‘রিপোর্টার থেকে সম্পাদক’ – (পর্ব- ১৯)

0
98

শাহজাহান সরদার:
আমার লেখা ‘রিপোর্টার থেকে সম্পাদক’ বইটি এই ‘করোনাকালের’ অবসরে ধারাবাহিকভাবে একদিন পর পর পোস্ট করা হবে। আশা করি আপনারা বইটি পড়ে দেশের সংবাদপত্র ও রাজনীতির ভেতরের অনেক খবর জানতে পারবেন।

(বইটি ২০১৮ সালের অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রকাশিত হয়)

(পর্ব- ১৯)

টানা তিন দশক রিপোর্টার হিসাবে কাজ করেছি। এ সময় রাজনীতির অনেক উত্থান-পতন হয়েছে। অনেক ঘটনার নীরব সাক্ষীও আছি। আবার অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে রিপোর্ট করেছি। রিপোর্ট নিয়ে অনেক আলোচনা-সমালোচনাও হয়েছে। অনেক স্মৃতি আছে। দুঃখ-বেদনা-আনন্দ আছে। সেগুলো এক বইয়ে লিখে শেষ করার মতো নয়। রিপোর্টার হিসেবে নেয়া আমার এমন কয়েকটি সাক্ষাৎকার এবং কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা এখানে উল্লেখ করলাম।

এক.
এরশাদ জামানার ১৯৮৬ সালের নির্বাচন নিয়ে অনেক ধরনের আলোচনা-সমালোচনা আছে। সব ধরনের আলোচনায় একটা বিষয় স্পষ্ট যে, স্বৈরাচারের ছকেই সেই নির্বাচন হয়েছিল। দুই জোট যতই আন্দোলন করুক না কেন, আর দুই নেত্রী যতই দৃঢ় থাকুন না কেন, তাদের জোটের এবং দলের নীতি-নির্ধারক পর্যায়ের কিছু নেতাকে এরশাদের অনুগত করে এক জোটকে নির্বাচনে নিয়ে আসা হয়। আরেক জোট থাকে বাইরে। দুটিই ছিল কূটচাল। এরশাদ এই চালটি খুব ভালভাবে দিতে পেরেছিলেন। শেখ হাসিনা দু’দিন আগে চট্টগ্রাম লালদীঘি ময়দানে এরশাদের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে তা পরিবর্তন করে নির্বাচনে অংশ নেয়াটা যেমন আলোচিত বেগম জিয়ার অংশ না নেয়াটাও ছিল রহস্যজনক। কেননা অনেক দাবি দাওয়া সত্তে¡ও এক পর্যায়ে দুই জোটের নির্বাচনে অংশগ্রহণের পক্ষেই মত আসে। দুই নেত্রীর মনোভাবও তেমনই ছিল। ১৫০টি করে আসনে দুই নেত্রীর অংশ নেয়ার ফর্মুলাসহ নানা ধরনের কৌশল নিয়েও আলোচনা হয়। কিন্তু বাস্তব হলো শেষপর্যন্ত বিএনপি জোট নির্বাচনে অংশ নেয়নি। আওয়ামী জোট অংশ নেয়। তবে আওয়ামী জোট থেকে ওয়ার্কার্স পার্টি এবং তৎকালীন জাসদের আরিফ-ইনুর নেতৃত্বে কয়েকটি দল ১৫ দলীয় জোট থেকে বেরিয়ে আসে। তারা নির্বাচনে অংশ নেয়নি। বিএনপি-নেতৃত্বাধীন ৭ দলীয় জোটের সাথে তারা নির্বাচনবিরোধী অবস্থান নিয়ে আন্দোলন ও সংগ্রামে অংশ নেয়। এরই মধ্যে সব বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে নির্বাচন হয়ে যায়। এই নির্বাচন ছিল ব্যাপক কারচুপির নির্বাচন। প্রশাসনের প্রকাশ্য হস্তক্ষেপসহ নির্বাচন কমিশন থেকে ফল পরিবর্তনের ঘটনাও ঘটে। এতে ফলাফল যা হওয়ার তাই হলো। এরশাদের জাতীয় পার্টিই বিজয়ী