‘রিপোর্টার থেকে সম্পাদক’ – (পর্ব- ১১)

0
103

শাহজাহান সরদার:
আমার লেখা ‘রিপোর্টার থেকে সম্পাদক’ বইটি এই ‘করোনাকালের’ অবসরে ধারাবাহিকভাবে একদিন পর পর পোস্ট করা হবে। আশা করি আপনারা বইটি পড়ে দেশের সংবাদপত্র ও রাজনীতির ভেতরের অনেক খবর জানতে পারবেন।

(পর্ব- ১১)

এক দুপুর। আমি, আমার স্ত্রী, মেজো ছেলে ও ছোট ছেলে খাবার টেবিলে। এমন সময় মোবাইল ফোন বেজে ওঠে। নাম্বারটা পরিচিত। আমারই এক জুনিয়র স্নেহাস্পদ সাংবাদিক বন্ধু। আমি ধরতে ধরতে লাইনটি কেটে গেল। পরে খাবার শেষ করে তাকে ফোন করলাম। তিনি ধরলেন। বললেন, শাহজাহান ভাই আপনি কোথায়? বললাম বাসায়। তিনি বললেন, আমি শাহ আলম সাহেবের অফিস থেকে আপনাকে ফোন করেছিলাম। তিনি আপনার সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিলেন। এখন আমি বেরিয়ে আসছি। হয়তো আপনাকে ফোন করবেন। তার নাম্বারটা রাখেন। আর আপনিও ফোন করতে পারেন। আমি জানতে চাইলাম, কেন? সাংবাদিক বন্ধু বললেন, তিনি আপনাকে বলবেন। শাহ আলম সাহেব হলেন বসুন্ধরা গ্র“পের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান (শাহ আলম)। তার সাথে আগে কখনো কথা হয়নি, দেখাও হয়নি। তিনি কেন আমাকে খুঁজছেন। তখন বসুন্ধরা গ্র“প দৈনিক পত্রিকা বের করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। পান্থপথের বসুন্ধরা সিটির বেজমেন্টে অফিস। আবেদ খান সম্পাদক। বিশাল আয়োজন। আমি মনে মনে ভাবলাম আমাকে কেন খুঁজছেন। যাহোক, খাবার সেরে শাহ আলম সাহেবের মোবাইলে কল দিলাম। ধরলেন নিজেই। পরিচয় দিলাম। তিনি স্বভাবসুলভ কণ্ঠে বললেন, ভাই কেমন আছেন। আমি বললাম, ভাল। তিনি জানতে চাইলেন, আপনি এখন কোথায়? আমি বললাম বাসায়, ধানমন্ডি। তিনি বললেন, আমার অফিসে এখন আসতে পারবেন? আমি আছি। কথা আছে, সামনাসামনি বলা ভাল। বললাম, আপনি কোথায়? বললেন, পান্থপথের বসুন্ধরা সিটির অফিসে। আমি আসছি বলে টেলিফোন রেখে বের হলাম। আমার সারাজীবনের রুটিনে দুপুরে খাবার খেয়ে একটু বিশ্রাম। এদিন ব্যত্যয় ঘটল। দুপুর তিনটার দিকে শাহ আলম সাহেবের অফিসে পৌঁছলাম। খবর দিলাম আমি এসেছি। সাথে সাথে ভিতরে ডেকে নিলেন। তখন তার সামনে আরেকজন কে বসা ছিলেন। আমি প্রবেশের পর তিনি বিদায় নিলেন।

শাহ আলম সাহেবের সাথে এ প্রথম আমার দেখা এবং কথা। ব্যক্তিগত কুশলাদি জানার পর সোজাসুজি বললেন, আপনি আমার কাগজে যোগদান করেন। তার কাগজ মানে দৈনিক কালের কণ্ঠ। তখন প্রকাশের উদ্যোগ চলছে। আমি যতটুকু জানি লোকবল নিয়োগ প্রায় সম্পন্ন। ওয়ান ইলেভেনের সময় দীর্ঘদিন শাহ আলম সাহেব পরিবার-পরিজন নিয়ে দেশের বাইরে ছিলেন। এ সময় বসুন্ধরা গ্র“প নিয়ে বিভিন্ন পত্রিকায় অনেক নিউজ হয়েছে। তার বেশ কিছু ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ওপরও