পরিবহন, কারখানা বন্ধ করলে জেল জরিমানার বিধান

0
51

বাংলা খবর ডেস্ক:
অত্যাবশ্যকীয় সেবা খাতে বেআইনিভাবে ধর্মঘট ডাকলে বা ওই ধর্মঘটে সমর্থন দিলে কারাদণ্ডের বিধান রেখে অত্যাবশ্যকীয় পরিষেবা আইন ২০২২ চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। অত্যাবশ্যকীয় সেবা খাতে থাকছে জল, স্থল ও আকাশপথে যাত্রী এবং পণ্য পরিবহনও। ফলে সরকার অত্যাবশ্যকীয় ঘোষণা করার পর চাইলেই পরিবহন ধর্মঘট ডাকা বেআইনি হবে।

প্রস্তাবিত আইনে শিল্পপ্রতিষ্ঠান লে-অফ বা বন্ধ করার বিষয়েও শাস্তির বিধান রাখা আছে।

প্রস্তাবে বলা হয়েছে, কেউ শিল্পপ্রতিষ্ঠান লে-অফ করলেও সরকার যদি মনে করে তা আইনসিদ্ধ বা ন্যায়সংগত হয়নি, তাহলে সরকার হস্তক্ষেপ করতে পারবে।
গতকাল সোমবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে এ আইন অনুমোদন দেওয়া হয়। সংসদ অনুমোদন করলে এটি গেজেট হয়ে আইনে পরিণত হবে। মন্ত্রিসভার বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বৈঠক শেষে সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদসচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন।

মন্ত্রিপরিষদসচিব বলেন, অত্যাবশ্যক সেবার বিষয়ে যদি কোনো অচলাবস্থা তৈরি হয় সে ক্ষেত্রে সরকার হস্তক্ষেপ করতে পারবে। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের কল্যাণে সরকার যেভাবে নির্দেশ দেবে, সেভাবে সব পরিচালিত হতে হবে।

সরকার কোনো সেবাকে ছয় মাসের জন্য অত্যাবশ্যকীয় ঘোষণা করতে পারে। প্রয়োজনে এই সময় আরো ছয় মাস বাড়াতে পারবে।

যাত্রী ও পণ্য পরিবহন সেবা:

প্রস্তাবিত আইন অনুযায়ী, সেবা অত্যাবশ্যকীয় ঘোষণার পর পরিবহন ধর্মঘট ডাকলে সংশ্লিষ্টদের শাস্তির আওতায় আনা যাবে। তবে পরিবহন খাতের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এটা মৌলিক অধিকারের লঙ্ঘন।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি মসিউর রহমান রাঙ্গা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার নীতি মেনেই আমাদের সংগঠন পরিচালিত হয়। ধর্মঘটের মতো কর্মসূচির ক্ষেত্রে আমাদের যুক্তিসংগত কারণ থাকে এবং আমরা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে তিন দিন আগে জানাই। আমি মনে করি, সরকার যেমন এজাতীয় আইন করতে পারে, তেমনি নিয়ম মেনে হরতাল করাও দোষের কিছু না। ’

লঞ্চ মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌচলাচল সংস্থার সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকুর রহমান পাটোয়ারী বলেন, ‘অনেক সময় দাবি আদায়ে ধর্মঘটের বিকল্প থাকে না। আমরা ধর্মঘট করার আগে সুনির্দিষ্ট কারণ দেখিয়ে আলটিমেটাম দিয়ে থাকি। আলটিমেটামে দাবি আদায় হলে ধর্মঘটের দরকার হয় না। এখন যদি আইনে বলা হয়, ধর্মঘটই করা যাবে না, তাহলে বলব আমাদের মৌলিক অধিকার। ’

প্রস্তাবিত বিধানকে শ্রম আইনবিরোধী বলছেন দেশের সবচেয়ে বড় পণ্য পরিবহনের সংগঠন বাংলাদেশ ট্রাক কাভার্ড ভ্যান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক রুস্তম আলী খান। তিনি বলেন, ‘আইনটি সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে আমরা কথা বলব। ’