হলো। আওয়ামী লীগ এককভাবে ৭৬টি আসন পেয়ে দ্বিতীয় স্থান দখল করে। আগেই বলেছি, আমার মনে হয়েছে নির্বাচনটি ছিল স্বৈরাচারের ছকে আঁটা। যেদিন আওয়ামী জোট ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বঙ্গবন্ধুর বাসভবন থেকে নির্বাচন করার ঘোষণা দেয় সেদিন রাতে একই সময়ে বিএনপির তৎকালীন সদস্য ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার ধানমন্ডির ৫ নম্বর সড়কের বাসভবনে বেগম খালেদা জিয়া বিএনপি ও ৭ দলীয় জোট নেতৃবৃন্দের সাথে নির্বাচনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে বৈঠকে বসেন। আমি সেই সময় নাজমুল হুদার বাড়িতে উপস্থিত ছিলাম। নির্বাচনে অংশগ্রহণের ব্যাপারে বেগম জিয়াকেও প্রথমে ইতিবাচক দেখেছিলাম। বেগম জিয়া আসার পর বিএনপির তৎকালীন স্থায়ী কমিটির সদস্য আব্দুল মতিন চৌধুরী ও ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা তার সাথে কথা বলে বাইরে কারো সাথে যোগাযোগ করতে গেলেন। এরই মধ্যে খবর এলো সাংবাদিক সম্মেলন করে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোট নির্বাচনের অংশগ্রহণের ঘোষণা দিয়েছে। তখন বেগম জিয়ার সাথে ধানমন্ডির ঐ বাসায় বিএনপির মাঝারি পর্যায়ের কয়েকজন নেতা ছিলেন। আওয়ামী লীগের সিদ্ধান্ত শুনে তারা ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেন এবং বেগম জিয়াকে নির্বাচনে অংশ গ্রহণ না করার জন্য চাপ দেন। প্রয়াত সিনিয়র সাংবাদিক গিয়াস কামাল চৌধুরীসহ আমরা বেশ কয়েকজন সাংবাদিক সেখানে উপস্থিত ছিলাম। অনেকক্ষণ অবস্থানের পরও আমরা কোন সিদ্ধান্ত পেলাম না। মতিন চৌধুরী ও নাজমুল হুদাও ফিরে এলেন না। আমরা রাতে অফিসে এসে শুনি বিএনপি জোট নির্বাচনে যাবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে। বেগম জিয়ার কাছ থেকে তখন আমরা এ ব্যাপারে কিছু শুনিনি। পরে জেনেছি মতিন চৌধুরী, নাজমুল হুদাসহ কয়েকজন বিএনপি নেতার সাথে আওয়ামী জোট থেকে বেরিয়ে আসা জাসদ এবং ওয়ার্কার্স পার্টির নেতৃবৃন্দের কোন এক স্থানে বৈঠক হয়েছিল, সেখান থেকে নির্বাচনে অংশ না নেয়ার ঘোষণাটি আসে।

এ নির্বাচন দুই জোটের দূরত্ব যোজন যোজন বাড়িয়ে দেয়। বিএনপি জোট আওয়ামী জোটকে ‘সুবিধাভোগী’ ইত্যাদি বলে আখ্যায়িত করে। আর আওয়ামী জোটও একইভাবে বিএনপি জোটকে ‘এরশাদকে ক্ষমতায় রাখার জন্য’ নির্বাচনে অংশ নেয়নি বলে প্রচারণা চালায়। বিএনপির তখন এরশাদের চাইতে বেশি ক্ষোভ ছিল আওয়ামী লীগের ওপর। নির্বাচনে অংশ নিলেও আওয়ামী লীগ সংসদ অধিবেশনে যোগ দেয় বেশ কিছুদিন পর। এরই মধ্যে এরশাদ সেনাপ্রধান থেকে পদত্যাগ করে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন