এইচএসসি পরীক্ষাপ্রশ্নফাঁস বন্ধে নানা উদ্যোগ তবুও সফলতা নিয়ে সংশয়

0
115

এসএম মামুন হোসেন
পরীক্ষার হলে কয়েকজন শিক্ষার্থী -ফাইল ছবিপ্রশ্নফাঁস নিয়ে তীব্র সমালোচনার মুখে এবার এইচএসসি পরীক্ষাকে সামনে রেখে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বেশকিছু উদ্যোগ নেয়া হলেও এর কোনোটিই অপরাধ দমনে যথেষ্ট নয় বলে মনে করছেন শিক্ষাবিদরা। তারা বলছেন, প্রশ্নফাঁসের মূল হোতাদের চিহ্নিত এবং এর উৎসের সন্ধান করতে না পারলে এসব উদ্যোগ ব্যর্থ হতে পারে। প্রশ্নফাঁস বন্ধে তারা সুনির্দিষ্ট ও কার্যকরী পদক্ষেপ দাবি করেন।
প্রসঙ্গত, ২৫ মার্চ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের এক জরম্নরি বৈঠকে বেশকিছু সিদ্ধান্ত্ম নেয়া হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরম্নত্বপূর্ণ; পরীক্ষা শুরম্নর ২৫ মিনিট পূর্বে লটারির মাধ্যমে সেট নির্ধারণ করে সেই নির্দিষ্ট সেটে পরীক্ষা গ্রহণ।
তবে শিক্ষাবিদরা বলছেন, এর আগেও পরীক্ষা শুরম্নর ৩০ মিনিট আগে প্রশ্নের সিলগালা খোলার নিয়ম ছিল। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারাই স্বীকার করেছেন, নানাবিধ কারণে এর আগেই প্রশ্ন খুলতে হয়। এ ছাড়া প্রত্যন্ত্ম অঞ্চলে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আগে প্রশ্ন খুললে সেটা দেখভাল করার মতো লোকবলও সেখানে উপস্থিত রাখা সব সময় সম্ভব হয় না। আবার যে সময় কেন্দ্রে প্রশ্ন পৌঁছানোর কথা, রাস্ত্মাঘাটের দুরাবস্থার কথা মাথায় রেখে এর আগেই সেখানে প্রশ্ন পাঠাতে হয়। অন্যদিকে সেট একাধিক হলে যেসব সেটেরই প্রশ্নফাঁস হয়ে যাবে না, এরও নিশ্চয়তা পাচ্ছেন না শিক্ষা-সংশিস্নষ্টরা।
এদিকে আগামী এইচএসসি পরীক্ষায় শতাধিক কেন্দ্র কমিয়ে আনার যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, এটিও প্রশ্নফাঁস ঠেকাতে তেমন কোনো কাজে আসবে বলে মনে করেন না শিক্ষাবিদরা। তাদের ভাষ্য, ট্রেজারি থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত্ম প্রশ্নপত্র নিয়ে যেতে কঠোর নিরাপত্তার কথাও বলা হয়েছে। কিন্তু অতীতেও একই ধরনের নিরাপত্তা দিয়ে প্রশ্ন স্থানান্ত্মরিত হলেও প্রশ্নফাঁস ঠেকানো সম্ভব হয়নি। এ ছাড়া পরীক্ষা শুরম্নর ৩০ মিনিট আগে সব শিক্ষার্থীর কেন্দ্রে প্রবেশের কথা বলা হলেও মানবিক কারণে সেটা বাস্ত্মবায়ন সম্ভব হয়নি। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকার মতো ব্যস্ত্ম শহরে যানজটের কারণে এ বিষয়ে ছাড় দিতে হয়েছে। এ ছাড়া গ্রামাঞ্চলে দূরদূরান্ত্ম থেকে আসা শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন কারণে দেরি হতে পারে বলেই মনে করেন শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা।
সরকারের এসব উদ্যোগের বিপরীতে যেসব সংঘবদ্ধ চক্র প্রশ্নফাঁসের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত, তাদের শনাক্ত করার ওপরই বেশি জোর দিচ্ছেন অভিভাবক ও শিক্ষাবিদরা। নিরাপত্তা বিশেস্নষকরাও মনে করেন, অপরাধের মূলে আঘাত না করে কোনোভাবেই অপরাধ বন্ধ করা যায় না। ফলে প্রশ্নফাঁস সম্পূর্ণভাবে ঠেকাতে হলে সরাসরি প্রশ্নফাঁসের সঙ্গে জড়িতদের সবার আগে খুঁজে বের করতে হবে। কারণ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষকদের হাত থেকে প্রশ্নফাঁস হওয়ার অভিযোগের চেয়ে প্রশ্নছাপা, পরিবহন ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টদের মাধ্যমে সে কাজ হয়েছে বলে অভিযোগের পক্ষে বেশি প্রমাণ রয়েছে। ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক প্রস্তুতির পাশাপাশি প্রশ্ন প্রণয়ন, ছাপা, পরিবহন এবং সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমের ওপর কঠোর নজরদারি ছাড়া প্রশ্নফাঁস ঠেকানো যাবে না বলে অভিমত তাদের।
