প্যারিস প্যাচাল

0
92

মাহমুদ হাফিজ:

এক
প্যারিসের এক রেলস্টেশন থেকে রাত আটটার দিকে ঢাকায় রিপোর্ট পাঠাবো। বছর বিশেক আগের ঘটনা। হন্যে হয়ে খুঁজছি ফ্যাক্স-ফোনের দোকান। প্যারিসের রাস্তায় কাউকে জিজ্ঞেস করলে ইংরজি বলতে চায় না। বুঝলেও উত্তর দেয় ফ্রেঞ্চভাষায়। পথচলতি ইংরেজ পর্যটকের কাছে জানা গেল, স্টেশনেই স্বয়ংক্রিয় মেশিন বসানো, পয়সা ফেলে ফ্যাক্সের ব্যবস্থা, মানে ফেলো কড়ি, মাখো তেল। চেষ্টা করে বিফলমনোরথ।
অদূরে তারকা হোটেল। প্রয়োজনের কথা সবিনয়ে বলতেই রিসেপসনিষ্ট মহিলা আপাদমস্তক দেখে ফ্রেঞ্চ ভাষায় খেঁকিয়ে উঠলেন। ফ্রেঞ্চের ভাষান্তর অন্য আগন্তুকের কাছ থেকে জানলাম। এখানে বেশি …বাইরে কম। তুমি ইন্ডিয়ান, বাইরে তোমার জন্য ভাল। হেঁটে হেঁটে এক গলির মুখে নিশিকন্যাদের ইঙ্গিতপূর্ণ অভ্যর্থনা মিললে বুঝতে বাকি রইল না, ফ্যাক্স বলতে রিসেপশনিস্ট কি বুঝেছেন !
সাক্ষী সাংবাদিক মোল্লাহ আমজাদ হোসেন, লন্ডনস্থ বাংলাদেশ দুতাবাসের প্রেসমিনিস্টার বন্ধু আশিক চৌধুরী।
দুই.
ক’বছর পরের কথা। গভীর রাতে কোনমতে প্যারিসের সিংহ (গার দ্য লিঁয়ো) রেলস্টেশনের অদূরে হোটেল মিগননে অর্ধ রাত কাটালাম। নিচতলায় বাসা, ওপরের তালাগুলোতে হোটেল করে চালান এক বয়স্ক মহিলা। ভোরবেলা গেলাম মালয়েশিয়া এয়ারলাইন্সের অফিসে ফেরার টিকেট বদল করতে। ঘোরাঘুরি করে সন্ধ্যায় ফিরে দেখি, কাপড়চোপড়- লাগেজপত্তর স্টোররুমে, রুমটি ভাড়া দেয়া। সে রাতে পথে নেমে ট্যাক্সিওলাকে গন্তব্য বলতে পারিনি, ট্যাক্সিওলার ফোন থেকেই একবন্ধুর নম্বরে ফোন করে তাঁকে ধরিয়ে দিলাম।
পরের রাতে শিল্পী শাহাবুদ্দিন এর ‘প্লাজা ডি ইতালি’র বাসায় গেলাম জনকন্ঠ পত্রিকার জন্য সাক্ষাৎকার নিতে। মেট্রোস্টেশন থেকে শিল্পীর অনুজ নাজিমুদ্দিন আমাদের গাইড করে নিয়ে গেলেন। শিল্পীস্ত্রী সাংবাদিক আনা ইসলাম, দুকন্যা চিত্র ও চর্যাসহ ডিনার খেয়ে ফিরলাম গিমুখী এলাকায়। পরদিন ল্যুভর মিউজি্য়ামে ভিঞ্চির মোনালিসা দেখতে গিয়ে ছোট্ট সাইজ দেখে হতাশ হলাম। ভরজীবন বড় পোস্টার দেখে মনে গাঁথা ছিল এক, দেখলাম আরেক। পরদিন জুরিখ ফেরার পথে আরেক ট্যাক্সিওলার টিপস দিতে গিয়ে সফরসঙ্গী ডাবলুর ট্রেন মিস।
তিন.
বছর আটেক আগে বন্ধুকে নিয়ে শার্লে দ্য গল বিমানবন্দরে নামছি বলে সদ্যনিযুক্ত রাস্ট্রদূত দুলাভাই বাসায় নেয়ার ব্যবস্থা না করে হোটেল ভাড়াসহ এয়ারপোর্ট থেকে রিসিভের প্রটোকল নিযুক্ত করেছেন। ফ্রাংকফোর্ট থেকে লুফথান্সার ফ্লাইট ছাড়ার আগে চেইনস্মোকার সফরসঙ্গী আরিফ ফুঁকতে গিয়ে বিমান ফেল করেছে। শার্লে নেমে দূতাবাসের প্রটোকল কর্মকর্তা হাবিব সাহেবকে পেলেও আরিফের জন্য পাকা ঘন্টা দুই লস।

