিপোর্টার থেকে সম্পাদক’ – (পর্ব-২)

0
431

শাহজাহান সরদার:

আমার লেখা ‘রিপোর্টার থেকে সম্পাদক’ বইটি এই ‘করোনাকালের’ অবসরে ধারাবাহিকভাবে একদিন পর পর পোস্ট করা হবে। আশা করি আপনারা বইটি পড়ে দেশের সংবাদপত্র ও রাজনীতির ভেতরের অনেক খবর জানতে পারবেন।

(পর্ব- ২)

পরদিন সকালে বাবুল ভাইয়ের সাথে তার অফিসে বিস্তারিত আলোচনা হলো। সারওয়ার সাহেবের সঙ্গে কথা বলে বৈঠকের দিন ঠিক করলাম। এরই মধ্যে সম্পাদকের বেতন-ভাতা সুযোগ-সুবিধা কী হতে পারে বাবুল সাহেব জানতে চাইলেন। পত্রিকার পদ-পদবি কী থাকে, বেতন-ভাতা কেমন ইত্যাদি নিয়েও কথা হলো। ঠিক হলো শুক্রবার রাতে বাবুল সাহেবের গুলশানের বাসায় নৈশভোজসহ বৈঠক। আমরা দু’জন আর বাবুল সাহেব। কিন্তু আগের দিন সারওয়ার সাহেব বললেন, মোফাজ্জল হোসেন সাহেবকে নিয়ে যাব। কারণ পত্রিকা বের করতে হলে একজন ভাল জিএম দরকার। মোফাজ্জল সাহেব তখন ইত্তেফাকের জিএম। আমি বললাম ঠিক আছে। সাথে সাথে আমিও বিষয়টি বাবুল সাহেবকে জানিয়ে রাখি। শুক্রবার সন্ধ্যায় আমরা সময় মতো পৌঁছে যাই। বাবুল ভাই ও তার ছেলে শামীম ইসলাম অপেক্ষা করছিলেন। ড্রয়িং রুমে বসতেই ট্রলি ভরে নানা ধরনের স্ন্যাকস্, কোল্ড ড্রিংকস নিয়ে হাজির হলো এক ওয়েটার। সাথে সালমা ইসলাম (বাবুল সাহেবের স্ত্রী)। আমি বাবুল সাহেবের বাসায় আগেও বহুবার গিয়েছি। স্ত্রী-সন্তানসহ নিমন্ত্রণ খেয়েছি। সবসময় দেখেছি সালমা ইসলাম নিজ হাতে খাবার পরিবেশন করতে পছন্দ করেন। তার এই এক গুণ। বাবুল সাহেবের আজকের এই অবস্থানে আসার পেছনে সালমা ইসলামের অবদান অনেক। বাবুল সাহেবও সালমা ইসলামকে ভালবাসেন অন্তর দিয়ে। তিনি আগেই আমাকে বলেছিলেন, পত্রিকার প্রকাশক হবেন সালমা ইসলাম। কেন প্রকাশক করতে চান। এর একটি ইতিহাস আছে। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে সালমা ইসলামকে মহিলা এমপি’র কোটায় এমপি করতে চেয়েছিলেন বাবুল সাহেব। সালমা ইসলাম মনোনয়ন বোর্ডে সাক্ষাৎকারও দিয়েছিলেন। কিন্তু মনোনয়ন পাননি। বাবুল সাহেব ওই সময় আওয়ামী লীগের সমর্থক ছিলেন। লেঃ জেনারেল (অব.) নূর উদ্দিন খানকে আওয়ামী লীগে আনার পেছনে তার বেশ অবদান ছিল। আর নূর উদ্দিন খান যখন নির্বাচনের আগে দুর্ঘটনায় মারাত্মক আহত হয়ে চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে যান বাবুল সাহেবও তখন দৌড়ে যান। তাদের পারিবারিক সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। বাবুল সাহেব আশা করেছিলেন তার স্ত্রী মনোনয়ন পাবেন, কিন্তু পাননি। তাই তিনি আমাকে বলেছিলেন, সালমা ইসলামকে তিনি একটি সম্মানজনক পদে অধিষ্ঠিত করতে চান। যাতে আজীবন তার নাম থাকে। আর এ কারণেই তিনি পত্রিকা বের করবেন এবং প্রকাশক হবেন সালমা ইসলাম। সত্যিই সালমা ইসলাম প্রকাশক হলেন। সম্পাদকও হয়েছিলেন। আবার এমপিও হন। মনোনীত এবং নির্বাচিত দু-ই। ২০১৪-এর অর্ন্তবর্তীকালীন সরকারের মহিলা ও সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করেন। এ দিক দিয়ে বাবুল সাহেবের মনোবাসনা পূর্ণ হয়েছে।