সে সময় পারিবারিক নিয়ন্ত্রণ ছিল না। সরকারি কোষাগারেও বিপুল অংকের টাকা জমা দিতে হয়। এ অবস্থায় বিদেশে থেকেই তিনি পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগ নেন। আমি যতটুকু জানি, গোলাম সারওয়ারকে তখন পত্রিকা প্রকাশের দায়িত্ব দেয়া হয়। তিনি কয়েক মাস বসুন্ধরায় কাজও করেন। কিন্তু সারওয়ার সাহেব যে পত্রিকাটি বের করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন সেটি আর বের হয়নি। সারওয়ার সাহেবও সেখানে থাকেননি। নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় আসার পর শাহ আলম সাহেব ও তার পরিবার পরিজন দেশে ফিরে আসেন। এসেই একটি বাংলা এবং একটি ইংরেজি পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগ নেন। এবার সম্পাদক হয়ে আসেন আবেদ খান। আর পত্রিকার নাম দৈনিক কালের কণ্ঠ। সারওয়ার সাহেব কেন থাকলেন না, আর আবেদ সাহেব কীভাবে এলেন সেটি আমি তখনো জানতাম না। পরে শুনেছি। সে বিষয়ে পরে আসছি। আমি শাহ আলম সাহেবের কাছে জানতে চাই, আমার পদ কী হবে। তিনি বললেন আপনি নির্বাহী সম্পাদক পদে যোগদান করেন। যুগান্তরে আমি উপ-সম্পাদক ছিলাম। সে সময় সম্পাদকের পরেই উপ-সম্পাদকের স্থান ছিল। কিন্তু নতুন ওয়েজ বোর্ডে সম্পাদকের পরেই নির্বাহী সম্পাদক। সে হিসাবে আমার জন্য পদ ঠিক আছে। আমি বললাম, আবেদ সাহেব সম্পাদক। তিনি কি বিষয়টি জানেন? শাহ আলম সাহেব বললেন, এখনো জানাইনি। আপনি রাজি থাকলে আমি মহিউদ্দিনকে বলে দিচ্ছি। এই মহিউদ্দিন হলেন তারই নিকটাত্মীয় ও কালের কণ্ঠের তৎকালীন প্রকাশক এবং প্রধান সম্পাদক। এখন নিজেই বাংলাদেশের খবরসহ কয়েকটি সংবাদপত্র প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছেন। আমি বললাম, আবেদ সাহেব রাজি থাকলে আমার যোগদানে সমস্যা নেই। আসলে সে সময়তো আমি বেকারই ছিলাম। চাকরির প্রয়োজনও ছিল। তিনি জানতে চাইলেন, বেতন-ভাতা কত দিতে হবে। আমি বললাম। আমার কথা শুনে তিনি মহিউদ্দিন সাহেবকে ফোনে ধরলেন। আমার নাম করে বললেন, তার সাথে আমার কথা হয়েছে। তিনি যেন কথা বলেন, পদের নামও বললেন।

এ মহিউদ্দিন সাহেব ওয়ান ইলেভেনের সময় বেশ কিছুদিন কারান্তরীণে ছিলেন। শাহ আলম সাহেবকে প্রথম দেখায়ই ধীর-স্থির এবং সিদ্ধান্তে অবিচল মনে হয়েছে। আরো কিছুক্ষণ দেশ, রাজনীতি এসব নিয়ে কথা হলো। ঘণ্টাখানেক পর তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ফিরে আসি। মাঝে দু’দিন আর কোনো কথা-বার্তা নেই। তৃতীয়দিন খবর পেয়ে আবার তার অফিসে যাই। কিছু আলোচনা হলো। কিন্তু মহিউদ্দিন সাহেব আমার সাথে আর যোগাযোগ করেননি। আমিও করিনি। এভাবে আরো কয়েকদিন গেল। কালের কণ্ঠে যোগদানের বিষয়ে কোনো অগ্রগতি নেই। নানা দিক থেকে নানা খবর আসছিল। এরই