দেন। আওয়ামী ও বিএনপি জোট রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে অংশ না নিয়ে ভোটের দিন হরতালের ঘোষণা দিলে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে গৃহ অন্তরীণ করা হয়। এরই মধ্যে এরশাদ প্রেসিডেন্ট বনে যান। আবারও এরশাদবিরোধী আন্দোলন দানা বেঁধে ওঠে। যার যার অবস্থান থেকে কর্মসূচি পালন শুরু হয়। আগের মত যুগপৎ কর্মসূচি ছিল না। দুই জোটের লিয়াজোঁ কমিটিও ছিল না। এতে আন্দোলন তেমন গতি পাচ্ছিল না। আগেই বলেছি, আওয়ামী জোট এরশাদের অধীনে সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়ায় বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া ক্ষুব্ধ ছিলেন। এরশাদবিরোধী ঐক্যবদ্ধ বা যুগপৎ আন্দোলনের জন্য সুশীল সমাজসহ বিভিন্ন মহলের আবেদনে তিনি সাড়া দেননি। দূরত্ব বাড়তেই থাকে। এরই মধ্যে ১৯৮৭ সালের আগস্ট-সেপ্টেম্বরের বন্যা দেখা দেয়। সারা দেশের মতো ঢাকাশহরও বন্যা কবলিত হয়ে পড়ে। অপ্রতুল ত্রাণ আর মানুষের দুর্ভোগের কারণে জনমত এরশাদে সরকারের বিরুদ্ধে চলে যায়। দেশে সচেতন সব মানুষই চান দুই জোটের ঐক্য। যুগপৎ আন্দোলন। এমনি এক সময়ে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার ত্রাণ বিতরণের কর্মসূচি ছিলো পুরানো ঢাকার ধূপখোলা মাঠে। আমি তখন দৈনিক খবর-এ কাজ করি। দেশের প্রথম ফটোকম্পোজে ছাপা পত্রিকা। দৈনিক খবর তখন বেশ জনপ্রিয়। আমি সেই সময় রাজনীতি, প্রশাসন, সংসদ এবং নির্বাচনসংক্রান্ত নিউজ বেশি করতাম। আমি চিন্তা করলাম এই সময়ে বেগম খালেদা জিয়ার একটি সাক্ষাতকার নিতে পারলে বেশ ভাল হয়। বিশেষ করে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন এবং বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে তার বক্তব্য নিতে পারলে খুব পাঠকপ্রিয় হবে। ত্রাণ বিতরণের কর্মসূচির কথা আগের দিনই বিনএপি অফিস থেকে আমাকে জানানো হয়। সাক্ষাতকারের চিন্তা মাথায় আসার পর রাতেই আমি ফোন করি রেজাবুদৌলা চৌধুরীকে। আগে তো মোবাইল ছিল না। নেতাদের সাথে কথা বলতে হতো গভীর রাতে। কর্মসূচি সেরে বা অফিস থেকে যখন বাসায় ফিরতেন। গভীর রাতে। তাই নিউজের জন্য হোক আর যোগাযোগের জন্য সে পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতো। দলীয় অফিসে দেখা-সাক্ষাত হলেও বেশি কথা বলা বা নিউজ নেয়া সম্ভব হত না। নেতা-কর্মীরা থাকত, সাংবাদিকরা থাকত। রেজাবুদৌলা চৌধুরী তখন জাতীয়তাবাদী সাংস্কৃতিক দলের (জাসাস) সভাপতি। সদালপী, বিনয়ী, তখনকার সময়ে বিএনপির একনিষ্ঠ নেতা-কর্মী। বেগম জিয়ার সব কর্মসূচিতে থাকতেন, ঘনিষ্ঠও ছিলেন, টেলিফোনে আমি জানাতে চাইলাম, তিনি কাল ধূপখোলা মাঠে যাবেন কিনা। জানালেন যাবেন। আমি বললাম বেগম সাহেবের সঙ্গে আমার কয়েক মিনিট একান্তে কথা বলার সুযোগ দিতে হবে। আমি একটি বিশেষ নিউজ করব। তিনি বললেন, ত্রাণ বিতরণ সভায় এমন সময় দেয়া সম্ভব হবে কিনা এখনই বলা যাচ্ছে না। আর সেখানে অন্যান্য পত্রিকার সাংবাদিকও থাকবে তাই সুযোগ পাওয়া কঠিন হতে পারে। তার সঙ্গে আমার বেশ ভাল সম্পর্ক ছিল। আলাপ-আলোচনার একপর্যায়ে আমি প্রস্তাব দিলাম। ত্রাণ বিতরণ শেষে ফিরে আসার সময় গাড়িতে আসতে আসতে কথা বলা যেতে পারে। তিনি বললেন, তিনি ধোলাইখাল যাওয়ার আগে বেগম সাহেবের সঙ্গে কথা বলবেন। বেগম সাহেব রাজি হলে সেভাবে ব্যবস্থা নেবেন।পরদিন বিকালে আমি ধূপখোলা মাঠে পৌঁছি বেগম জিয়া আসার অনেক আগে। ফুটপাতে বসে চা পান করছি। কয়েকজন সাংবাদিকও এসেছেন। মাঠে মানুষজন অনেক। আমার চিন্তা বেগম জিয়ার সাক্ষাতকার। না আসা পর্যন্ত রেজাবুদৌলা চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগের কোন সুযোগ নেই। ৪টার দিকে বেগম জিয়ার গাড়ির সঙ্গেই অন্য গাড়িতে এলেন তিনি। বেগম জিয়া সরাসরি মঞ্চে উঠে গেছেন। আমি মঞ্চের পাশে যাই। আমাকে দেখেই রেজাবুদৌলা বললেন, শাহজাহান ভাই, আপনি এসেছেন? কথা হয়েছে। ম্যাডাম রাজি হয়েছেন। তবে বিব্রতকর কোন প্রশ্ন নয়। আমি বললাম, শুধু বর্তমান অবস্থা নিয়েই কথা বলব। জনাব চৌধুরী আমাকে বেগম জিয়ার গাড়ির কাছে নিয়ে এলেন, ড্রাইভারকে বললেন বেগম সাহেব আসার আগেই যেন আমাকে গাড়িতে উঠিয়ে নেন। কথামত কাজ। আমি গাড়িতে উঠে বসি। কিছুক্ষণ পর বেগম জিয়া উঠলেন। আমাকে দেখেই বললেন, আপনি এসেছেন? আমি সালাম দিয়ে বললাম, জ্বি। ততক্ষণে ড্রাইভার গাড়ি চালু করে দিয়েছে। কোথায় যাবেন তিনি, আমি কোথায় নামব এসব চিন্তা না করে কথা শুরু করলাম। প্রথমে ত্রাণ, তারপর জোট, পরে আওয়ামী লীগ এবং সবশেষে আমার প্রশ্ন বা জানার ছিল মূল প্রশ্নটি। আমি তাকে শেষ প্রশ্ন করি, এরশাদবিরোধী আন্দোলনের জন্য ঐক্যবদ্ধ বা যুগপৎ আন্দোলনের পক্ষে জনমত সোচ্চার থাকার পরও ঐক্য হচ্ছে না, কেন? যুগপৎ আন্দোলনের কি আপাতত কোন সম্ভাবনা আছে? এই প্রশ্নে তিনি কিছুটা উত্তেজিত হয়েই বললেন, ‘কিসের ঐক্য, কার সাথে ঐক্য, আওয়ামী লীগ বা হাসিনার সাথে আর কোন ঐক্য নয়। তারা আমাদের সাথে বেঈমানি করেছে। আমরা এককভাবেই আন্দোলন করব।’ আমার মূল প্রশ্নের উত্তর শেষ হতে না হতেই গাড়ি এসে থামল ইস্কাটনে বেগম খালেদা জিয়ার ভাই সাইদ ইস্কান্দারের (মরহুম) তৎকালীন বাসায়। আমি তাকে ধন্যবাদ ও সালাম জানিয়ে রিক্সাযোগে সোজা তেজগাঁ খবর অফিসে ফিরলাম। তখন রাজধানীতে এত জ্যাম ছিল না। কাজেই আমার যেতে বেশি সময় লাগেনি। অফিসে গিয়ে এককাপ চা খেয়ে ঠাণ্ডা মাথায় প্রশ্নোত্তর আকারে সাক্ষাতকারটি লিখলাম। বার্তা সম্পাদককে আগেই জানিয়ে রেখেছিলাম। পরদিন দৈনিক খবরে ‘হাসিনার সাথে ঐক্য নয়, যুগপৎ আন্দোলনও নয়’ প্রধান শিরোনামে বেগম জিয়ার সাক্ষাতকারটি ছাপা হলে রাজনৈতিক অঙ্গন ও সচেতন মহলে হৈ-চৈ পড়ে যায়। এরপর পক্ষ-বিপক্ষে অনেক বক্তৃতা-বিবৃতি আসে। কেউ সমালোচনা করলেন, কেউ নিন্দা করলেন। কেউ বললেন, খালেদা জিয়া ঠিকই বলেছেন। কেউ বলেছেন খালেদা জিয়া আসলে আন্দোলন চান না। তবে বেশিরভাগ বক্তৃতা-বিবৃতিতে এরশাদবিরোধী আন্দোলনে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপিকে যুগপৎ বা ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে আহŸান জানানো হয়। আর জনমতও ছিল এরশাদের বিরুদ্ধে, প্রত্যাশা ছিল যুগপৎ আন্দোলন। এ লক্ষ্যেই জনমত বৃদ্ধি পেতে থাকে। খালেদা জিয়া সবদিক দিয়ে বেশ চাপে পড়েন।

বাস্তবতা ছিল এই সাক্ষাতকারের পর দুই জোটের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির সাময়িক অবসান হয়। শুরু হয় আবার সমঝোতা বা ঐক্যের উদ্যোগ। রাজনৈতিক পরিস্থিতিও পাল্টে যায়। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৮৭ সালের ২৮ অক্টোবর শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার মধ্যে প্রথম বারের মত একটি বৈঠক হয়। বৈঠকটি হয়েছিল শেখ হাসিনার স্বামী পরমাণু বিজ্ঞানী ডা. ওয়াজেদ মিয়ার (মরহুম) তৎকালীন মহাখালীর সরকারি বাসভবনসংলগ্ন কমিউনিটি সেন্টারে। এই বৈঠকে ১৫ দল ও ৭ দল নেতারাও উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে যুগপৎ আন্দোলনের একটি ইশতেহার তৈরি হয়। এ প্রেক্ষিতে আবার আন্দোলন চাঙ্গা হয়ে ওঠে। জামায়াতে ইসলামী এবং বামপন্থীদের জোটও যুগপৎ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে। শেখ হাসিনা তখনও সংসদে বিরোধীদলীয় নেত্রী ছিলেন। এরই মধ্যে জাতীয় পার্টিতেও ভেতরে বিভক্তি বেশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। দলের অনেক এমপি পদত্যাগ করে আওয়ামী জোটের সাথে যোগ দিতে পারে, এমন গুজব ছড়িয়ে পড়ে। হাসিনা-খালেদার বৈঠক, যুগপৎ আন্দোলনের পুনঃঐক্য এবং নিজ দলীয় এমপিদের পদত্যাগের গুজবে এরশাদ জাতীয় সংসদ ভেঙে দিয়ে নতুন নির্বাচন দেন ১৯৮৮ সালের ৩ মার্চ। সে নির্বাচনে ১৫ দল, ৭ দল, জামায়াতসহ বড় কোনো দলই অংশ নেয়নি। কেবল জাসদ রব, ফ্রিডম পার্টি অংশ নিয়েছিল। সেই নির্বাচনেও এরশাদের রক্ষা হয়নি বরং পতন আরো ত্বরান্বিত করে। বেশিদিন টেকেনি ১৯৮৮ সালের সংসদও। এরশাদবিরোধী আন্দোলন তীব্র হয়ে ওঠে। কারফিউ ভেঙে জনতা এরশাদের বিরুদ্ধে রাজপথে নেমে আসে। তীব্র আন্দোলনের মুখে ১৯৯০ সালের ৪ ডিসেম্বর এরশাদ পদত্যাগে বাধ্য হন।

দুই.
