বাংলা খবর ডেস্ক:
বাংলাদেশের আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে আগামী বছর ঢাকা সফরে আসছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম হিন্দুস্তান টাইমস পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বরাতে জানিয়েছে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছেন নরেন্দ্র মোদি। তিনি আগামী বছর মার্চে ঢাকা সফর করবেন।
বৃহস্পতিবার দুই প্রতিবেশী নেতার মধ্যে ভার্চুয়াল বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত হয়।
বৈঠকের পর এক টুইটে মোদি জানিয়েছেন ভারত ও বাংলাদেশ একসঙ্গে ৫০ বছরের কূটনৈতিক সম্পর্ক উদযাপন করবে।
টুইটে মোদি বলেন, পরবর্তী বছর ভারত ও বাংলাদেশ একসঙ্গে মুজিববর্ষ ও কূটনীতি সম্পর্কের ৫০ বছর পালন করবে। আমি বঙ্গবন্ধুর জীবন ও আদর্শকে সম্মান জানাতে ঢাকা সফরে প্রত্যাশী।
করোনাকালে সফর বন্ধ থাকায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকা থেকে এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দিল্লি থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে এই বৈঠকে যোগ দেন। বৃহস্পতিবার বেলা সাড়ে ১১টায় শুরু হওয়া বৈঠকে দুই নেতা করোনা মোকাবেলায় এবং অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় দুই দেশ একসঙ্গে কাজ করবে বলে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।
বৈঠকের আগে ঢাকায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় দু দেশের মধ্যে জ্বালানি, সামাজিক উন্নয়ন, কৃষি ইত্যাদি সাতটি বিষয়ে সহযোগিতার লক্ষ্যে সাতটি কাঠামো চুক্তি, প্রটোকল ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। হাইড্রোকার্বন খাতে সহযোগিতা এবং হাই ইমপ্যাক্ট কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট প্রকল্প চালুর বিষয়ে দুটি কাঠামো চুক্তি হয় এবং হাতির সুরক্ষায় আন্তঃসীমান্ত অভয়ারণ্য তৈরি করতে একটি প্রটোকলে সই করা হয়। কৃষি খাতে সহযোগিতা, বরিশাল সিটি করপোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উন্নয়নে যন্ত্রপাতি সরবরাহ এবং নয়াদিল্লী জাদুঘরের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরের সহযোগিতার বিষয়ে স্বাক্ষরিত হয়েছে তিনটি সমঝোতা স্মারক৷ এছাড়া বাংলাদেশ-ভারত সিইও ফোরামের টার্মস অব রেফারেন্সও স্বাক্ষরিত হয়েছে৷ বাংলাদেশের পক্ষে সংশ্লিষ্ট ৭ মন্ত্রণালয় ও প্রতিষ্ঠানের সচিব বা শীর্ষ কর্মকর্তা এবং ভারতের পক্ষে ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের হাই কমিশনার বিক্রম দোরাইস্বামী এসব নথিতে সই করেন৷ অনুষ্ঠানে কৃষিমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাক, সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী খালিদ হোসেন ও পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন উপস্থিত ছিলেন।
পরে হাসিনা-মোদি ভার্চুয়াল দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে এসব নথি আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাক্ষরিত হয়েছে বলে জানানো হয়। তারা তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে দ্বিপাক্ষিক সমঝোতা সংক্রান্ত একটি চুক্তিও সই করেন।
উদীয়মান অর্থনীতির জোট ব্রিকস এর উদ্যোগে (ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকা দ্বারা প্রতিষ্ঠিত) গড়া নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এনডিবি) এ যুক্ত হতে বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানান মোদি। পরে পদ্মায় হাই কমিশনার দোরাইস্বামী জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওই আমন্ত্রণে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।
এদিকে, দুই নেতার ভাষণের পরপরই দুপুর ১২টার দিকে ৫৫ বছর পর ‘চিলাহাটি-হলদিবাড়ি’ রেলসংযোগের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন ঘোষণা করা হয়। অর্থনীতি এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা আরও উন্নত করার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক এবং আঞ্চলিক স্তরে আরও ক্ষমতাশালী হয়ে উঠবে দু’দেশ, সে প্রক্রিয়ায় হলদিবাড়ি-চিলাহাটি রেল রুট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভমিকা পালন করবে আশাবাদ ব্যক্ত করে হাসিনা বলেন, দুদেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক যেভাবে এগোচ্ছে, তা প্রশংসনীয়।
