তারপর পথ হারাল বাংলাদেশ

0
125

নির্মলেন্দু গুণ

১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট ভোরের দিকে হঠাৎ পাশের ঘরের রেডিওতে একটা ঘোষণা শুনলাম। মেজর ডালিম বলছে, ‘শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে।’ কী শুনছি? প্রথমে বিশ্বাস করতে পারিনি। কয়েকবার শোনার পর সত্যতা যাচাইয়ের জন্য বাসা থেকে বের হই। তখন আজিমপুর কবরস্থানের পাশে একটি বাঁশের বেড়া আর টিনশেডের মেস ছিল। সেখানে থাকতাম। হেঁটে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের দিকে যাই। শহীদ মিনারের কাছে যেতেই দেখি সৈন্যরা দাঁড়ানো। তারা লোকজনকে ডাকছিল মৃতদেহ দেখে যাওয়ার জন্য। কিন্তু আর্মিদের ডাকে কেউ সাড়া দিচ্ছিল না। বরং দ্রুত পালিয়ে যাচ্ছিল। আমরা আর এদিক দিয়ে গেলাম না। দক্ষিণ দিকে বকশীবাজারের দিক থেকে একটা দেয়ালভাঙা রাস্তা ছিল, ওই দিক দিয়ে ঢুকে মর্গের সামনে যাই। হাসপাতালের রোগীদের স্বজনরা সেখানে ভিড় করেছে। সেই ভিড়ের সঙ্গে মিশে দেখলাম ঘরভর্তি লাশ। এলোমেলো ছড়ানো-ছিটানো। কারো মুখই চেনা যাচ্ছে না। ১৮ জনের লাশ সেখানে ছিল। একজন ডোম জানাল, এখানে বঙ্গবন্ধুর লাশ নেই। বঙ্গবন্ধুর লাশ রয়েছে ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িতে। সেখান থেকে বেরিয়ে তরুণ লেখক-কবি মোস্তফা মীরসহ আমরা নিউ মার্কেটের দিকে গেলাম। লক্ষ্য বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে যাওয়া। কিন্তু দেখলাম, আর্মির আনাগোনা খুব বেশি। গাড়িতে সবার হাতে বন্দুক তাক করা, ঘুরছে। সায়েন্স ল্যাবরেটরির মোড় পর্যন্ত যাওয়ার পর আর যেতে দিল না। বঙ্গবন্ধুর বাড়ি ঘিরে চারদিকে ব্যারিকেড তৈরি করা হয়েছে। কাউকেই যেতে দিচ্ছে না। দেখলাম চারদিকে ভয়ার্ত অবস্থা। মানুষ ভয়ে তটস্থ। আর্মির সঙ্গে নিরাপদ দূরত্ব রেখে চলছে। পারলে পালিয়ে বাঁচে অবস্থা।

রেডিওতে শুধু ‘শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে’ বলে ঘোষণা হচ্ছিল। তাঁর পরিবারের সব সদস্য—বেগম মুজিব, কামাল, জামাল, তাঁদের স্ত্রী, শিশু রাসেল, শেখ মনি, তাঁর অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী, আব্দুর রব সেরনিয়াবাত, তাঁর ছোট ছেলে সুকান্ত—এত মানুষকে যে হত্যা করা হয়েছে তা প্রচারিত হচ্ছিল না। কিন্তু আস্তে আস্তে যখন জানা যাচ্ছিল তখন তো মানুষ ঘটনাটি বিশ্বাসই করতে পারছিল না। এত নিষ্ঠুর, নৃশংস, বর্বর হত্যাকাণ্ড মানুষ কল্পনাও করতে পারেনি।

১৫ই আগস্টের হত্যাকাণ্ডের ভেতরে ফুটে ওঠা অভাবিত নির্মমতার দিকটির কথা ভেবে আমি খুবই বিচলিত ও অসহায় বোধ করি। আমার মনে প্রশ্ন জাগে, হত্যাকারীদের মনে ঘৃণার এই যে জোর—তারা কোথা থেকে পেল? প্রতিহিংসাপরায়ণতার এই যে উচ্চমাত্রা তা কি শুধুই মুহূর্তের মতিভ্রম? আমার বিশ্বাস হয় না। বিপুলসংখ্যক মুসলমানের বাসভূমি হলেও, এক শ্রেণির মুসলমানের কাছে চিরশত্রুরূপে গণ্য হিন্দুস্তানের সহায়তায় ইসলামিক রিপাবলিক অব পাকিস্তানকে ভেঙে ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ গঠন করার অপরাধই ছিল ঐরূপ দুর্মর ঘৃণার জাতক বলে আমার মনে হয়।