আওয়ামী লীগ তখন বিরোধীদলে। ক্ষমতায় বিএনপি। এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে এই দু’দলের নেতৃত্বাধীন জোটের দীর্ঘ আন্দোলনের পর বিচারপতি শাহবুদ্দিন আহমদের নেতৃত্বাধীন অন্তবর্তীকালীন সরকারের অধীনে ১৯৯১ সালের নিবার্চনে বিএনপি ক্ষমতাসীন হয়। এই সংসদ শুরু থেকে যেমন প্রাণবন্ত থাকে তেমন ছড়াতে থাকে উত্তাপ। সংসদের এমনি একদিন ছিল ১৯৯৫ সালের ১ মার্চ। প্রশ্নোত্তর পর্বে আওয়ামী লীগের তৎকালীন সংসদ সদস্য আবুল হাসান চৌধুরী পয়েন্ট অব অর্ডারে হেবরনে মুসলমান হত্যার জন্য সংসদে নিন্দা ও শোক প্রস্তাব গ্রহণের জন্য স্পিকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। সে সময় তথ্যমন্ত্রী ছিলেন ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা। তিনি এ ধরনের প্রস্তাবকে ‘আওয়ামী লীগের মায়াকান্না ও হঠাৎ মুসলমান হয়ে যাওয়া’ বলে মন্তব্য করেন। আর নাজমুল হুদার এ-বক্তব্য আওয়ামী লীগ দলের সদস্যরা তীব্র প্রতিবাদ ও নিন্দা জানিয়ে তাকে নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনার দাবি জানান। তারা ওয়াক আউট করেন। এই ওয়াক আউট থেকেই পরে শুরু হয় সরকারবিরোধী আন্দোলন। ১৯৯৪ সালের ২৪ মার্চ অনুষ্ঠিত হয় মাগুরা আসনের উপ-নির্বাচন। আওয়ামী লীগ এমপি আসাদুজ্জামানের মৃত্যুতে শূন্য এ আসনে উপ-নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি হয়। তখন প্রধান নির্বাচন কশিশনার ছিলেন বিচারপতি আব্দুর রউফ। বিএনপিসমর্থিত এক শিল্পপতি কাজী সলিমুল হক এই নির্বাচনে জয়ী হন। ওই উপ-নির্বাচনে কারচুপির ঘটনা থেকেই আসে তত্ত¡াবধায়ক সরকারের দাবি। আর এ দাবি আদায়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে তৎকালীন প্রায় সব বিরোধীদল হরতাল, অবরোধ, অসহযোগসহ নানা আন্দোলনের কর্মসূচি দিতে থাকে। আন্দোলনের একপর্যায়ে ১৯৯৪ সালের ২৮ ডিসেম্বর মানিক মিয়া এভিন্যুতে এক সমাবেশ শেষে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বিরোধীদলীয় সদস্যরা সংসদ সদস্যপদ থেকে পদত্যাগ করেন। কিন্তু তাদের পদত্যাগপত্র তখন গ্রহণ করা হয়নি। তবে ৯০ দিন কার্যদিবস একাধিক্রমে অনুপস্থিত থাকার কারণে তাদের আসন শূন্য হয় ১৯৯৫ সালের ৩০ জুলাই। এ দীর্ঘ সময়ে সমঝোতার জন্য দেশি-বিদেশি অনেক উদ্যোগ নেয়া হয়। কমনওয়েলথের তৎকালীন মহাসচিব অ্যামেকা অ্যানিকু ঢাকা আসেন। তিনি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ও একই সংসদে বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সমঝোতার প্রয়াস নেন। পরপরই মধ্যস্থতাকারী হিসেবে তার