জাতিসংঘ মিশন : আফ্রিকার এক অন্ধকার দেশ

0
751

হাসান মাহমুদ
কনকনে ঠান্ডা। মনে হলো শীতের কাপড় না পরে ভুল করলাম। জিয়া আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরেররানওয়েতে দাঁড়িয়ে আছি। সময় তখন রাত পৌনে ১২টা। ঘড়ির কাঁটা দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। মোবাইল থেকে ফোন করে আবার বিদায় নিলাম। আম্মা কান্নাকাটি করছেন। শত পিছুটান থাকার পরও আমরা সবাই যাচ্ছি। জাতিসংঘ মিশনের বিমানে মালামাল তোলা হচ্ছে। সেনা সদস্যরা লাইন ধরে সুশৃঙ্খলভাবে বিমানে উঠছেন। সবশেষে অফিসার এবং সাংবাদিক উঠবেন। তাই অপেক্ষার পালা। এই ফ্লাইটে মহিলা অফিসারও রয়েছেন। এই প্রথম জাতিসংঘ মিশনে মহিলা অফিসারও রয়েছেন। এই প্রথম কোনো মহিলা সেনা কর্মকর্তা জাতিসংঘ মিশনে যাচ্ছেন। ঢাকা থেকে সাড়ে ১২ ঘণ্টার জার্নি। আমাদের গন্তব্যস্থল আফ্রিকার সবচেয়ে বড় দেশ দক্ষিণ সুদানের রাজধানী ‘জুবা’। যেখানে ওঁৎ পেতে থাকে এলআর’র (লর্ড রেজিসটেন্স আর্মি) গেরিলারা। তারা দেখতে অত্যন্ত কালো। সুঠাম দেহ। গেরিলা পোশাকে হাতে আধুনিক অস্ত্র। হত্যা, সন্ত্রাস, লুটপাটই যেন তাদের কাজ। একে-৪৭, একে-৮১ এবং আরজেস গ্রেনেড নিয়ে তারা হামলা চালাতে অভ্যস্ত। জাতিসংঘ মিশনে কর্মরত সেনাদের এদের আক্রমণের আশঙ্কায় বাড়তি সতর্কতায় থাকতে হয়। সুদানের পাশের কঙ্গো ও উগান্ডা। গেরিলারা গভীর বনাঞ্চল দিয়ে সুদানে ঢুকে পড়ে।

আফ্রিকার সবচেয়ে বড় দেশ সুদান। জনসংখ্যার বড় অংশ মুসলমান । প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ এ দেশটি হতে পারত বিশ্বের ধনী দেশগুলোর একটি। ২২ বছরের গৃহযুদ্ধে সব সম্ভাবনা ছাড়খার হয়ে গেছে। দেশটির বড় অংশ জুড়ে এখনও বারুদের গন্ধ। এসপিএলএ (সুদান পিপলস লিবারেশন আর্মি) এবং সুদান সরকারের বাহিনী এসএএফ (সুদান আর্ম ফোর্সেস) যুদ্ধে জড়িয়ে যায় ১৯৮৩ সালে। সুদানের প্রেসিডেন্ট হাসান আল বশির সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসেন ১৯৮৯ সালে। তার সরকার সারাদেশের শরিয়াহ আইন জারি করে এ সময়। এর আগে দক্ষিণ সুদানে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গড়ার জন্যই চলছিল যুদ্ধ। হাসান বশির ক্ষমতা নেয়ার পর যুদ্ধ আরও তীব্র রূপ নেয়। দক্ষিণ সুদানে গৃহযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে। অত্যাচার আর নির্যাতনের বিভীষিকা ছেিয় দেয়া হয় উত্তর সুদানের ‘দারফুরে’। যেখানে মানুষের কান্না এখনও থামছে না। দারফুর আর দক্ষিণ সুদান নিয়ে আছে নানা খেলা। ভেতরের খবর জানাও বড় মুশকিল। লাশ, ধ্বংসযজ্ঞ আর মানবতার পরাজয়ই যেন পথে পথে জানানা দিচ্ছে। সুদান যাওয়ার সিদ্ধান্ত হওয়ার পর থেকেই এক ধরনের ‘থ্রিল’ অনুভব করছিলাম। রানওয়েতে দাঁড়িয়ে থেকে ভাবছিলাম এসব। সুদানের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে সেনা সদরে আগেই আমাদের কয়েকদফা ব্রিফিং করেন সেনা অফিসাররা। বলে রাখা ভালো, উত্তর ও দক্ষিণ সুদান একত্রে বাংলাদেশের ১৮ গুণ বড় একটি রাষ্ট্র। কেবল দক্ষিণ সুদানই আয়তনে বাংলাদেশের পাঁচ গুণ বড়। গোটা সুদানে জনসংখ্যা সাড়ে ৪ কোটি, যা বাংলাদেশে প্রায় ৪ ভাগের একভাগ মাত্র।
বিমানবন্দরে আসার জন্য প্রস্তুতি ছিল বিকাল থেকে। আর্মি অফিসার্স মেসে সাড়ে ৭টায় ডিনার শেষ হয়। পরে আমাকে নিয়ে আসা হয় বিমানবন্দরে। রাত সোয়া ৮টা থেকে আমরা ভিআইপি লাউঞ্চে বসে রয়েছি। যাবতীয় কাগজপত্র, বোর্ডিং পাস ও ইমিগ্রেশন সম্পন্নের প্রস্তুতি চলছিল। রাত বাড়ছে নীরবে। প্লেন ছাড়তে আরও কয়েক ঘণ্টা বিলম্ব। সেনাবাহিনীর অফিসাররা এসেছেন সহকর্মীদের বিদায় জানাতে। একবছরের জন্য চ্যালেঞ্জিং পেশায় যচ্ছেন তারা। দেশের মান-মর্যাদা বৃদ্ধি এ পেশার সঙ্গে যুক্ত। ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে বিমানবন্দরে মিলাদ পড়ানো হলো। কোলাকুলির পর অনেকের চোখ অশ্রুসজল। জাতিসংঘ মিশনে যারা যাচ্ছেন, তাদের স্ত্রী-পুত্র-কন্যারা কান্নাকাটি করছেন। এ দৃশ্য দেখে আমার মনটা হঠাৎ খারাপ হয়ে গেল, নিজের পরিবার-পরিজন রেখে দুর্গম অজানা দেশে যাচ্ছি। আমরা যেখানে যাচ্ছি সেখানে প্রতিদিন গোলাগুলি হচ্ছে। গ্রেনেড ফুটছে। এন্টি পার্সোনাল মাইন বিস্ফোরণ হচ্ছে। যুদ্ধ স্থগিত, তারপরও গোটা দেশে চলছে যুদ্ধাবস্থা। প্রকাশ্যে সশস্ত্র মহড়া চলছে। কাঁধে একে-৪৭ ঝুলিযে ঘুরে বেড়াচ্ছে যুবকরা। এসব চিত্র আগেই পেয়েছিলাম।
ফ্ল্যাশব্যাক
আফ্রিকা দেখতে যেতে হলে শক্তি ও সামর্থ থাকা প্রয়োজন। আমার কোনোটাই ছিল না। ছিল শুধু মনোবল। ২০ কেজি ওজনের বুলেটপ্রুফ জ্যাকেজ পরে চলাফেরা করা। সেনা জিপে উঁচু-নিচু রাস্তায় ৭০-৮০ কিলোমিটার যাত্রা করা। মাথায় দুই কেজি ওজনের বুলেটপ্রুফ হেলমেট লাগিয়ে রাখা। মাইন ফিল্ডে তীব্র গরমেও বুলেটপ্রুফ পোশাক পরা। সশস্ত্র গেরিলাদের অ্যাম্বুশ মোকাবেলা করা। মনের জোড়েই যেন সবকিছুতেই এগিয়ে ছিলাম। পূর্বপ্রস্তুতি রাখার অভ্যাস ছিল। আমার চেয়ে সুঠামদেহী অনেকে কাবু হয়ে পড়েছেন প্রতিকূল পরিভেশে। দিরেন তাপমাত্রা ৫৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। দুপুরে মনে হতো সূর্য যেন নিচে নেমে এসেছে। গ্রীষ্ম মৌসুমে তা আরো