তবে সংবাদ ব্রিফিংয়ে মন্ত্রিপরিষদসচিব সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, সব আইন যাচাই-বাছাই করেই আইনটির খসড়া করা হয়েছে। এর পরও অন্য আইনের সঙ্গে যদি কোনো বিরোধ দেখা দেয়, তাহলে অত্যাবশ্যকীয় পরিষেবা আইন প্রাধান্য পাবে।

বেআইনি লে-অফ হলে হস্তক্ষেপ:

আনোয়ারুল ইসলাম জানান, প্রস্তাবিত আইনটিতে ১৪টি ধারা আছে। সরকার কোন বিষয়গুলোকে অত্যাবশ্যকীয় পরিষেবা হিসেবে ঘোষণা করবে, তা ৪ নম্বর ধারায় বলা আছে। ৫ ধারায় জরুরি প্রয়োজনে চাকরিস্থল ত্যাগ না করতে নির্দেশ দেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। আরেকটি ধারায় বলা হয়েছে ধর্মঘট, লকডাউন বা লে-অফ নিষিদ্ধ করার কথা। অনেক সময় শিল্পপ্রতিষ্ঠান লে-অফ বা লক-আউট করা হয়। কিন্তু সরকার যদি মনে করে এটা ন্যায়সংগত হয়নি, তাহলে হস্তক্ষেপ করতে পারবে।

মন্ত্রিপরিষদসচিব বলেন, প্রতিষ্ঠানের মালিক যদি বেআইনি লে-অফ ঘোষণা করেন, সে ক্ষেত্রে অনূর্ধ্ব ছয় মাসের কারাদণ্ড এবং অনূর্ধ্ব এক লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা দুটিই করা যাবে। কেউ যদি এ ধরনের কাজে প্ররোচনা দেন তাহলে মূল অপরাধে যে শাস্তি, একই শাস্তি তিনিও পাবেন। সরকারি অফিস বা কর্মকর্তার ক্ষেত্রে বিভাগীয় ব্যবস্থাও নেওয়া যাবে।

জানতে চাইলে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী তানজীব-উল আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, কোনো প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে এ ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হলে বুঝতে হবে সরকার কোনো বিশেষ পরিস্থিতিতে আছে। এর পরও বলতে হবে, কেউ যদি লোকসানে পড়ে কারখানা বন্ধ করে দেয় এবং সরকার এই আইনের দ্বারা তাকে তা চালাতে বাধ্য করে, সে ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে যথাযথ ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। ক্ষতিপূরণ না দিয়ে এমন পদক্ষেপ নিলে তা অসাংবিধানিক হবে। সংবিধানে নাগরিকদের সম্পদের অধিকার দেওয়া হয়েছে।

অত্যাবশ্যকীয় পরিষেবা খাতগুলো:

যেসব খাতের সেবাকে সরকার অত্যাবশ্যকীয় ঘোষণা করতে পারবে, সেগুলো হলো ডাক, টেলিযোগাযোগ, ইন্টারনেট, তথ্য-প্রযুক্তিসহ সব ডিজিটাল সেবা, ডিজিটাল আর্থিক সেবা, বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহ, বিমানবন্দর পরিচালনা, স্থল ও নদীবন্দর পরিচালনা, কাস্টমসের মাধ্যমে কোনো পণ্য ও যাত্রীর পণ্য ছাড় করা, সশস্ত্র বাহিনীর কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পর্কিত কোনো কার্যক্রম, প্রতিরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় পণ্য বা মালপত্র উৎপাদনের সঙ্গে সম্পর্কিত কার্যক্রম বা খাদ্যদ্রব্য ক্রয়, সংগ্রহ ও সংরক্ষণের সঙ্গে সম্পর্কিত কার্যক্রম।

কোনো সেবাকে অত্যাবশ্যকীয় ঘোষণা করার পর কেউ তা না মানলে সাধারণভাবে তার ছয় মাসের কারাদণ্ড ও ২৫ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে আইনে। আবার বেআইনি ধর্মঘট চলমান রাখার জন্য যদি কেউ সমর্থন দেয় তাহলে এক বছরের কারাদণ্ড ও অনূর্ধ্ব ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা যাবে।

খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, এ ছাড়া দেশের প্রতিরক্ষার উদ্দেশ্যে প্রয়োজনীয় পণ্য বা মালপত্র উৎপাদনের কাজে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত পরিষেবা; খাদ্যদ্রব্য ক্রয়, বিক্রয়, সংগ্রহ, সংরক্ষণ, মজুদ বা বিতরণকাজে নিযুক্ত সরকারি মালিকানাধীন বা সরকার কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত কোনো প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত পরিষেবা; হাসপাতাল, ক্লিনিক, স্বাস্থ্যসেবা বা অনুরূপ প্রতিষ্ঠান এবং ডিসপেনসারি সম্পর্কিত কোনো পরিষেবা; ওষুধ উৎপাদন, সরবরাহ, বিপণন, ক্রয়-বিক্রয়সহ এসব কাজে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠান, সংস্থা বা কারখানার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত পরিষেবা; রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান পরিষেবা; তেলক্ষেত্র, তেল শোধনাগার, তেল সংরক্ষণ এবং পেট্রোলিয়াম বা পেট্রোলিয়ামজাতীয় পদার্থ উৎপাদন, পরিবহন, সরবরাহ ও বিতরণের কাজে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত পরিষেবা এবং টাঁকশাল ও নিরাপত্তামূলক মুদ্রণকাজের সঙ্গে সম্পর্কিত পরিষেবাকে সরকার গেজেট দিয়ে অত্যাবশ্যক পরিষেবা হিসেবে ঘোষণা করতে পারবে।

এর বাইরেও জনকল্যাণমূলক কোনো সেবা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলে বা হওয়ার আশঙ্কা থাকলে সেই সেবা; জননিরাপত্তা বা জনগণের জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজনীয় সরবরাহ ও রক্ষণাবেক্ষণসেবা অত্যাবশ্যকীয় ঘোষণা করা যাবে।

২০২১ সালের ৪ অক্টোবর মন্ত্রিসভা এই আইনের খসড়ার নীতিগত অনুমোদন দিয়েছিল। আইনটি এখন চূড়ান্ত অনুমোদনের মাধ্যমে সংসদে যাবে। সংসদে পাস হলে তা গেজেট আকারে জারি করা হবে।

ডিজিটাল জরিপে বালুমহাল নির্ধারণ ছাড়া ইজারা নয়:

এ ছাড়া ডিজিটাল জরিপের মাধ্যমে বালুমহালের স্থান ও পরিধি নির্ধারণ করার পর কেবল ইজারা দেওয়ার বিধান রেখে ‘বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা (সংশোধন) আইন, ২০২২’-এর খসড়ার চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা।

মন্ত্রিপরিষদসচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম জানান, এখন থেকে জেলা প্রশাসক ও ভূমি মন্ত্রণালয় প্রত্যেকটি বালুমহালের জন্য বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড অথবা বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডাব্লিউটিএ) কাছ থেকে চাহিদা নেবে। তারা ডিজিটাল সার্ভে করে জেলা প্রশাসক বা মন্ত্রণালয়কে জানিয়ে দেবে কোথায় বালুমহাল আছে, কতটুকু তার পরিধি, কী পরিমাণে বালু উত্তোলন করা যাবে। তার ওপর ভিত্তি করে বালুমহালগুলো এক বছরের জন্য লিজ নেওয়া যাবে, এটাই হলো আইনের মূল বিধান।

সংরক্ষিত বনাঞ্চলের গাছ কাটা যাবে না ২০৩০ সাল পর্যন্ত:

দেশের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় সংরক্ষিত ও প্রাকৃতিক বনাঞ্চলের গাছ কাটার ওপর আরোপিত বিধি-নিষেধ ২০৩০ সাল পর্যন্ত বহাল রেখেছে মন্ত্রিসভা।

মন্ত্রিপরিষদসচিব বলেন, জীববৈচিত্র্য রক্ষার্থে ২০৩০ সাল পর্যন্ত রিজার্ভ ফরেস্টের কোনো গাছ কাটা যাবে না। কাটা যাবে সামাজিক বনায়নের গাছ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here