পরম্পরা।। আব্বা ফিরেছেন ফের সায়াফ আলফাজ নামে

0
107

মাহমুদ হাফিজ:

আমার ল্যাপটপে সদ্য খোলা ফোল্ডারে জমছে পৃথিবীতে নবাগত এক ফুটফুটে শিশুর রোজকার ছবি ও ভিডিও। তার সম্পর্কিত সমুদয় লেখাজোঁকা। তিনশব্দে সেভ করা ফোল্ডারের মাঝের শব্দ ‘আলফাজ’,প্রথমে শায়াফ, শেষে মাহমুদ। যার নামে ফোল্ডার তার পুরো নাম ‘শায়াফ আলফাজ মাহমুদ’। পিতা পল্লব মাহমুদ, মাতা শায়েলা জেরিন। মাহমুদ পরিবারে তিনি নতুন আগন্তুক। শায়াফ এর পর মাহমুদ এর আগে ‘আলফাজ’ শব্দ সবসময় সেন্টারে দেখায়। পর্দায় ভেসে থাকা শব্দটি ঝট করে চোখে পড়ে গেলে আব্বার কথা মনে পড়ে বড়। আমাদের ধর্ম পুন:জন্মে বিশ্বাস করে না, তবুও ধন্দ জাগে, আব্বা কী তবে ফিরে এলেন নতুন আগন্তুকের বেশে?
ছোট্ট একটুকু শরীর। তিনি তাকান কিন্তু দ্যাখেন কী না জানি না, তিনি তরল দুগ্ধ খান-স্বাদ পান কী না জানি না, তিনি নড়াচড়া-লম্পঝম্প করেন হাত পা ছুঁড়ে, বুঝে করেন কী না জানি না। কথা বলেন না, হাঁটেন না। তাঁর অফিস নেই। কাজ নেই। নেই দুনিয়াবি দেনদরবার, উপার্জনের চিন্তা। দিনরাত তিনটি মাত্র কাজে তিনি ব্যপৃত খাওয়া, শুয়ে শুয়ে ঘুম আর প্রাকৃতিক কর্ম। তিনকর্মেই চলে যায় তার চব্বিশ প্রহর। তাকিয়ে থাকেন ফ্যাল ফ্যাল। কোন অনুভূতিতে হাসেন বা কাঁদেন বোঝা যায় না। তবুও এ পরিবারে তিনিই আমাদের সকাল, দুপুর, রাতে আলোচনা-আলাপের কেন্দ্রে, সমস্ত মনোযোগের কেন্দ্রে, ভালোবাসা-ভালোলাগার কেন্দ্রে। আত্মীয়বন্ধুদের সঙ্গে সম্পর্ক ও সুবাদের পাল্টেছে নাম, তা এখন উচ্চারিত তার নামেই- যেমন: সায়াফ আলফাজের দাদা, সায়াফ আলফাজের দাদী, সায়াফ আলফাজের নানা, সায়াফ আলফাজের নানী। এভাবে বোন, ভাই, চাচা, মামা, খালু, খালা, চাচী, মামী, ফুফু ইত্যাদি।
আমার দাদা গোলাম রহমান পন্ডিতের জৈষ্ঠ্যপুত্র আব্বা আলফাজউদ্দিন বিশ্বাস জান্নাতবাসী হয়েছেন আড়াইদশক আগে। তাঁর কথা আমরা‌ই ভুলতে বসেছি; আত্মীয়স্বজনগণ- পাড়া প্রতিবেশী ভুলেই গেছেন। দাদী বলতেন, আলফাজ এসেছে আরবী ‘লফজ’ শব্দ থেকে। লফজ মানে কথা,শব্দ, ভাষা। বহুবচনে আলফাজ মানে কথারা। আজ প্রজন্ম পরম্পরায় আব্বার নামটি আমাদের মুখে ফিরে এসেছে আবার। মুখ থেকে মুখে এই ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হয়ে আদৌ কি তা যাচ্ছে আব্বা, কিংবা সদ্যপ্রয়াত আম্মার কাছে? উত্তর আমাদের কাছে নেই, কারও কাছে নেই। মৃত্যুর পর কেউ আর ফেরেনি কোনদিন, বলেনি পারঘাটাটি কেমন। মানুষ বিকট শব্দের শকট বানিয়ে আকাশ ফুঁড়েছে, কিন্তু এই প্রশ্নে এসে হয়ে পড়েছে নিতান্ত নিরব।
কম্পিউটার ফোল্ডারের আলফাজ শব্দ দেখে মনে উথলিয়া ওঠে আব্বার সঙ্গে স্মৃতিবিস্মৃতির শৈশব-কৈশোর। মায়ের কোল ছাড়া হয়ে আব্বার কোললগ্ন হয়ে গল্প শুনে পার করেছি কত শত রাত ! তাঁর কাঁধে চেপে জীবনের প্রথম মেলা-আড়ং থেকে নকশা করা মাটির হাড়িতে চিনিখাজা, খই কিনেছি। মেলার সস্তাদামের রঙ করা মাটির পুতুল, ঘুড়ি কিনে পৃথিবীকে হাতের মুঠোয় পেয়ে আনন্দিত হয়েছি। জীবনের প্রথম শুনেছি গ্রামীণ হাটের অবিরাম গুঞ্জন। রেললাইন ধরে হেঁটে যাওয়ার সময় আব্বার কাঁধ থেকেই জীবনের প্রথম দেখেছি রেলগাড়ির কু ঝিকঝিক কু ঝিকঝিক। জীবনে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার আগেই তিনি চলে গেলেন সন্তানের কোন সেবার সুযোগ না দিয়েই। গেলেন, কোথায় গেলেন আব্বা ?
পিতৃহারা-মাতৃহারা হয়ে আজ যখন আপন করে নিতে চলেছি এতিমজীবন- নি:সঙ্গ-এতিমের দু:খ ভোলাতে তখন শোনা যায় নতুনের পদধ্বণি, পৃথিবীতে এসে গেছে আরেক আলফাজ, শায়াফ আলফাজ।
‘যে যায় সে চলে যায়, ফেলে রেখে যায় পৃথিবীর মায়া-মোহ-গীতি, সতত সুখ ও দু;খের স্মৃতি, নীড়ে ফেরা পাখির মতো যে যায় সে ঘরে ফিরে যায়’। আব্বা ফিরে গেছেন নীড়ে, ফেলে গেছেন স্মৃতি-বিস্মৃতির খাম, নিজের নাম। সে নাম খ্যাত হোক শায়াফ আলফাজ নামে। মাহমুদ? সে তো আমারই নাম।

পরিচিতি: সাংবাদিক ও লেখক

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here