প্রতিনিয়তই আমরা ভালো থাকার জন্য চেষ্টা করছি; কিন্তু আমরা কি ভালো থাকতে পারছি? ভালো থাকার প্রচেষ্টা যেন একটা যুদ্ধ। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আমরা এই ভালো আছি, এই নেই। যখন ভালো থাকি না তখন দুশ্চিন্তা আমাদের ঘিরে ধরে। আর যখন ভালো থাকি তখন মনই বলে দেয় আমরা ভালো আছি। তবে সত্য হলো আমরা ভালোর মর্যাদা বুঝি না। কী কারণে আমি ভালো আছি, অন্য আরেকজন ভালো নেই—এটা বুঝতে চেষ্টা করি না। ভালো থাকা একটা ভাগ্য, আমাদের সৃষ্টিকর্তার অপার নিয়ামত। আমরা শত চেষ্টা করলেও ভালো থাকতে পারব না, যদি সৃষ্টিকর্তা না চান। তবে সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহ আমাদের ভালোই চান, আমরাই নিজের দোষে ভালো থাকতে পারি না। ভালো থাকার মানে কী? অর্থ-সম্পদ, পদ-ক্ষমতা এসব কি একজন মানুষকে ভালো রাখতে পারে? যারা এসবের মধ্যে নিজের ভালোই খোঁজে তারা প্রকৃত অর্থে নির্বোধ!
ভালো থাকার বিভিন্ন মানদণ্ড আছে। কারো কাছে ভালো থাকার বড় উপকরণ হলো অনেক সম্পদ, কারো কাছে সেই উপকরণ হলো পদ, কারো কাছে ভালো থাকার বড় উপকরণ হলো নিজকে বড় ভাবা। অনেকে অন্যকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেও আনন্দ পায়। যাদের দিল বিষে ভরা, তারা অন্যের দুঃখ দেখলে আনন্দিত হয়। অন্যকে হেয় করে প্রীত অনুভব করে। এহেন লোকদের ভালো থাকার প্রক্রিয়া সমাজকে কিছু দিতে পারে না, বরং সমাজে অশান্তি সৃষ্টি করে। অন্য অনেক লোকের কাছে ভালো থাকার অর্থ হলো সুস্থতা। আমাদের বেশির ভাগ লোকের কাছে শারীরিক সুস্থতাই হলো ভালো থাকার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মানদণ্ড। অবশ্যই শারীরিক সুস্থতা ভালো থাকার একক গুরুত্বপূর্ণ মানদণ্ড। তবে শরীরের সঙ্গে মনের সম্পর্ক আছে অথবা মনের সঙ্গে শরীরের সম্পর্ক আছে। শরীরের অসুখ ডাক্তারের কথামতো ট্যাবলেট খেয়ে হয়তো দূর করা যাবে; কিন্তু মনের অসুখ সারানোর জন্য ডাক্তারের কাছে কোনো ট্যাবলেট নেই। তিনি বড়জোর ঘুমের ওষুধ বা অবসাদ নিবারণের ওষুধ দিয়ে বলতে পারেন, যান খান গে, খেলে ভালো থাকবেন। কিন্তু আমাদের কয়জন ঘুমের ওষুধ বা অবসাদ নিরাময়ের ওষুধ খেয়ে ভালো আছি? হতেই পারে না।