মনে পড়ে, আমার ওই সময়ের অসহায়ত্ববোধের সঙ্গে এক ধরনের অপরাধবোধও এসে যুক্ত হয়েছিল। ওই অপরাধবোধ ছিল কবি আল মাহমুদের সম্পাদনায় প্রকাশিত গণকণ্ঠ পত্রিকায় কিছুদিন কাজ করার কারণে। আমি সরল বিশ্বাসে আমার প্রতিষ্ঠানবিরোধী চরিত্রের কারণে যে কাগজে যোগ দিয়েছিলাম, পরবর্তীকালে ওই কাগজ জাসদের মুখপত্রে পরিণত হয়। বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সরকারকে জনবিচ্ছিন্ন করার ক্ষেত্রে ওই পত্রিকা যে ভূমিকা রেখেছিল, আমিও সেখানে দাবার ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিলাম। সেই কথা ভেবে আমার অনুশোচনা হয়। আমি নিজেকে অপরাধী বলে ভাবতে থাকি। বিশ্বাসঘাতক এই নগরীকে আর আমার বাসযোগ্য বলে মনে হয় না। আমি স্থির করি, এই নগরীতে আর নয়। তিন দিন পর ১৮ আগস্ট রাতে অনির্দিষ্টকালের জন্য আমার গ্রামের বাড়িতে ফিরে যাই।

কিছুদিনের মধ্যেই বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী ভারতে পালিয়ে গিয়ে কাদের বাহিনী গঠন করেন। গ্রামে যাওয়ার পর কাদের বাহিনী গঠনের সংবাদ আমার কানে আসে। আমাদের এলাকার বিপুলসংখ্যক তরুণ কাদের বাহিনীতে যোগ দিতে থাকে। রক্ষীবাহিনীর একজন লিডার কলমাকান্দার সুকুমার সরকারও কাদের বাহিনীতে যোগ দেয়। মেঘালয় সীমান্ত দিয়ে দুর্গাপুর, কলমাকান্দা, বারহাট্টা ও মোহনগঞ্জে এসে কাদের বাহিনীর সদস্যরা থানা ও হাট-বাজারে হামলা চালাতে শুরু করে। কিন্তু ওই সব হামলার জোর ও ভবিষ্যৎ ছিল খুবই অনিশ্চিত। কেননা ঐরূপ কাজে সিদ্ধি লাভ করার জন্য ১. যে রকম বিপুল সংখ্যায় দেশত্যাগের দরকার ছিল এবং ২. সাহায্যকারী দেশটির যেরূপ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত থাকা প্রয়োজন ছিল, ভারতের তৎকালীন সরকারের তা ছিল না। ফলে ওই সব সম্ভাবনাহীন আক্রমণ দারোগা-পুলিশ অপহরণ এবং থানার অস্ত্র লুট করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। মাঝখান থেকে যাদের বাড়িঘরে আশ্রয় নিয়ে ওই সব হামলা চালানো হচ্ছিল, কাদের বাহিনীর সদস্যদের চলে যাওয়ার পর তারা খুবই বিপদের মধ্যে পড়ে যায়। আমার একজন মামা, আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা ডাক্তার মতিলাল চৌধুরী (মোহনগঞ্জ থানার খলাপাড়া গ্রামে) কাদের বাহিনীর সদস্যদের আশ্রয়দানের অপরাধে পুলিশের হাতে ধরা পড়েন এবং তাঁর পরিবারটি পুলিশি নির্যাতনের শিকারে পরিণত হয়। পরে মামলায় আমার মামা মতিলাল চৌধুরী এবং উনার এক ভাতিজা তুষারকে বছর দশেক জেল খাটতে হয়েছিল। মানসিক ভারসাম্য হারানো অবস্থায় আমি ঢাকা ত্যাগ করে গ্রামে ফিরে গিয়েছিলাম, গ্রামের নির্জনতা ও রাজনীতি থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে শান্তি ও স্বস্তি ফিরে পাওয়ার আশায়। কাদের বাহিনীর থানা আক্রমণ এবং আক্রমণের সঙ্গে আমার মামার জড়িত থাকার অভিযোগে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার সংবাদ শুনে আমি কিছুটা উন্মাদের মতোই আমার পরিবারের সঙ্গে গ্রামের বাড়িতে দিনাতিপাত করতে থাকি।