মধ্যে এক বিকেলে আমি হাজির হলাম শাহ আলম সাহেবের অফিসে। আমাদের মধ্যে বেশকিছু কথা হলো। মূলকথা কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। এরপর বেশ কিছুদিন যোগাযোগ থাকে না। নানা মাধ্যমে আমি জানার চেষ্টা করি রহস্যটা কি! শাহ আলম সাহেবের সাথে ঘনিষ্ঠ কয়েকজনের সাথেও কথা হয়। জানলাম সমস্যা ভিতরেই। কিছুদিন পর শাহ আলম সাহেবের অফিস থেকে ফোন পেলাম দেখা করার জন্য। দেখা করতে গেলাম। জানলাম সব। তিনি আমাকে বসুন্ধরা গ্র“পের উপদেষ্টা হিসেবে যোগদানের জন্য পরামর্শ দিয়ে বলেন, সময়মতো অন্য ব্যবস্থা নেয়া হবে। তার কথামতো ২০০৯ সালের ১ জুন আমি বসুন্ধরা গ্র“পের উপদেষ্টা হিসেবে যোগ দেই। বসুন্ধরা গ্র“পের প্রধান কার্যালয় ততদিনে বসুন্ধরা সিটি থেকে বারিধারা বসুন্ধরায় স্থানান্তর করা হয়েছে। বসুন্ধরার দেয়া গাড়িতে চলাচল করি। বেতনভাতা সবই আছে। কিন্তু কাজ নেই। পনেরো দিন, মাসে একবার বসুন্ধরায় গিয়ে হাজিরা দিই। সময় যেতে থাকে। এমনিভাবে প্রায় ছয় মাস চলে যায়। বন্ধু-বান্ধবরা জিজ্ঞাসা করে কোথায় কী করছি। কাউকে বলি, কাউকে বলি না। এর মধ্যে একরাতে শাহ আলম সাহেবের ফোন। পরদিন শুক্রবার সকালে তার বাসায় যেতে বললেন। আমি সকাল পৌনে ১০টায় বারিধারার কাছাকাছি পৌঁছলে সেই মহিউদ্দিন সাহেব ফোন করে জিজ্ঞাসা করলেন কোথায় আছি। বললাম গুলশানের কাছাকাছি। তিনি বললেন, আপনি এদিকে না এসে বসুন্ধরা সিটির কালের কণ্ঠ অফিসে চলে যান। আমি আর চেয়ারম্যান সাহেব আসছি। চেয়ারম্যান সাহেব মানে শাহ আলম সাহেব। আমি ফিরে এলাম কালের কণ্ঠ অফিসে। এর আগে আমি এ অফিসে যাইনি। সুন্দর করে সাজানো। বেশ খরচ করা হয়েছে মনে হয়। কনফারেন্স রুমটিও চমৎকার। এখানেই বসানো হলো আমাকে। কিছুক্ষণ পর এলেন শাহ আলম সাহেব এবং মহিউদ্দিন সাহেব। দেখে মনে হলো বড় একটি সভার প্রস্তুতি চলছে। এ সভায় অন্য যারা ছিলেন সবাই কালের কণ্ঠে যোগ দিয়েছেন। তারা পুরানো, আমি বাইরের। আমাকে দেখে কেউ কেউ চমকে উঠলেন। সভা শুরু হলো। পরিচয়পর্বে বসুন্ধরা গ্র“পের উপদেষ্টা হিসাবে আমি পরিচয় দিলাম। তখনো কালের কণ্ঠ বাজারে আসেনি। পত্রিকা প্রকাশ, বাজারজাতসহ প্রকাশে বিলম্বের বিষয় নিয়ে আলোচনা হলো। জুমার নামাজের আগেই সভাটি শেষ হলো। আমি ফিরে আসার আগে মহিউদ্দিন সাহেব বললেন, আপনি এ অফিসেই বসবেন। কাল আসেন, আপনার রুম ঠিক করে দেয়া হবে।ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ওয়াহেদ তখন কালের কণ্ঠের প্রশাসনের দায়িত্বে। তাকে বললেন সব ব্যবস্থা নিতে। পরদিন আমি গেলাম। ওয়াহেদ সাহেবের সাথে তার রুমে দীর্ঘক্ষণ আলোচনা হলো। তিনি রুম দেখালেন। চেয়ার-টেবিল আনার জন্য একজনকে নির্দেশ দিলেন। নেমপ্লেটের জন্য বললেন। আমি দুপুরে বাসায় ফিরে আসি। বিকেলে ওয়াহেদ সাহেব ফোন করলেন। বললেন, শাহজাহান ভাই আপনার রুম তৈরি হতে একটু দেরি হবে। রুম তৈরি হলে আমি আপনাকে জানাবো। এভাবে চলে গেলো আরো কিছু দিন। এক শুক্রবার সকালে আমি বনানীতে আমার খুবই ঘনিষ্ঠ এক রাজনৈতিক নেতার বাসায় যাই। তিনি আগেও মন্ত্রী ছিলেন এখনো মন্ত্রী। তবে সে-সময় মন্ত্রী ছিলেন না। তার বাসায় আমি প্রায়ই যাতায়াত করি। দেশ, রাজনীতিসহ বিভিন্ন বিষয়ে জানার আগ্রহ থেকেই নিয়মিত যাতায়াত। সবসময় যাওয়ার আগে টেলিফোন করে জেনে নেই বাসায় আছেন কি-না। সে দিনও তাকে জানিয়েই যাই। গিয়ে দেখি সারওয়ার সাহেব কথা বলছেন। সারওয়ার সাহেব মানে সম্পাদক গোলাম সারওয়ার। গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা ভেবে আমি কয়েক মিনিট অন্য একটি রুমে বসি। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওই নেতা বাইরে এসে আমাকে ভেতরে নিয়ে গেলেন। সারওয়ার সাহেবের সঙ্গে একসাথে বসেই চা-মিষ্টি খেলাম। তারপর সারওয়ার সাহেব বিদায় নিলেন। বড়ভাইসম নেতা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কী করছ? তিনি আগেই জানেন আমার অবস্থা। তবুও প্রতিবার জিজ্ঞেস করেন। আমি উত্তর না দিয়ে জানতে চাইলাম সারওয়ার সাহেব কেন এসেছিলেন? তার কাছ থেকে জানলাম সারওয়ার সাহেবের সমস্যা। সারওয়ার সাহেব বসুন্ধরা গ্র“পের পত্রিকা বের করার জন্য কাজ শুরু করেছিলেন। একথা আগেই উল্লেখ করেছি, কিন্তু পরে থাকেননি। কেন থাকেননি বা থাকতে পারেননি তা ওই নেতার কাছ থেকে জানলাম। তাকে জানিয়ে গেলেন সারওয়ার সাহেব। সেটি হচ্ছে, সারওয়ার সাহেব যখন কাজ শুরু করে পত্রিকা প্রকাশের ব্যাপারে অনেকটা এগিয়ে যান, তখন শাহ আলম সাহেব বিদেশে থেকেই তাকে জানান, আপাতত তিনি পত্রিকা প্রকাশ করতে পারছেন না। দেশে এসে উদ্যোগ নেবেন। এ সম্পর্কে আমি পরে আরো অনেক কিছু শুনেছি। আমি বিস্মিত হলাম। পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগ নিয়ে প্রকাশ না করার পিছনে রয়েছে সারওয়ার সাহেব প্রতিষ্ঠিত একটি পত্রিকার মালিক। শাহ আলম সাহেব তখন দেশের বাইরে। ব্যবসা বাণিজ্য বন্ধ। পুরো পরিবারই বিপদগ্রস্ত। তাই শুনতে হয়েছে ওই মালিকের কথা। আমি যা শুনলাম তা হলো, ওই মালিক সারওয়ার সাহেবকে তার পত্রিকায় না নেয়ার জন্য বলে এও জানিয়ে দিয়েছেন যে, যদি সারওয়ার সাহেবকে সম্পাদক করে পত্রিকা প্রকাশ করেন তাহলে তার পত্রিকায় বসুন্ধরা গ্র“পের বিরুদ্ধে অব্যাহতভাবে লিখে যাবে।