মন কেউ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, ওষুধ শুধু স্নায়ুকে চুপ করিয়ে মনকে চিন্তা থেকে দূরে নিয়ে যেতে পারে। এটাকে আমরা বলছি চিকিৎসা! ভুল, আমাদের চিন্তাধারা ভুলে আক্রান্ত। কিছু রোগ আছে যেগুলো দুনিয়ার কোনো ডাক্তার-ওষুধ ভালো করতে পারবে না। ওই সব রোগ থেকে রক্ষা পেতে হলে আমাদের ভাবনায় পরিবর্তন আনতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, যিনি আমাদের এত সুন্দর করে সৃষ্টি করেছেন, তিনিই শুধু আমাদের ভালো রাখতে পারেন। আমাদের শরীরের প্রতিটি অণু-পরমাণু তাঁর জানা এবং তিনি কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত। এই মনের অসুস্থতা সারানোর সর্বোত্তম পথ হলো তাঁর কৃপা ভিক্ষা করা। কিভাবে করতে হবে সে ব্যাপারে আমাদের ধর্মগ্রন্থ আমাদের বলে দিয়েছে। কিছু লোক অল্পতেই সন্তুষ্ট আর কিছু লোক অনেক পেয়েও সন্তুষ্ট নয়। কেন, বলেন তো? সন্তুষ্টির অনুভূতিটি আল্লাহর দান, তাঁর মেহেরবানি। যে সন্তুষ্ট হবে না, তাকে সারা বিশ্ব দিয়ে দিলেও সে শুধু অভাবে থাকবে। পদ-পদবি এসব চলতি পথে এসে গেলে ভালো, না হলে এসব নিয়ে আফসোস করতে নেই। কল্যাণ কিসে নিহিত আমরা জানি না। তাই কল্যাণমুখী জীবনের জন্য চেষ্টা করাই একজন ভালো লোকের কর্তব্য। চেষ্টা করে না পেয়ে অনেকে অসন্তুষ্ট হয়। এটাও একটা ভুল। পদ-পদবিকে মানুষের কল্যাণে যারা নিয়োজিত করে, তারা এসব পাওয়াকে বড় মনে করে না। আর যারা এসব ব্যবহার করে নিজের স্বার্থের জন্য, অবাস্তব সৃষ্টির জন্য, তারা সত্যিকার অর্থে হেরে যাওয়া লোকদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। তারা প্রতিনিয়ত চাই চাই করছে। সুখ নামের অনুভূতিটাকে মাপা যায় না—না ওজন করে, না সংখ্যা দিয়ে। যদি সুখকে মাপা যেত, তাহলে দেখা যেত যিনি কুঁড়েঘরে থাকেন, সকালে উঠে এক টুকরা বনরুটি এবং এক কাপ চা দিয়ে নাশতা করছেন তিনিই অনেক সুখী ওই লোকটা থেকে, যে শুধু চাই চাই, পাই পাই করে জীবন কাটিয়েছে।

সুখের যদি পরিমাপ থাকত, তাহলে বিশ্বের বিলিয়নেয়াররা অন্যদের থেকে বেশি সুখী হতো। এমনকি তাদের মৃত্যুও হতো অনেক দেরিতে। কিন্তু বাস্তব অবস্থা কী? বাস্তব অবস্থা হলো কত দিন কে ভাবছে তার সঙ্গে ধন-সম্পদ জমা করার কোনো সম্পর্ক নেই। বরং আমাদের চোখের সামনেই তো দেখছি, অর্থকড়ি যাদের বেশি আছে, তারা চিকিৎসা গ্রহণের নামে অতি চিকিৎসা নিয়ে শরীরটাকে আরো খারাপ করে ফেলছে। অনেক সময় দারিদ্র্য আশীর্বাদ, যদিও আমরা সেটা অনুধাবন করতে পারি না। ভোগ বলতে যা বোঝায় তা অর্থনীতিশাস্ত্র এক ধরনের ব্যাখ্যা করেছে। ভোগকে টাকার অঙ্কে মাপা হয়েছে। বলা হয়, যে যত বেশি ভোগ করছে সে তত তার ইচ্ছাকে পূরণ করছে এবং সেই শাস্ত্রের ব্যাখ্যা মতে, সে ততটাই ভালো আছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো—ভোগ আর সুখের ক্ষেত্রে অর্থনীতির এই ব্যাখ্যা ভুল। এই ব্যাখ্যা শুধু বইয়ে অথবা পরীক্ষার খাতায়ই ভালো মনে হয়।