এ ছাড়া প্রশ্নফাঁসের পর যারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে, সেটা সারাদেশে ছড়িয়ে দিয়েছে তাদের বিরম্নদ্ধে কোনো শাস্ত্মিমূলক ব্যবস্থা না নেয়ায় বিভিন্ন মহল থেকে সমালোচনা হচ্ছে। কয়েক দিন আগেও কয়েকটি ফেসবুক গ্রম্নপ থেকে আগামী এইচএসসি পরীক্ষায় প্রকাশ্যে প্রশ্নফাঁসের হুমকি দিয়ে রেখেছে সাইবার অপরাধীরা।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. সৌমিত্র শেখর বলেন, ‘প্রশ্নফাঁস ঠেকাতে হলে অবশ্যই যারা এই অপরাধের সঙ্গে যুক্ত, তাদের সবার আগে খুঁজে বের করতে হবে। এ ছাড়া যেসব স্থান থেকে প্রশ্নফাঁস হয়েছে এবং যেসব সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম হতে সেটা সারাদেশে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে, তা নির্ধারণ করার কোনো বিকল্প নেই। কারণ, যত সেট প্রশ্নই করা হোক না কেন, এসব ব্যক্তি ও স্থান বের করে শাস্ত্মি দিতে না পরলে তারা কিন্তু বসে থাকবে না। তারা তাদের কাজ চালিয়ে যাবে এবং প্রশ্নফাঁস করতে যা যা করণীয়, এর সবই করবে। ফলে অপরাধীদের আগে শনাক্ত করে কঠোর ও দৃষ্টান্ত্মমূলক শাস্ত্মি নিশ্চিত করলেই প্রশ্নফাঁস বন্ধ হবে। অন্যথায় সরকারের সব চেষ্টাই ব্যর্থ বলে প্রতীয়মান হবে।’
সরকার যেসব উদ্যোগ নিয়েছে বা নিচ্ছে সেগুলো সমর্থনের পাশাপাশি অপরাধীদের শাস্ত্মি নিশ্চিতের ওপরই বেশি গুরম্নত্ব দেন এই শিক্ষাবিদ। তার মতে, প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার পাশাপাশি অপরাধ দমনে কিছু ক্ষেত্রে কঠোর হাতে শাস্ত্মি প্রদানও প্রয়োজন হয়ে পড়ে।
শিক্ষাবিদ মহিতুল ইসলাম এ বিষয়ে বলেন, ‘সরকারের নেয়া ব্যবস্থাগুলোর মধ্যে মূল অপরাধীদের বিরম্নদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কোনো কথা নেই। আসল অপরাধীদের বাদ দিয়ে কিভাবে প্রশ্নফাঁস ঠেকানো হবে, সেটা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। এ ছাড়া পরীক্ষার সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপর কিভাবে নজরদারি করা হবে, সেটা নিয়েও প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। কারণ, এ বিষয়ে সরকার কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি এবং যেসব উদ্যোগ নিয়েছে, এতেও এ বিষয়ে কোনো কথা বলা হয়নি।’
তার মতে, বর্তমান সময় মানুষের নৈতিক স্খলন চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। এই পরিস্থিতির উন্নয়নে শিক্ষা কারিকুলামের পাশাপাশি দেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক পর্যায় থেকে চিন্ত্মা ভাবনা করা দরকার বলে মনে করেন তিনি।
আগামী এপ্রিলের ২ তারিখে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নেবে এমন একজন শিক্ষার্থী সাদিয়া নাহারের বাবা মো. জামাল গোলদার বলেন, ‘এসএসসি পরীক্ষার সময় যা দেখলাম, এইচএসসিতেও যদি তাই হয় তবে তা দেশের শিক্ষাব্যবস্থার জন্য খুব খারাপ নজির হয়ে থাকবে। ঘোষণা দিয়ে প্রশ্নফাঁস হলেও মূল হোতাদের বিরম্নদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়ার কথা শুনিনি। সরকারের কাছে দাবি, এইচএসসিতে যেন এমন না হয়, তার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিন।’
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব সোহরাব হোসাইন বলেন, ‘আগামী ২ এপ্রিল শুরম্ন হতে যাওয়া এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা চলাকালে প্রশ্নফাঁস রোধে যেসব ব্যবস্থা নেয়া দরকার, সেটা নেয়া হচ্ছে। এরপরও বর্তমান প্রক্রিয়ায় প্রশ্নপত্র ফাঁস হবে না, এর শতভাগ নিশ্চয়তা দেয়া সম্ভব নয়।’
সংশিস্নষ্টরা মনে করেন, মন্ত্রণালয়ের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে এমন বক্তব্য দিয়ে দায় এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কারণ, দুষ্কৃতকারী রাষ্ট্রের ঊর্ধ্বে উঠতে পারে না। শিক্ষায় অপরাধ দমনে তাই তারা কর্তৃপক্ষকে আরও কঠোর ও দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখারও দাবি জানিয়েছেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here