বিস্ময় নিয়েই ফিরে এলাম। এদিকে আমারও কালের কণ্ঠে আর যোগদান হলো না। এরই মধ্যে এ পত্রিকাটি বাজারজাতের প্রক্রিয়া শুরু হয়। একই সঙ্গে বসুন্ধরা গ্র“পের ইংরেজি পত্রিকা ডেইলি সান প্রকাশের উদ্যোগ নেয়া হয়। ডেইলি সানে প্রথম সম্পাদক হয়ে আসেন হাসান শাহরিয়ার। সহযোগী সম্পাদক জগলুল আহমেদ চৌধুরী। পত্রিকা প্রকাশের আগেই হাসান শাহরিয়ার পদত্যাগ করেন। বিদায় নিয়ে আসেন জগলুল আহমেদ চৌধুরীও। পরবর্তীতে ডেইলি সানের সম্পাদক হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন। এর মধ্যে শাহ আলম সাহেব একদিন তার বাসায় যেতে খবর দিলেন। এক দুপুরে গেলাম তার বাসভবনে। মধ্যাহ্নভোজসহ আলোচনা হলো। আমাকে জানালেন দৈনিক ভোরের ডাক নামের পত্রিকাটি তিনি ভালভাবে চালাতে চান। কম পৃষ্ঠা কম মূল্যের এই দৈনিকটি ভালভাবে চালানো যায় কিনা আপনি ভেবে দেখেন। আমি বললাম এ পত্রিকা তো আপনার নয়, অন্যজনের। আমি তো বসুন্ধরা গ্র“পের কাগজে কাজ করার জন্য এসেছি। আর আমি সবসময় বড় কাগজে কাজ করেছি। এখন যদি ভোরের ডাকে যাই তাহলে অনেকটা পেশাগত অবনতি হয়। তিনি বললেন, এতে অসুবিধা নেই। ভোরের ডাকের মালিক আমার কথার বাইরে যাবে না। আর আপনি ও আমরা চেষ্টা করলে এটিও বড় কাগজ হতে পারে। বসুন্ধরা গ্র“পের সব প্রতিষ্ঠানই ভাল চলে। আমাদের সহযোগিতা থাকলে ভোরের ডাকও ভাল চলতে পারে। আপনি রাজি থাকলে কাল বেলায়েত সাহেবকে আসতে বলি। আমি জানালাম সম্পাদক করা হলে আমি চিন্তাভাবনা করতে পারি। তিনি বললেন, অসুবিধা হবে না। আমি বলে দিব। বেলায়েত সাহেব মানে ভোরের ডাক সম্পাদক ও মালিক বেলায়েত হোসেন। বিভিন্ন সংবাদপত্র যখন বসুন্ধরা গ্র“পের বিরুদ্ধে লেখালেখি করছিল ভোরের ডাকে তখন বসুন্ধরার পক্ষ হয়ে কাজ করেছে। আমি যখন যুগান্তরে তখন মাঝে মধ্যে বসুন্ধরার বিরোধী খবর ছাপা হতো। তখন ভোরের ডাক যুগান্তরের মালিকের বিরুদ্ধে অনেক লেখালেখি করেছে। সে সময় দু’একবার ভোরের ডাক পত্রিকা দেখেছি। আর বেলায়েত সাহেব আমার পূর্বপরিচিত ছিলেন। রিপোর্টাস ইউনিটির সভাপতি নির্বাচনের সময় ভোটের প্রচারনায় কয়েকবার তার তোপখানা রোডের অফিসে গিয়েছি। বেলায়েত সাহেবের সাথেও দেখা হয়েছে। কথাবার্তায় বেশ ভদ্র-বিনয়ী। শাহ আলম সাহেবের কথা আমি ফেলতে পারিনি। বললাম, ঠিক আছে কাল আমরা বসি। সম্মতি দিলে তিনি বেলায়েত সাহেবকে ফোনে পরদিন আসতে বললেন।

শাহ আলম সাহেবের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠেই ভোরের ডাকে কাজ করছে আমার চেনা-জানা এমন একজনকে ফোন করি। তার কাছ থেকে জানতে পাই শাহ আলম সাহেব ভোরের ডাককে নিয়মিতভাবে সহায়তা দিয়ে আসছেন। পরদিন সকালে আমি আবার বসুন্ধরায় শাহ আলম সাহেবের বাসায় যাই। আমি পৌঁছার আগেই বেলায়েত সাহেব পৌঁছে গেছেন। রুমে আমরা তিনজন। শাহ আলম সাহেব কথা শুরু করলেন। বেলায়েত সাহেবকে বললেন, ভোরের ডাক ভালভাবে চালাতে হলে কী করতে হবে। বেলায়েত সাহেব তার কথা বললেন। শাহ আলম সাহেব জানালেন, শাহজাহান ভাই ভোরের ডাকে সম্পাদক হবেন এবং আপনি প্রকাশক