মোস্তফা কামাল

সামনে নির্বাচন। এবারের নির্বাচন নিয়ে মানুষের কৌতূহল অনেক বেশি। কী হবে, কী হতে যাচ্ছে বা কেমন হবে আসন্ন নির্বাচন? আদৌ নির্বাচন হবে কি না, নির্বাচন কি অংশগ্রহণমূলক হবে? বিএনপি কি সত্যিই নির্বাচনে যাবে? এসব প্রশ্ন এখন মানুষের মুখে মুখে। সময় যতই ঘনিয়ে আসছে নির্বাচন নিয়ে আলোচনা ততই জমে উঠছে। অনেকে আবার অনিশ্চয়তার কথাও বলছেন। তবে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া যাতে ব্যাহত না হয় সেদিকে সবার সজাগ দৃষ্টি।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে আমরা দেখে আসছি, নির্বাচন এলেই ত্যাগী নেতাকর্মীদের কদর বাড়ে। নির্বাচনের পর যে দল ক্ষমতায় যায়, সে দলের ছায়াতলে সুবিধাবাদী গোষ্ঠী হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ে। আর ত্যাগী নেতাকর্মীরা ছিটকে পড়ে। তারা খাদে পড়ল, না নদীতে পড়ল সেদিকে কেউ ফিরেও তাকায় না। তাকাবার সময়ই বা কোথায়!

আগেকার দিনে ত্যাগী নেতাকর্মীরাই দলের পদ-পদবি পেত। তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ে নির্বাচনে (স্থানীয় ও জাতীয়) মনোনয়ন দেওয়ার ক্ষেত্রে ত্যাগীদেরই প্রাধান্য দেওয়া হতো। তাঁদের টাকা বা পেশিশক্তি আছে কি না তা দেখা হতো না। দলের প্রতি কমিটমেন্ট আছে কি না সেটাই হতো প্রধান বিবেচ্য।

এখন সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার প্রধান যোগ্যতা টাকা। সেই সঙ্গে পেশিশক্তিও মুখ্য ভূমিকা পালন করে। সংগত কারণেই আগের সেই রাজনৈতিক স্লোগান—‘সবার ওপরে দেশ বড়, তারপর দল’ পাল্টে গেছে। এখন হচ্ছে সবার ওপরে ‘আমি’ বড়, তারপর দল, তারপর দেশ! এই ‘আমি’রাই যখন মন্ত্রী-এমপি হন, তখন তাঁরা নিজেরা তরতর করে ফুলে-ফেঁপে অনেক বড় হন, বেশুমার অর্থবিত্তের মালিক হন। কিন্তু দেশের কোনো উন্নতি হয় না। দেশ দেশের জায়গায়ই থাকে।

দলে মূল্যায়নের ক্ষেত্রেও ত্যাগী নেতাকর্মীরা বৈষম্যের শিকার হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে হয়তো ব্যতিক্রম আছে। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, দল ক্ষমতাসীন হলে দুধের মাছির ভিড় বেড়ে যায়। নব্যদের ভিড়ে ত্যাগী নেতাকর্মীরা হারিয়ে যায়। তাদের খোঁজ কেউ রাখেন না। রাখার প্রয়োজনও বোধ করেন না। দলের প্রয়োজনে প্রকৃত কর্মীরাই অতন্দ্র প্রহরীর মতো দায়িত্ব পালন করে। কখনো কখনো পাহারাদারের ভূমিকা পালন করে।

কেউ কেউ আশায় থাকে, হয়তো একসময় তাদের মূল্যায়ন করা হবে। কিন্তু মূল্যায়নের সময় আর আসে না। আবার দল ক্ষমতা হারায়। শীর্ষ নেতারা আবার ছুটে যান পোড় খাওয়া ত্যাগী কর্মীদের কাছে। যেহেতু তাদের কাছে চেতনা বড়; তাই তারা ফেলতে পারে না শীর্ষ নেতাদের আবদার। নেতার নির্দেশে আবার তাঁরা নেমে পড়ে মাঠে। তাদের পেটে হয়তো ভাত নেই, পরনে কাপড় নেই। তাতে কী! নেতার ডাক পড়েছে। আর কি ঘরে বসে থাকা যায়!