বাবুল সাহেবের বাসায় বৈঠকে কথা শুরু করলাম আমিই। পরে বাবুল সাহেব কেন পত্রিকা প্রকাশ করতে চান সারওয়ার সাহেবকে একটি ব্যাখ্যাও দিলেন। পত্রিকা নিরপেক্ষ হবে, ভালভাবে চালাতে হবে এবং এক নম্বর পত্রিকা হতে হবে। বিনিয়োগে কোনো সমস্যা হবে না। দীর্ঘক্ষণ আলোচনা। খুঁটিনাটি অনেক বিষয় কথা হলো। সারওয়ার সাহেব মোটামুটি রাজি হলেন। আমার ওপর দায়িত্ব পড়ল আলোচনা করে বেতন-ভাতা, সুযোগ-সুবিধা ইত্যাদি ঠিক করা। বৈঠকে মোফাজ্জল সাহেবও উপস্থিত ছিলেন। এবার তাকে নিয়ে আলোচনা। মোফাজ্জল সাহেব নতুন পত্রিকায় যাবেন কিনা জানতে চাইলে বলেন, আগামী সপ্তাহে গ্রামে গিয়ে তার মায়ের সাথে আলোচনা করে জানাবেন। তারপর আলোচনায় এলো অফিস কোথায় হবে। মতিঝিল, ধানমন্ডি আর কারওয়ান বাজার এলাকাকে প্রাধান্য দিলেন সবাই। আন্তরিক আলোচনা ও সুস্বাদু নৈশভোজ শেষে পরের সপ্তাহে আবার আলোচনার দিনক্ষণ ঠিক করে বিদায় নিই। রাস্তায়ই বাবুল সাহেব ফোন দিলেন সকালে তার অফিসে যাবার জন্য। সেই রাতে সারওয়ার সাহেবের সাথে আর কোনো কথা হয়নি। পরদিন সকালে আবার সেনাকল্যাণ ভবন। বাবুল সাহেব আর আমি আলোচনা করি সারওয়ার সাহেবের বেতন-ভাতা আর অফিস নিয়ে। তিনি আমার কাছে জানতে চান, সারওয়ার সাহেবের সাথে রাতে আর কথা হয়েছে কি-না? আমি বলি, না। এবার জানতে চান, তিনি আসবেন তো? আমি বললাম তিনি নিজেইতো আপনাকে বলেছেন। কথা শেষ করে সেনাকল্যাণ ভবন থেকে বের হয়ে আমি ইত্তেফাকে যাই। সারওয়ার সাহেব এরই মধ্যে এসে গেছেন অফিসে। পত্রিকার ফাইল নিয়ে বসছেন। আমি সামনে গিয়ে বসি। জানতে চাইলাম, এখন সামনে কীভাবে অগ্রসর হব। তিনি বললেন, বাবুল সাহেব সিরিয়াস তো? তুমি আরও বুঝ। সাতদিন সময় আছে। আমি বললাম, সকালে তার অফিসে গিয়েছিলাম। তিনি আপনার সাথে কথা বলে সব ঠিকঠাক করতে বলেছেন। আমি যতটুকু তাকে জানি, তিনি যা বলেন তা করেন। শুক্রবারের বৈঠকেই চুক্তি করতে চান। আপনার প্রত্যাশা জানতে চেয়েছেন। সারওয়ার সাহেব একটা ধারণা দিলেন। আর বললেন, পত্রিকায় সব নিয়োগ হবে কিন্তু সম্পাদকের পছন্দমতো। আমি বললাম, এসব বিষয়ে অসুবিধা হবে না। যাহোক পরদিন আবার বাবুল সাহেবের অফিসে। দু’জনের সঙ্গে কথা বলে বেতন-ভাতা, সুযোগ-সুবিধার বিষয়টি চূড়ান্ত হলো। এবার বললাম, পত্রিকার সাংবাদিকসহ সব নিয়োগ কিন্তু সম্পাদকের মাধ্যমে হয়ে থাকে। বাবুল সাহেব জানান, তিনি একটি পিওনও দেবেন না। পত্রিকা চালাবেন সম্পাদক। বলেন, আমি চাই পত্রিকার প্রচার ও জনপ্রিয়তা। এখানে একটি কথা বলে রাখি, বাবুল সাহেব কিন্তু সারওয়ার সাহেবকে দেয়া এ কথা ঠিক রেখেছিলেন। পত্রিকার প্রতিষ্ঠাপর্বে তিনি কোনো সাংবাদিক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগের জন্য পাঠাননি।