বাড়ে। জাতিসংঘ সুদান মিশনে যাওয়ার জন্য আমাকে প্রস্তাব দেয়ার পর বিনয়ের সাথে ‘না’ বলেছিলাম। তবে শেষ পর্যন্ত তা ‘হ্যাঁ’ সূচক হয়ে যায়। অবশেষে যাত্রা। একই ফ্লাইটে যাচ্ছেন ১৫২ জন সৈনিক ও অফিসার। যাওয়ার সূচনালগ্নে প্রথম আমি জানালাম আমার সম্পাদক সাহেবকে। যাওয়ার পাঁচ দিন আগে ‘কর্তব্যকালীন’ ছুটির আবেদন করলাম। সহকর্মীদের কেউ কেউ ভয় দেখালেন আফ্রিকার নানা ঘটনা বলে। তার পরও চলে যাওয়ার প্রস্তুতি। মনের ভেতরে কালো মানুষের দেশ দেখার অদম্য ইচ্ছ্,া সেনা সদরে ব্রিফিংকালে সুদানের যাবতীয় চিত্র তুলে ধরা হয়। লে. কর্নেল গোলাম কিবরিয় তিনি আফ্রিকা সম্পর্কে অনেক কিছু জানেন। তার দেখা এবং অভিজ্ঞতাও বিস্তর। ২য় দিন ব্রিফিং শেষে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। সেখানে রক্ত পরীক্ষা, ইউরিন পরীক্ষা এবং পূর্ব সতর্কতামূলক কয়েকটি ভেকসিন দেয়ার আয়োজন ছিল। যাওয়ার এক সপ্তাহ আগে থেকেই ম্যালেরিয়া প্রতিরোধমূলক ওষুধ খেতে দেয়া হয়, যা ফিরে আসার পরও অব্যাহত থাকে। সেনাসদর থেকে সুদান সম্পকে জানার জন্য পুস্তকসহ পরিবেশন করা হয় নানা তথ্য-উপাত্ত। শুরু হলো পড়াশোনা। ইন্টারনেট সার্চ। আফ্রিকার বিশাল দেশ ‘সুদান’ ভেসে আসে চোখের সামনে।
এক.
ঘড়ির কাঁটায় রাত ১২টা ২০ মিনিট। জর্ডানের পাইলট ঘোষণা দিলেন আমরা সুদানের পথে রওনা দিচ্ছি। এয়ার হোস্টেজ মিস হামিদা জাফরি সিট বেল্ট বাঁধতে অনুরোধ করলেন। এ সময় সবাই যেন তাকেই দেখছে। আমার আসনটি ছিল প্রথম দুই সারি পর তিন নম্বর রো’তে। সামনের দুই সারিতে সেনা অফিসাররা বসা। রাতের আকাশ দেখব ভেবে, আমি বাম পাশে জানালার পাশের সিটে বসলাম। আমার ডান পাশের সিটটি খালি। ভাবনা ছিল আলো আঁধারীর মধ্যে চাঁদ তারার খেলা দেখতে দেখতে এবং বই পড়ে ১২ ঘণ্টা কাটিয়ে দেবো। কল্পনা-সব সময় বাস্তব হয় না। এবারো তা-ই হলো। ঢাকা থেকে রওনা হয়ে বোম্বে টাওয়ার টাচ করে আরব সাগর পাড়ি দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে ঢুকে যাবে ফ্লাইটটি। সেখানে দুবাই বা শারজাহ বিমানবন্দরে অবরণ করে জ্বালানি নিয়ে আবার সুদানের পথে যাত্রা করবে। পরিকল্পনা যত না সুখের, বাস্তবে তা ঘটল না। জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে যাত্রা শুরুর সময় আকাশ ছিল চমৎকার। চাঁদ যেন কিছুটা পথ সাথেই ছিল। তারাগুলো ভাসছে দূর আকাশে। বিমানের ‘টেক অফ’ ভালো হলে বাকিটা পথ ভালোভাবেই যাবে এমনটাই মনে করেন পাইলটরা। কিন্তু জিয়ায় টেক অফ খুব ভালো হলেও আধাঘণ্টা পর যে আকাশে বিপদের ঘনঘটা দেখা দেবে এমনটা কেউ ভাবতে