আমিনা খাতুনের গল্প

0
80

শেখ সালেক:

আমিনা খাতুনের জীবন দুঃখের। অতি অল্প বয়সে বিয়ে হয় তাঁর; তেমনি স্বামীহারা হন অল্প বয়সেই।অনেকগুলো সন্তান নিয়ে দারিদ্র্য আর কষ্ট মাখা জীবন। অভাবের সাথে যুদ্ধ করে চলতে হয় তাঁকে। এর মধ্যেই সন্তানদের লেখাপড়া চালিয়ে নেন তিনি।
সহায় সম্পত্তি না থাকার মত। ছেলেমেয়েদের মুখে দুবেলা খাবার যোগাবার ব্যবস্থা নেই, নেই কাপড় চোপড় কিনে দেওয়ার সামর্থ্য। কিন্তু দমে যাবার পাত্র নন আমিনা খাতুন। কি না করেছেন তিনি ছেলে মেয়েদের বাচিয়ে রাখার জন্য! হাট ফিরানি, দুই তিন টাকা পুজির ব্যবসা, আরো কত কি!
সেই চল্লিশ পঞ্চাশের দশকে গাঁও গেরামে লেখাপড়া নিয়ে যখন কেউ তেমন একটা ভাবত না; কোথা থেকে আমিনা খাতুন সন্তানদের শিক্ষিত করে তোলার মন্ত্র পেলেন। নিজে তাদের পড়াতে পারতেন না; কিন্তু সন্ধ্যা হলেই তাদের পড়তে বসাতেন। তাদের পরীক্ষার দিনগুলোতে রোজা থাকতেন।
ছোট ছেলের মাথা ভাল। ভালো মাথাকে আরো ভাল করতে খুলনা শহরে পাঠান জিলা স্কুলে পড়ার জন্য।
পদ্মনগর থেকে খুলনা– দূর পথ। বাড়ি থেকে পাঁচ মাইল ভাঙ্গা কাদা পথ পায়ে হেঁটে বাগেরহাট; সেখান থেকে রেলগাড়িতে খুলনা।
ছেলেকে শহরে পাঠিয়ে মন খারাপ আমিনা খাতুনের। অপেক্ষায় থাকেন শনিবারের। একদিনের জন্য কাছে পান ছেলেকে।
পরদিন ছেলের চলে যাওয়ার সময় বাড়ি থেকে বেরিয়ে ছেলের সাথে সাথে ছোট খাল পর্যন্ত আসেন আমিনা খাতুন। সাঁকো পেরিয়ে এগিয়ে যায় আদরের ছেলে তার। ভেজা চোখে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন তিনি। পুরান বাড়ির বাগানের বাক পেরোলে দৃষ্টির আড়ালে চলে যায় ছেলেটি। আমিনা খাতুন যখন বাড়ির দিকে ফেরেন, চোয়াল বেয়ে তাঁর গড়িয়ে পড়ছে উষ্ণ জলধারা।