থাকবেন। ভালভাবে কাগজ চালাতে হবে। এর জন্য কী কী করা দরকার আপনারা মিলে ঠিক করেন। পত্রিকা ভাল করতে হবে এবং সার্কুলেশন বাড়াতে হবে। আমি প্রয়োজনীয় সব সহযোগিতা করব। বেলায়েত সাহেব বললেন, শাহজাহান ভাই এলে তো খুবই ভাল হয়। আর আপনার সহযোগিতা এখনও পাচ্ছি, আরও পেলে ভোরের ডাক বড় কাগজ হয়ে যাবে। আমাদের বৈঠকে স্থির হলো পরদিন আমি আর বেলায়েত সাহেব অফিসে বসে প্রাথমিক আলাপ-আলোচনা করব। কথামতো পরদিন সকালে বেলায়েত সাহেবের অফিসে বসি। আগেই আমার জন্য চা-নাস্তা তৈরি। কথা শুরু হলো। কীভাবে কী করা যায়। আমি বললাম মাস্ট হেড বদলাতে হবে। অফিস নিতে হবে আরো বড়। নতুন সাংবাদিক কর্মচারী আনতে হবে। আর প্রয়োজন নিজস্ব প্রেস। বেলায়েত সাহেব রাজি হলেন। তবে তিনি এগুলোর কিছু করতে পারবেন না। বসুন্ধরাকে করে দিতে হবে। তিনি বললেন, আপনি আলোচনা করেন। আমি বললাম, ঠিক আছে। আলোচনার প্রথম থেকেই বেলায়েত সাহেবকে অস্থির অস্থির লাগছিলো। একফাঁকে হঠাৎ করে তিনি অত্যন্ত আবেগতাড়িত হয়ে বলেন, ‘শাহজাহান ভাই, আমি আপনাকে শ্রদ্ধা করি। আপনি বড় সাংবাদিক। ভোরের ডাকের সঙ্গে আপনি সম্পৃক্ত হবেন এটি আমার জন্য খুবই ভাগ্যের বিষয়। আপনার কাছে আমার অনুরোধ আপনি সম্পাদক না হয়ে প্রধান সম্পাদক পদটি গ্রহণ করুন। তার আকুতিতে আমি বিব্রত হই। কথার ব্যত্যয় আমি পছন্দ করি না। তাই আমি তাকে জিজ্ঞেস করি, আপনি শাহআলম সাহেবকে বলে এসে এখন অন্যরকম বলছেন কেন?’ তিনি বললেন, তখন আমি ‘না’ বলতে পারিনি। এখন আপনাকে অনুরোধ করছি। আপনি দয়া করে আমার অনুরোধ রক্ষা করলে আমি সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকবো। পরিস্থিতি আমার কাছে খুব ভাল মনে হলো না। আমি জানালাম, শাহ আলম সাহেবের সঙ্গে আলোচনা না করে এখনই আপনাকে কথা দিতে পারি না। ভোরের ডাক অফিস থেকে বের হয়ে আমি শাহ আলম সাহেবকে ফোন করে জানালাম। তিনি পরদিন যেতে বললেন। আবার শাহআলম সাহেবের বাসায়। তাকে বিস্তারিত জানালাম। বেলায়েত সাহেবের অস্থিরতার কথাও। অবস্থা জেনে শাহ আলম সাহেব নিজেও বিব্রত। আমি বললাম, ঠিক আছে বেলায়েত সাহেব যখন এত করে বলছে প্রধান সম্পাদক হতে আমার আপত্তি নেই। তবে অফিস পরিবর্তন আর প্রেস ছাড়া ভাল পত্রিকা হবে না। তোপখানার অফিসে চলবে না। আর ভাল সাংবাদিক নিতে হবে। আপনি অফিসের ব্যবস্থা করেন। নতুন অফিস হলেই আমি বসব এবং কাজ শুরু করব। তিনি বললেন, ঠিক আছে আমি অফিসের ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। আর নতুন প্রেসও আসবে। তিনি একজনকে ফোন করে বললেন, মগবাজার এলাকায় আমাকে একটি ভবন দেখাতে। ওখানেই অফিস হবে। আর বললেন, আপনি পরিকল্পনা করেন কীভাবে করা যায়। অফিস না হওয়া পর্যন্ত মাঝে মধ্যে খোঁজখবর নিতে থাকেন। অফিস হলেই বসা শুরু করবেন।