সুখ আর ভোগ সম্পূর্ণ আলাদা। একটা লোক অর্থ কম আছে বলে অথবা নিজের সামর্থ্যের কারণে ছোট একটা ভালো হোটেলে দুপুরের লাঞ্চটা সেরে নিল ১৫০ টাকায়। আরেকটা লোক জরুরি কারণে হোক বা অর্থ আছে বলে হোক, ফাইভ স্টার হোটেলে গিয়ে দুপুরের লাঞ্চটা করে নিল তিন হাজার টাকায়। কে বেশি তৃপ্তি পেল? বোঝা মুশকিল। কারণ তৃপ্তি তো মাপা যায় না। তবে যে তিন হাজার টাকা ব্যয় করে, একটা মনস্তাত্ত্বিক তৃপ্তি তার পক্ষে কাজ করতে পারে। সেটাও করে কি না সন্দেহ আছে। আমাদের মধ্যে অনেকেই অনেক বেশি ব্যয় করে। বিদেশে যাচ্ছে, ইকোনমি ক্লাসে গেলেও হয়; কিন্তু সে যাচ্ছে বিজনেস ক্লাসে। এই লোকটাকেই যদি বলা হয় অমুক গরিব ছাত্র অর্থের অভাবে বই কিনতে পারছে না, তখন তাদের দেওয়ার অভাবটা যেন বড় হয়ে ওঠে! তারাও আবার নিজেদের শিক্ষিত মনে করে।

প্রকৃত শিক্ষা হলো, যে শিক্ষা অন্যের অভাবকে বুঝতে শেখায়, যে শিক্ষা বিনয়ী হতে শিক্ষা দেয়, যে শিক্ষা সৎ জীবন যাপন করতে বলে। আমি অনেক লোককে দেখি ঘন ঘন ডাক্তার-হাসপাতালে যেতে। কেন তাদের এত যাওয়ার প্রয়োজন হয়? তাদের অনেকের যাওয়ার প্রয়োজন নেই, তবু অর্থ আছে বলে তারা ওই অপসংস্কৃতির জালে আবদ্ধ হয়ে গেছে। ডাক্তার-হাসপাতালে তারা এক সপ্তাহে যে বিল পরিশোধ করছে, তাদের যদি বলা হয় ওই বিলের সমপরিমাণ অর্থ এতিম-মিসকিনদের দেওয়া হোক, তখন তাদের কাছে অর্থ থাকে না। সত্যিকার অর্থে আমরা কি সবাই রোগ নিয়ে ডাক্তার-হাসপাতালে যাই, না রোগ আছে ভেবে ওই সব ক্ষেত্রে যাই? আমি তো বহু লোককে দেখি কোনো রোগ নেই, তবু ওষুধ-ডাক্তারের কাছে যাচ্ছে। এসব লোক ভুলে গেছে যে ডাক্তারের কাজই হলো ওষুধ দেওয়া। আর এটাও আমরা ভুলে গেছি যে ওষুধ শুধু রোগ সারায় না, রোগ সৃষ্টিও করে। বাংলাদেশের হাসপাতালগুলোতে যান, মনে হবে বাংলাদেশের সব লোকই রোগাক্রান্ত। আসলে আমরা এমন এক পথে হাঁটছি যে তা আমাদের শুধু রোগের দিকেই নিয়ে যাচ্ছে। আমরা ওষুধ খেতে রাজি আছি; কিন্তু জীবনযাত্রার পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনতে রাজি নেই। আমি বহু লোককে জিজ্ঞেস করেছি আপনারা কনডেন্সড মিল্ক মিশিয়ে চা পান করেন কেন? তাদের উত্তর হলো—না হলে স্বাদ লাগে না। আবার এই লোকেরাই ফার্মেসি থেকে গ্যাস নিবারণের ট্যাবলেট নিয়ে খাচ্ছে। বলুন, ডাক্তারের কোনো ওষুধ কি তাদের সুস্থ রাখতে পারবে? বেশি ওষুধ সেবন করা, বেশি ডাক্তারের কাছে যাওয়া—এসব কোনো ভালো অভ্যাস নয়। এসব মানুষকে ভালো রাখতে পারে না। ভালো থাকার জন্য চিন্তায় ও জীবন পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনতে হবে।

লেখক : অধ্যাপক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here