প্রতিনিধি হয়ে আসেন অস্ট্রেলিয়ার সাবেক গভর্নর স্যার নিনিয়ান স্টিফেন। ৩৯ দিন ঢাকায় অবস্থান করে তিনি দুই নেত্রী এবং তৎকালীন সরকারি দল ও বিরোধীদলের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেন। কিন্তু তিনিও সফল হননি। বিএনপি তত্ত¡াবধায়ক সরকারের দাবি মানতে রাজি হয়নি। আর আওয়ামী লীগসহ তৎকালীন বিরোধীরা তত্ত¡াবধায়ক সরকারের দাবি মানা ছাড়া আন্দোলন থেকে ফিরে আসবে না বলে সাফ জানিয়ে দেয়।
স্বাধীনতার পর সম্ভবত সেই তত্ত¡াবধায়ক সরকারের দাবির আন্দোলনই ছিল সবচেয়ে বড় আন্দোলন। সর্বাত্মক এই আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্যেই অবাধ ও সুষ্ঠু সংসদ নির্বাচনের জন্য তত্ত¡াবধয়ক সরকারের বিভিন্ন ফর্মুলা নিয়ে আলোচনা হয়। দেশে-বিদেশে বিভিন্ন কাঠামো তুলে ধরা হয়। এই ফর্মুলা ও কাঠামোগুলোর মধ্যে সবচাইতে চাঞ্চল্যকর ছিল খোদ সরকারি দল থেকে আসা তথ্যমন্ত্রী ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার একটি ফর্মুলা। আর সে-সময় প্রেসিডেন্ট আব্দুর রহমান বিশ্বাসের দায়িত্ব পালনের বিষয়টিও সামনে আসে। তৎকালীন বিরোধী নেতারা তার সাথে সাক্ষাত করে সমঝোতার উদ্যোগ নিতে বলেন। কিন্তু তিনি কোনো উদ্যোগ নেননি বা নিতে পারেননি। তবে সে-সময়কার পরিস্থিতি সম্পর্কে তিনি আমাকে একটি সাক্ষাতকার দিয়েছিলেন। এখানে বলে রাখি, সে সময়কার আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমেই তত্ত¡াবধায়ক সরকারের দাবি আদায় হয়েছিল। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্র“য়ারি বিএনপি একতরফা একটি নির্বাচন করে। সে নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সংসদের একমাত্র অধিবেশনটি বসে ১৯ মার্চ। আর তত্ত¡াবধায়ক সরকারের বিলটি পাস হয় ২৪ মার্চ বসা বৈঠকে। এই তত্ত¡াবধায়ক সরকারের আন্দোলনের একপর্যায়ে তৎকালীন তথ্যমন্ত্রী ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা আমাকে একটি সাক্ষাৎকার দেন। সরকারি দলে থেকেই তিনি তত্ত¡াবধায়ক সরকারের একটি রূপরেখা দেন। নিচে তার সাক্ষাৎকারটিসহ একে ঘিরে আমার অন্যরকম এক অভিজ্ঞতা তুলে ধরা হলো।

(সুপ্রিয় পাঠক, সময়ের অভাবে যদি কেউ পূর্বের পোস্টকৃত কোন পর্ব পড়তে না পারেন, তাহলে ফেসবুকের এই আইডি থেকে অথবা বাংলাদেশ জার্নাল অনলাইনের ‘অন্যান্য’ ক্যাটাগরি থেকে ‘রিপোর্টার থেকে সম্পাদক’ বইটি পড়তে পারবেন।)

বইটি সংগ্রহ করতে চাইলে অর্ডার করুন #www.rokomari.com/utso
#www.porua.com.bd
#www.boimela.com

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here