পরদিন বসুন্ধরার এক ইঞ্জিনিয়ার মগবাজার রেলক্রসিং এর পূর্বপার্শ্বে গলি থেকে ভিতরে একটি বাড়ি দেখাতে নিয়ে গেলেন। বাড়িটি তখন পরিত্যক্ত। আগে এ বাড়িতে ইংরেজি দৈনিক নিউজ টুডে’র অফিস ছিল। এখন নেই। একটি ৮ পৃষ্ঠার লক্কর ঝক্কর প্রেস আছে। বড় সমস্যা ট্রাক আসা-যাওয়া। ট্রাক না গেলে নিউজপ্রিন্ট আনা-নেয়া সমস্যা। প্রাইভেট কারও গলিতে আটকে যায়। কিন্তু একথা সত্য এখানে একটি ছোট প্রেস আছে। আগে একটি দৈনিক পত্রিকার অফিস ছিল। এসব চিন্তা করে এখানেই অফিস করতে রাজি হলাম। পরদিন বেলায়েত সাহেবকেও নিয়ে গেলাম। তিনি বারবার শুধু আমাকে বলছেন, অফিস না বদলাতে। তোপখানা রোডের অফিসই তিনি বড় করবেন। আশপাশের কয়েকটি রুম ভাড়া নিবেন ইত্যাদি। আমি বলি, ভাল অফিস, প্রেস এবং ভাল সাংবাদিক না হলে ভালভাবে পত্রিকা চালানো যাবে না। শাহ আলম সাহেবকে জানালাম, অসুবিধা নেই মগবাজারেই অফিস করা যাবে। তিনি তার সংশ্লিষ্ট বিভাগকে প্রয়োজনীয় মেরামত করার ও আসবাবপত্র কেনার নির্দেশ দিলেন। শুরু হলো নতুন অফিসের কাজ। পুরানো বাড়ি মেরামতেই চলে যায় দুইমাস। তারপর ডেকোরেশন। আমি মাঝে মধ্যে গিয়ে দেখি কাজের অগ্রগতি। এর মধ্যে আমি নিজে ভোরের ডাকে একজন নির্বাহী সম্পাদক এবং একজন নগর সম্পাদককে নিয়োগ দিই। কিন্তু আমি অফিসে যাই না। তারা কাজ শুরু করেন। কাগজ আগের চেয়ে ভাল হচ্ছে। অনেকে জেনে যায় আমি ভোরের ডাকের সাথে সংশ্লিষ্ট। বিভিন্ন রকমের কথাবার্তা আমার কানে আসে। বেলায়েত সাহেবের সাথে দেখা হলেই অফিস পরিবর্তন না করতে অনুরোধ করেন। একদিন প্রস্তাব দিয়ে বসেন আমি যেন তার সাথে যুক্ত হয়ে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে ভোরের ডাক চালাই। আবার আমি বিব্রত। শাহ আলম সাহেবের অবস্থান এবং তার অবস্থানে আমি বিস্তর তফাৎ লক্ষ্য করি। শাহ আলম সাহেব অফিস করে দিয়েছেন। প্রেসের অর্ডার দিয়েছেন, আর্থিক সহায়তা দিচ্ছেন আর বেলায়েত সাহেব এ-সবই গ্রহণ করছেন। অথচ আবার নিজ নিয়ন্ত্রণে ভোরের ডাক চালাতে চান। আমি বিষয়টি শাহ আলম সাহেবকে জানাই। এ অবস্থায় তিনি আমাকে ভোরের ডাকে না যেতে পরামর্শ দেন। আমি যোগাযোগ বন্ধ করে দেই। এরই মধ্যে ভোরের ডাক অফিস মগবাজারে এসে গেছে। আমার জন্য যে রুমটি করা হয়েছিল সেটাতে বেলায়েত সাহেব বসেন। তিনি আবার তোপখানার অফিসেও বসেন। নিউজ, সার্কুলেশন ছাড়া বাকি বিভাগগুলোর মূল কাজ তোপখানায়ই হয়। ভোরের ডাকের সাংবাদিকরা আমাকে ফোন করে জানতে চান কবে আসব। আমি তাদেরকে বলি আশা করি কিছুদিনের মধ্যেই। এ ভাবে কয়েকদিন কেটে গেল।

বইটি সংগ্রহ করতে চাইলে অর্ডার করুন #www.rokomari.com/utso
#www.porua.com.bd
#www.boimela.com

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here