আমি আমার দেশ সম্পর্কে সব আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিলাম। নিকটবর্তী থানা শহরে গিয়ে খবরের কাগজ পড়তে পারতাম, কিন্তু পড়তাম না। বাড়িতে রেডিও ছিল না, পাশের বাড়িতে ছিল, ইচ্ছা করলে শুনতে পারতাম, কিন্তু শুনতাম না। ঢাকায় কী হচ্ছে না হচ্ছে, আমি প্রায় কিছুই খবর রাখতাম না। আমি সারা দিন আমাদের গ্রামের শ্মশানে জগা সাধুর আশ্রমে পড়ে থাকতাম। আধ্যাত্মিক গান শুনতাম এবং দিনরাত সিদ্ধি সেবন করতাম। সংসারত্যাগী জগা সাধুর সঙ্গে আমার একটা আত্মিক-আধ্যাত্মিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। জগা সাধুর আশ্রমটা ছিল আমার মায়ের শ্মশানের খুবই কাছে। ওই আশ্রমে বসে আমার ছোটবেলায় হারানো মাকে অনুভব করতাম। আসলে পরে বুঝেছি, ওই সময়ে এক ধরনের মানসিক রোগীতে পরিণত হয়েছিলাম। আমার ওই মানসিক রোগের কী নাম, জানি না; রোগটা ছিল সবাইকে সন্দেহ করা। সব সময় আমার মনে হতো, আমাকে মেরে ফেলার জন্য বিশ্বজুড়ে একটা গভীর ষড়যন্ত্র চলছে। ওই ষড়যন্ত্রের হোতা হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ। আমার তখন মনে হতো, আমি তো শুধু আমি নই, বঙ্গবন্ধুর আত্মা বা রুহ পুনর্জন্মের আশায় আমার ভেতরে এসে আশ্রয় নিয়েছে। এই সংবাদ সিআইএর অজানা নয়। তাই আমাকে শেষ করে দেওয়ার জন্য সিআইএর লোক এই প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্তও হানা দিতে পারে। আমার বিমাতা তো পারেনই, আমার আপন পিতাও প্রচুর ডলারের লোভে সিআইএর ফাঁদে পা দিতে পারেন। কিছুই বলা যায় না। কাউকেই বিশ্বাস নেই। আমার খুবই সতর্ক থাকা দরকার। মানুষকে বিশ্বাস করা চলবে না। বঙ্গবন্ধু মানুষকে বিশ্বাস করে ঠকেছেন। আমাকে যে খাদ্য প্রদান করা হতো, আমি ওই খাদ্য অন্যকে খাইয়ে টেস্ট করে তবেই খেতাম। তার আগে নয়। আমার আচরণে আমার মা-বাবা, ভাই-বোনরা খুব কষ্ট পেত। কিন্তু তাদের চোখের জলও আমাকে আমার অটল সিদ্ধান্ত থেকে টলাতে পারত না। চারদিকে রাষ্ট্র হয়ে গিয়েছিল যে আমি পাগল হয়ে গেছি। আমার পাগল হয়ে যাওয়ার খবর শুনে দূর থেকেও মানুষ আমাকে দেখতে আমাদের বাড়িতে এসে ভিড় করত। আমি দেখা দিতাম, কিন্তু পারতপক্ষে কারো সঙ্গে কথা বলতাম না। ঐরূপ মানসিক ভারসাম্য হারানো অবস্থার মধ্যেই আমার অনেক দিন কেটে যায়।

অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ে, হঠাৎ একদিন ঢাকা থেকে একই খামে পাঠানো আমার দুই কবিবন্ধু আবুল হাসান ও মহাদেব সাহার দুটি চমৎকার চিঠি পাই। তাদের সমবেদনাসিক্ত চিঠি দুটো পড়ে, বিশেষ করে আবুল হাসানের চিঠিটি পড়ে আমি ঢাকার প্রতি আমার অভিমান অনেকটাই ভুলে যেতে সক্ষম হই। আবার ঢাকা আমাকে ডাকে, আয় ফিরে আয়। তখনো শারীরিকভাবে পুরোপুরি সুস্থ ছিলাম না। তাই আমার মা-বাবা আমাকে ঢাকায় যেতে বারণ করেন। আমার মা-বাবার ইচ্ছার বিরুদ্ধেই নভেম্বরের শুরুতে ঢাকায় ফিরে আসি।