সব পরিকল্পনা ভেস্তে দিয়ে প্রটোকলে হোটেল পর্যন্তই পৌঁছানো গেল। বেলা পাট চুকানার আগে দর্শনীয়ের দরজা দরজায় তালা। হোটেলে পৌঁছে দেখি, রাজকীয় ব্যবস্থা। প্রটোকল কর্মকর্তা বিদায় হওয়ার পর চেক ইন স্লিপে সই করিয়ে কীকার্ড ধরিয়ে পাঁচতারকার লাস্যময়ীরা যখন টাকার অঙ্ক বললো, তখন বুঝলাম-দুলাভাই ফতুর করার সব এন্তেজাম পাকা করে রেখেছেন। একটু আগের পুলকিতভাবে মূহুর্তেই মিইয়ে গেল। পরদিন গাট্টি বোচকা বেঁধে বিমানবন্দর এলাকা থেকে গিয়ে উঠলাম গার্দে নর্দ স্টেশনের ৬০ ইউরোর হোটেলে।
চার.
এই তো হলো ক’বছর।
দুলাভাই এখনও রাষ্ট্রদূত। আগেরবারের ক্ষতি পোষাতে এবার বাড়ির এক ফ্লোরের পুরোটা ছেড়ে দিয়েছেন। পাঁচতারকার মতোই এন্তেজাম, বিনা পয়সায়। পতাকাওলা গাড়িতে তার সঙ্গে ঘুরেও বেড়ানো যাচ্ছে। বিপদ হলো স্বনামখ্যাত প্রবাসী ব্যবসায়ী কাজী এনায়তউল্লাহ’র সাক্ষাৎকার নেয়ার পর। কথায় কথায় বেরিয়ে এলো ছাত্র অবস্থায় ভাগ্যানুসন্ধানে এসে গাড়িতে মালামাল সাপ্লাইয়ের সময় তাঁর বোঝা বহনের কথা। এরকম ত্যাগ তিতিক্ষার মধ্য দিয়ে আজকের পর্যায়ে এসেছেন। সঙ্গে সঙ্গে মাথায় এলো হেডিং- ‘মুটে থেকে মিলিওনিয়র’, ‘কুলি থেকে কোটিপতি’ ইত্যাদি। এরকম হেডিং হলে ভক্ত-অনুরাগীরা চটবে বলে বললাম এভাবে লেখা যাবে না। ইনু ভাই অভয় দিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী চা বিক্রেতা ছিলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্ণর (তৎকালীন) রাখাল ছিলেন…ইত্যাদি উদাহরণ দিতে লাগলেন। বাংলানিউজে প্রকাশ হওয়ামাত্র বিশ্বজুড়ে ভাইরাল। সেদিনই প্যারিসের পাট গুটালাম। কাতার এয়াওয়েজের ব্রান্ড এয়ারবাস থ্রিএইটটির সুপরিসর আসনে দোহা পৌঁছে হাঁফ ছাড়ি। মোবাইলে বকাবকি চলছেই। ইনু ভাই স্বয়ং বড় এক স্বীকারোক্তিমুলক কলাম লেখায় রক্ষে ! এমনকি ওই লেখায় তিনি এও বলেন, কুলি থেকে কোটিপতির গল্পে বাংলাদেশের মুটে-মজুর-কুলিরা যদি সম্মানিত বোধ করে তাহলে আমি নামের আগে পরে কুলি শব্দ ব্যবহার করতেও দ্বিধা করবো না। এই লেখা ফলাও হলে চারদিকে ইনু ভাই’র ধন্য ধন্য পড়লো। দু’দিন আগেও ইনু ভাই’র ভক্তদের কাছে ভুয়া ছিলাম, পরে আসল হলাম।
প্যারিস আমার যম। বার বার ভুগিয়েছে।
তারপরও শিল্প-সংস্কৃতির টানে ফিরে ফিরে যাই। (চলবে)

লেখক: সাংবাদিক

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here