দলের জন্য নিবেদিতপ্রাণ কর্মী বাহিনী নিজেদের সর্বস্ব বিলিয়ে দেয়। তারা দেনা-পাওনার হিসাব কখনো করে না। দল ক্ষমতায়, আমি কী পেলাম? এ প্রশ্নও কখনো তারা করে না। দল ক্ষমতায় আছে, এর মধ্যেই তারা সান্ত্বনা খোঁজে। অনেকে দলের সুনাম যাতে নষ্ট না হয় সে জন্য সতর্ক থাকে। কেউ কেউ হয়তো এতটুকু বলে, দল ভালো আছে তো! ভালো থাকুক। আমাদের ভালো-মন্দ দেখার দরকার নেই।

ত্যাগী নেতাকর্মীরা নিজেদের স্বার্থে দলকে ব্যবহার করে না। নিজেরা বিপদে থাকলেও দলের প্রভাব কাজে লাগায় না। বরং দল ক্ষমতাসীন হলে তারা দূরত্ব বজায় রেখে চলে। দলের কাছে তাদের কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই। পেলাম না, খেলাম না বলে তাদের আহাজারি নেই। তারা চায়, দল ভালো থাকুক, দেশের স্বার্থে কাজ করুক। দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাক। সুবিধাভোগীদের বাড়বাড়ন্ত বন্ধ করুক।

দলের ভালো চাওয়াও যেন তাদের বিপদের কারণ! এ জন্য তাদের পদে পদে বিপদে পড়তে হয়। নব্য আওয়ামী লীগাররাই তাদের বিপদে ফেলে। ত্যাগীদের জামায়াত-বিএনপি সাজিয়ে কলঙ্কিত করার চেষ্টা করে। এতে তারা সফলও হয়। কারণ এখনকার জমানায় ভদ্রলোক কিংবা ভদ্রতার কোনো দাম নেই। অর্থের জোর, চাপার জোরের কাছে সব কিছু যেন ম্লান হয়ে যায়। রাজনীতিতেও সেই একই ধারা চলছে। তৃণমূল থেকে মহানগর সর্বত্রই নব্য আওয়ামী লীগার, চাপাবাজ, অর্থ ও পেশিশক্তির দাপট। নব্যরাই ক্ষমতার সব সুবিধা লুটে নিচ্ছে। তাদের দাপটে কোণঠাসা নিবেদিতপ্রাণ আওয়ামী লীগাররা।

সব আমলেই সুবিধাভোগী ছিল। এখনো আছে। সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গে সুবিধাভোগীদের রং বদলায়, পোশাক বদলায়। আর সব ঠিক থাকে। তারা একসময় বিএনপির কাছ থেকে সুবিধা নিয়েছে। এখন আওয়ামী লীগের কাছ থেকে সুবিধা নিচ্ছে।

সুবিধাভোগী শ্রেণিই নিজেদের ফায়দা হাসিলের জন্য পোড় খাওয়া আওয়ামী লীগারদের কখনো বিএনপিপন্থী; আবার কখনো কখনো জামায়াতপন্থী বানায়। এমনভাবে কোণঠাসা করে রাখে, যাতে টুঁ শব্দটি করতে না পারে। নব্যদের দাপটে তাদের শোচনীয় অবস্থা। অনেকের ধারণা, বিরোধী দল বিএনপির নেতাকর্মীরাই বুঝি দৌড়ের ওপর আছে। জেল-জুলুম-নির্যাতনের শিকার হয়ে এলাকা ছেড়েছে। আমি অনেক আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীকে চিনি, যারা স্থানীয় এমপির নিপীড়নের শিকার হয়ে এলাকা ছাড়তে বাধ্য হয়েছে।

বিগত নির্বাচনে অনেকেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য হয়েছেন। তাঁদের অনেকের সঙ্গে স্থানীয় আওয়ামী লীগের কোনো যোগাযোগ নেই। তাঁরা বিভিন্ন দলের মৌসুমি নেতাকর্মীদের নিয়ে নিজেদের একটি বাহিনী গড়ে তোলেন। এই বাহিনী দিনে দিনে বিত্তবৈভবের সঙ্গে বেশুমার ক্ষমতার অধিকারী হয়েছে। ধরাকে সরাজ্ঞান করছে। আওয়ামী লীগের প্রকৃত নেতাকর্মীদের ঘরে বসিয়ে দিয়ে নব্যরা পুরো এলাকায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে।