প্রায় আড়াই মাস পর, বঙ্গবন্ধুহীন এই নগরীতে ফিরে এসে আমি আমার বন্ধু মহাদেব সাহার ১১২ আজিমপুরের বাসায় উঠি। দীর্ঘদিন পর আমাদের দেখা হয়। আমরা দুজন মিলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলি। আমরা হিসাব মেলাতে চাই। কেন এই হত্যাকাণ্ড? কেন এই নৃশংশতা? এখন কোথায় যাবে বাংলাদেশ? সংখ্যালঘুরা বঙ্গবন্ধুহীন এই নতুন বাংলাদেশে থাকতে পারবে কি? ধর্মনিরপেক্ষতার পথ কি অনুসৃত হবে আর? নাকি একটি মিনি পাকিস্তানে (‘মুসলিম বাংলা’ কথাটা তখন চালু হয়েছিল) পরিণত হবে এই দেশ? ভারত কী করবে? সোভিয়েত ইউনিয়ন কি পারবে আমেরিকার ষড়যন্ত্রকে রুখতে? দীর্ঘদিন পর আমরা প্রাণ খুলে কথা বলার সুযোগ পেয়েছি। আমাদের কথা ফুরাতে চায় না। রাজ্যের রাজনীতি এসে ভিড় করে আমাদের মাথায়। আলাপে-উদ্বেগে রাত ভোর হয়ে আসে। বাইরে খুব কমই বেরোই আমরা। মহাদেবের বাসায় অনেকটাই গৃহবন্দির মতো আমি থাকি। অনেক রাত পর্যন্ত গল্প করে আমরা ঘুমিয়েছিলাম।

ভোরের দিকে কয়েকটি রাশিয়ান মিগ-২১ বিমান ঢাকার আকাশ কাঁপিয়ে উত্তর থেকে দক্ষিণের দিকে উড়ে যায়। সঙ্গে হেলিকপ্টার। শব্দে আমাদের ঘুম ভেঙে যায়। আমরা চমকে উঠি। অনেক দিন পর ঢাকার আকাশে এ কিসের গর্জন? কার গর্জন? বঙ্গবন্ধুর নয়তো!

মারাত্মক একটা কিছু ঘটেছে—এমন আশঙ্কায় দ্রুত রেডিও নিয়ে আমরা সংবাদ শুনতে বসি। কিন্তু না, রেডিও চলছে না। একেবারে বন্ধ। আকাশবাণী বা বিবিসিও আমাদের কোনো খবর দিতে পারে না। আমরা খবর জানতে দুপুরের দিকে প্রেস ক্লাবে যাই। ওখানে গিয়ে খবর পাই, ভোরের দিকে সামরিক বাহিনীতে একটি অভ্যুত্থান হয়েছে। ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ এই অভ্যুত্থান করেছেন। সকালের দিকে ঢাকার আকাশে যে বিমান ও হেলিকপ্টারগুলো উড়েছিল সেগুলো উড়েছিল ওই অভ্যুত্থানেরই পক্ষে। বিমান ও হেলিকপ্টারগুলোকে নাকি সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও বঙ্গভবনের ওপর দিয়ে উড়ে যেতে দেখা গেছে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে তখন ১৫ই আগস্টের মোশতাক বর্ণিত সূর্যসন্তানদের ট্যাংক ও আর্টিলারি বাহিনীর ঘাঁটি ছিল। ফলে অভ্যুত্থানটি যে ওই সব তথাকথিত সূর্যসন্তানদের বিরুদ্ধেই ঘটেছে, তা বেশ সহজেই বোঝা গেল। অভ্যুত্থানের খবর শুনে আমি ও মহাদেব খুব খুশি হই।

লেখক : কবি। ১৫ই আগস্টের ট্র্যাজেডিতে গভীরভাবে আক্রান্ত হয়েছিলেন; সেই সময় এবং অনুভূতি লিখেছেন গদ্য-পদ্য দুই-ই। পরের বাংলাদেশের ছবিটা তাই তাঁর কলমেই সবচেয়ে পরিষ্কার।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here