ক্রমে ছেলে তাঁর শহুরে হয়ে ওঠে। প্রতি সপ্তাহে আর পদ্মনগর ফেরা হয় না তার । আমিনা খাতুনের কষ্ট বাড়ে। ছেলের অপেক্ষায় তাঁর পথ চাওয়া চলতে থাকে।
ছেলে আরো দূরে যায়। স্কুল পার করে কলেজ পড়তে যায় ঢাকায়– ঢাকা কলেজ, সেখান থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এর মাঝে মাকে না জানিয়ে যুদ্ধে যায় ছেলে– মুক্তিযুদ্ধে। আমিনা খাতুন হতবাক। বড় হয়েও যে ছেলে মাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকত; কোথায় সে, কিভাবে আছে, আছে কি নেই; কিছুই জানেন না তিনি। যুদ্ধ শেষে ছেলে ফেরে তাঁর কোলে।
লেখা পড়া শেষে ছেলে চাকুরিতে ঢোকে– সরকারি চাকরি। তখন থেকে আমিনা খাতুনের ছেলে পুরোদস্তুর শহুরে হয়ে যায়। পদ্মনগরের কথা, মায়ের কথা মনে হলেও মাকে দেখতে পদ্মনগর যায় কালেভদ্রে। আমিনা খাতুনের কষ্ট বাড়ে।
আরো পরে জগৎসংসারের নিয়ম অনুযায়ী ছেলেকে বিয়ে করান আমিনা খাতুন। কর্মজীবি স্ত্রীকে নিয়ে ঢাকা শহরে সংসার পাতে তাঁর সর্বকনিষ্ঠ সন্তান।
ততক্ষণে আমিনা খাতুনের জীবনের বাক পরিবর্তন হতে শুরু করেছে। আর্থিক অনটন কিছুটা কমলেও ছেলের দেখা মেলে আরো কম। ছেলে-বৌমা তাঁকে টানে শহরে; কিন্তু শহরে তিনি “জলের মাছ ডাংগায়” এর মত অবস্থা। স্বামীর ভিটা আর গ্রামীন মুক্ত জীবন সব সময় টেনে রাখে তাঁকে। গ্রামই যে তাঁর ঠিকানা, পরিচিতি, প্রতিপত্তি। শিক্ষক স্বামীর স্ত্রী হিসেবে এলাকায় তাঁকে সবাই শ্রদ্ধা করে, মানে।

সেবার তিনি ঢাকা এলেন সম্ভবত ছিয়াশি সালের শেষ ভাগে। মাস না যেতেই স্বাভাবিক নিয়মে শুরু করলেন ” বাড়ি কখন পাঠাবি “। আমিও পাঠাচ্ছি পাঠাবো করে যথারীতি কালক্ষেপন করে চললাম।
আমিনা খাতুনের জীবনে এর পরের দিনগুলো দ্রুত ঘটে যাওয়া ঘটনাবহুল। একদিন আমার বাসায় পড়ে গিয়ে তাঁর কোমরের হাড় ভেঙে যায়। ডাক্তার অভয় দেন অপারেশন করলে সুস্থ হবেন তিনি। অপারেশন হলো, পরবর্তী পরীক্ষায় দেখা গেল ভাংগা হাড় সুন্দর মত জোড়া লাগছে। পুরোপুরি সুস্থ হওয়ার জন্য হাসপাতাল থেকে গেলেন আমার ভাইয়ের বাসায় ।
কিন্তু ঘটনা ঘটল অন্যরকম। ক্রমশঃ তিনি দুর্বল, নিস্তেজ হয়ে পড়লেন। আবার তাকে নিয়ে গেলাম ডাক্তারের কাছে। ডাক্তার সামান্য পরীক্ষা করেই বললেন, “আশা নেই”; লিভার ক্যানসার, শেষ পর্যায়ে। সেটা ১৯৮৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম দিকে।
এরপর পদ্মনগর পাঠানোর জন্য আর অনুনয় করতে হলো না আমিনা খাতুনকে; কথা বলার শক্তি ও তখন তাঁর প্রায় নেই। ছেলেই তাঁকে দ্রুততম সময়ে পাঠিয়ে দিল।
দুদিন না যেতেই বাড়িতে যাওয়ার ফোন। ভাই আর আমি ছুটলাম বাড়িতে। ভেবেছিলাম আমাকে দেখে উজ্জীবিত হবে মা। কিন্তু আমাকে চিনতে পারল কি না সন্দেহ। অবশ্য আমার প্রবাসী বড় ভাই এর নাম আওড়াচ্ছিলেন বার বার।
যে ঘরে মা শোয়া, সেই ঘরের বারান্দায় থাকি আমি। জানালা দিয়ে ভেতরে তাকাই। সেখান থেকে মায়ের কাতরানি আর আমার বোনসহ অন্যদের দোয়া দরুদ পড়ার শব্দ আসে আমার কানে। একরাতে ঘরের ভেতর থেকে সমস্বরে আর্তনাদ শুনে আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়। তখন রাত একটা, ১৯৮৭ সালের ১৬ই ফেব্রুয়ারি।

(মা দিবস উপলক্ষে)

লেখক: সাবেক ডিডিজি(নিঊজ),বিটিভি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here