উল্লেখ্য, ভারতের স্বাধীনতার পরে এই পথে রেল যোগাযোগ থাকলেও ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের সময় তা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
এখন এই রেল প্রকল্প কার্যকর হলে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের সঙ্গে ভারতের যোগাযোগ অনেক সহজ হবে বলে আশাবাদ দুদেশেরই।
হাসিনা ও মোদি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মরণে একটি স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশ করেন। মহাত্মা গান্ধী এবং বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তৈরি ‘‘বঙ্গবন্ধু-বাপু ডিজিটাল এক্সিবিশনে’ রও উদ্বোধন করেন দুই নেতা। মোদি বলেন, ‘‘মহাত্মা এবং বঙ্গবন্ধু আমাদের যুবসমাজের অনুপ্রেরণা। মহাত্মা গান্ধী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উপর তৈরি ডিজিটাল প্রদর্শনী রিলিজ করতে পেরে আমি গর্বিত। আমাদের তরুণ প্রজন্মকে তারা উদ্বুদ্ধ করতে থাকবেন’’।
এছাড়া করোনা মোকাবেলায় ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ভাল সমন্বয় রয়েছে বলে মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী। মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন শেখ হাসিনা। করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলায় মোদী সরকারের প্রশংসা করেন তিনি।
বৈঠকের দিনের তারিখটি অর্থাৎ ১৭ ডিসেম্বর তার পরিবারের কাছে অত্যন্ত বিশেষ দিন উল্লেখ করে হাসিনা জানান, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীনতা লাভ করেছিল বাংলাদেশ। পরদিন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে বন্দি তার মা, বোন এবং ভাইকে মুক্ত করেছিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর মেজর অশোক তারা। শেখ হাসিনা, মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ৩০ লাখ বাংলাদেশি এবং ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। ভারতকে ‘সত্যিকারের বন্ধু’ হিসেবেও উল্লেখ করেন তিনি।
অন্যদিকে, ভার্চুয়াল সম্মেলনের শুরুতেই বাংলাদেশের জন্য প্রতিবেশীকে অগ্রাধিকার দেওয়ার নীতি থেকে কোনও অবস্থাতেই সরে আসবে না ভারত, এ অঙ্গীকার ব্যক্ত করে নরেন্দ্র মোদি বলেন, ‘‘বাংলাদেশ বরাবরই ভারতের ‘নেইবার ফার্স্ট’ নীতির গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। আমাদের সরকারও সেই সম্পর্ক দৃঢ় করতে অঙ্গীকারবদ্ধ। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে সব ভারতীয় নাগরিকের পক্ষ থেকে আমি শুভকামনা জানাই। বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক শক্তিশালী করার এই নীতি দায়িত্ব নেয়ার প্রথম দিন থেকেই আমার অগ্রাধিকার তালিকায় রয়েছে।”
শেখ হাসিনা আগামী ২৬ শে মার্চ মোদিকে ঢাকায় আমন্ত্রণ জানান। তিনি অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় ভারতকে পাশে পাওয়ার আশাবাদ ব্যক্ত করেন। নরেন্দ্র মোদি বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ককে সবসময় প্রাধান্য দেয় ভারত। বাংলাদেশ-ভারত একসঙ্গে করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন পাবে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক একটি ‘যুগান্তকারী মুহূর্ত’ অতিক্রম করছে মন্তব্য করে শেখ হাসিনা বলেন, “একটি স্বাধীন জাতি হিসেবে বাংলাদেশ ৫০ বছর পূর্তি উদযাপন করতে যাচ্ছে এবং বাংলাদেশ এবং ভারত কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠারও ৫০তম বছরে পা রেখেছে।”
এর আগে, গত মে মাসে হাসিনা-মোদি ফোনালাপ হয়েছিল। তখন এক টুইটবার্তায় মোদি জানিয়েছিলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী হাসিনার সঙ্গে কথা হয়েছে, তাকে ও বাংলাদেশের মানুষকে ঈদের শুভেচ্ছা জানিয়েছি। আমফানের প্রকোপ ও কোভিড-১৯ পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এই সংকটের সময় বাংলাদেশকে ভারত প্রয়োজনীয় সবরকম সহায়তা করতে প্রস্তুত বলে আশ্বস্ত করেছি।’
এবারের বৈঠকে ২০১৯ সালের অক্টোবরে দিল্লির হায়দারাবাদ হাউসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বৈঠকের স্মৃতিচারণ করে তার আতিথেয়তার জন্য ধন্যবাদ জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
ওদিকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ৫০ তম বিজয় দিবস উপলক্ষে মোদি বুধবার দিল্লির ‘ন্যাশনাল ওয়ার মেমোরিয়াল’-এ ‘স্বর্ণ বিজয় মশাল’ জ্বালান বলে জানিয়েছে ভারতীয় গণমাধ্যম। সেখানে ১৯৭১ সালের যুদ্ধে শহীদ ভারতীয় সেনাদের প্রতিআও শ্রদ্ধা জানান তিনি।