শুক্রবারে আমাদের ফাইনাল বৈঠক। বৃহস্পতিবারের মধ্যে চুক্তিপত্র তৈরি করা হলো। সারওয়ার সাহেব যেভাবে বলেছেন সেভাবেই। কথামতো রাতে আবার বাবুল সাহেবের বাসায় যাই আমরা। মোফাজ্জল সাহেবও আছেন। বাবুল সাহেব তাকে জিজ্ঞেস করলেন, দেশে গিয়েছিলেন, আপনার মা’র সাথে কথা হয়েছে? মোফাজ্জল সাহেব বললেন, যেতে পারিনি। আগামী সপ্তাহে যাব। বাবুল সাহেব বললেন, আইসা যান ভাল হবে। একসাথে সবাই মিলে ভাল পত্রিকা করেন। বাবুল সাহেব ও সারওয়ার সাহেব দু’জনের মাঝে আমি বসা। বাবুল সাহেব চুক্তিপত্রটি আমার হাতে তুলে দিলেন। আমি সারওয়ার সাহেবকে দিলাম। তিনি মনোযোগ দিয়ে সবকিছু দেখলেন। পড়া শেষ করে কানে কানে আমাকে বললেন, আজকাল তো কোনো কোনো সম্পাদককে শেয়ার দেয়া হচ্ছে। আমাকেও কিছু শেয়ার দেয়া যায় কিনা। আমি একটু বেকায়দাই পড়লাম। কেননা এর আগে শেয়ার বিষয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। আমি একটু চিন্তিত হলাম। দু’জনের কথার মধ্যে বাবুল সাহেব জানতে চান, সমস্যা কী, সারওয়ার ভাই কী বলেন? আরো কিছু করতে হবে? আমি খুলেই বললাম, এরইমধ্যে যেসব পত্রিকা বের হয়েছে এগুলোতে সম্পাদকদের কিছু শেয়ার দেয়া হয়েছে। এ-কথাই বলছেন সারওয়ার ভাই। সাথে সাথে বাবুল ভাই বললেন, ঠিক আছে। আপনি ঠিক করেন। এখনই ঠিক করেন। চুক্তিপত্রে লিখে দেন। আমি সই করে দিয়েছি। পরে সম্পাদককে কিছু শেয়ার দেয়ার শর্ত রেখে চুক্তিপত্র স্বাক্ষর হলো।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here