দল বিপদে পড়লে নব্যদের টিকিটিও খুঁজে পাওয়া যায় না। বিপদের আশঙ্কা দেখলেই তারা বোল পাল্টে ফেলে। পোশাক বদলে ‘অতি ভদ্রলোক’ সাজে। কেউ কেউ গা ঢাকা দিয়ে থাকে। কেউবা বিদেশে পাড়ি জমায়। সুযোগ বুঝে আবার ঢুকে পড়ে ক্ষমতাসীনদের আস্তানায়।

এবারের নির্বাচনের মাঠ বড়ই পিচ্ছিল। খুব সাবধানে পা ফেলতে হবে। একটু এদিক-সেদিক হলেই পা পিছলে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। সংগত কারণেই মহা টেনশনে পড়েছেন গত নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এবং বিনা খরচে নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা। ওই নির্বাচনে তাঁদের অর্থ খরচ না হলেও বিপুল বিত্তবৈভবের মালিক হয়েছেন অনেকে। তাঁদের জন্য এবার দুঃসংবাদ অপেক্ষা করছে!

প্রথমেই তাঁরা দলীয় রোষের মুখে পড়বেন। সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে স্থানীয় নেতাকর্মীদের দূরে ঠেলে নব্যদের নিয়ে নিজস্ব বলয় তৈরি করেছেন। তাদের নিয়েই এলাকার উন্নয়নকাজের নামে সরকারি অর্থ ভাগ-বাটোয়ারা করেছেন। আর দলের পোড় খাওয়া নেতাকর্মীদের অনেককে এলাকা ছাড়া করেছেন। চাকরি দেওয়ার নামে অনেকের টাকা মেরে দিয়েছেন। সব হিসাব স্থানীয় নেতাকর্মীরা এবার বুঝে নেবে।

সচেতন পাঠকরা নিশ্চয়ই লক্ষ করেছেন। এরই মধ্যে বিভিন্ন এলাকায় দলীয় নেতাকর্মীদের তোপের মুখে পড়তে শুরু করেছেন স্থানীয় সংসদ সদস্যরা। বেশ কয়েকজন সংসদ সদস্য তাড়া খেয়ে এলাকা ছেড়েছেন। এখন অনেকেই টিপ্পনী কেটে বলছেন, এমপি সাহেবের নাকি অনেক দাপট। সেই দাপট এখন কোথায় গেল?

বিগত পাঁচ বছরে নির্বাচনী এলাকায় খুব একটা দেখা যায়নি এমন অনেক সংসদ সদস্য আছেন; যাঁরা ইদানীং যাতায়াত শুরু করেছেন। তাঁদের দেখে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাই সমালোচনা করছে। তারা বলছে, হঠাৎ এমপি সাহেবের আনাগোনা দেখছি! ভোটের দিন আসছে, তাই! এত দিন পর এলাকার কথা তাঁর মনে পড়ল! এই প্রার্থী নিয়ে আমরা জনগণের কাছে ভোট চাইতে যাব কোন মুখে?

স্থানীয় নেতাকর্মীরা মনে করে, এবার মনোনয়ন দেওয়ার ক্ষেত্রে তৃণমূলের মতামতকে গুরুত্ব না দিলে নির্বাচনে বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। সরকারের সামগ্রিক উন্নয়নের সুফল ঘরে তুলতে হলে ত্যাগী নেতাদের মূল্যায়ন করতে হবে। মনোনয়ন দেওয়ার ক্ষেত্রে ত্যাগীদের প্রাধান্য থাকতে হবে।

অনেকেই অবশ্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিকে তাকিয়ে আছেন। তিনিই যেন তাঁদের জিতিয়ে আনবেন। তাঁরা যদি গণমুখী রাজনীতি করতেন এবং এলাকায় নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা ও জনপ্রিয়তা বাড়াতে কাজ করতেন, তাহলে নিশ্চয়ই সাহস করে বলতে পারতেন যে তাঁদের মনোনয়ন দিলে জিতে আসতে পারবেন। এখন যে পরিস্থিতি, তা বলার সুযোগ কোথায়?

প্রধানমন্ত্রী বারবারই বলে আসছেন, আগামী নির্বাচন অনেক কঠিন হবে। নির্বাচনে জয়লাভের জন্য নিজেদের প্রচেষ্টা চালাতে হবে। এই বার্তাটিও বুঝতে তাঁরা অক্ষম। এই নেতাদের নিয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা কিভাবে নির্বাচনী বৈতরণী পার হবেন সেটাই এখন চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here