পারেননি। আধাঘণ্টা ওড়ার পর বিপদ যেন সামনে এসে দাঁড়াল। ভারতের আকাশে প্রচ- ঝড়ের মধ্যে পড়ে যায় বিমানটি। এ অবস্থায় যাত্রীদের মধ্যে কেউ তখন আর আফ্রিকা যেতে চাননি। বিদ্যুৎ চমকানির আলোতে বিমানের ভেতর আলোকিত হথে থাকল। এক পর্যায়ে বিমানটি ঝড়ের তান্ডবে পড়ে কয়েক শ ফিট নিচে নেমে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করেন পাইলট। কিন্তু আবারো একই ঘটনায় বিমানের কারো দিকে আর তাকানো যাচ্ছিল না। দোয়া দরুদ পড়ে আল্লাহকে ডাকতে থাকেন। অভিজ্ঞ এয়ার হোস্টেজ হামিদা জাফরির মুখ সাদা ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। তিনি কোথাও বসার চেষ্টা করছিলেন। তীব্র ঝুাঁকুনিতে তাও পারছিলেন না। দুর্ঘটনার একবারেই সম্মুখে আমরা। মধ্যপ্রাচ্যের এই রুটে আমি আসা-যাওয়ার করেছি বেশ ক’বার। কিন্তু এ যাত্রায় যা ঘটেছে, এমনটা কখনো কল।পনাও করা যায় না। এই ফ্লাইটের ক্ষেত্রে যা ঘটেছিল, তা কোনো ‘বাম্পিং’ নয় বা ‘এয়অরফোকেট’ও ছিল না। আমার সামনের ডান সারিতে বসা ছিলেন লে. কর্নেল তাবিব ও লে. কর্নেল সালামসহ অন্য অফিসাররা। তারা নিজেদের পরিবার-পরিজন নিয়ে কথা বলছিলেন। বিমানের ঝাঁকুনিটা এতটাই বিপজ্জনক ছিল যে, এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে দীর্ঘ সময় লেগেছে। রাতে বিমানের ভেতরে খাবার পরিবেশন করা হয়। কিন্তু ভয়াবহ দুর্ঘটনার কবল থেকে রক্ষা পেয়ে খাবার আর তখন পেটে যাচ্ছিল না। আফ্রিকা যাত্রার শুরুতেই এ ধরনের ঘটনা ছিল ভিন্ন রকমের অভিজ্ঞতা। ভোর রাতে সংযুক্ত আরব আমিরাতের শারজাহ বিমানবন্দরের আকাশে আমরা। সোডিয়াম বাতির আলোয় গোটা শহর যেন নববধূর সাজে সজ্জিত। এই শহরে বিগত ১০ বছরে কোনো দিন এক মিনিটের জন্য বিদ্যুৎ বিভ্রাটে হয়নি। ইউএন মিশনের বিমানটি অবরণ করে ভোর সোয়া ৫টায়। চমৎকার ল্যান্ডিং। দরজা খুলে দিলে আমরা কয়েকজন বাইরে গিয়ে দাঁড়ালাম। শারজার নির্মল রাতের আকাশ যেন মিটিমিটি হাসছে। অভিবাদনের হাসি যেন। আকাশের একপাশে চাঁদ হেলে পড়েছে। তারা ভরা রাতের আকাশ। দরজার বাইরে এসে দাঁড়াতেই মিষ্টি হাওয়া শরীর শীতল করে দিয়ে যায়। হালকা ঠা-া বাতাসের শরীর মন জুড়িয়ে যায়। মনে পড়ে যায় পেছনে ফেলে আসা বিপদের মুহূর্তগুলো। দুর্ঘটনার আশঙ্কা নিয়ে পাইলটসহ আমরা আলাপ করি। তবে বড় রকমের দুর্ঘটনার কবল থেকে যে রেহাই মিলেছে, তা সবাই বললেন। বাইরে দৃষ্টি ফেরতেই দেখা গেল দ্রুতগামী ট্রলিগুলো ছুটে চলেছে। ব্যস্ত বিমানবন্দরের কর্মীরা রাত জেগে কাজ করছেন। সেনা বহনকারী বিমান বলে কাউকে নিচে নামতে দেয়া হয়নি। প্রায় পৌনে একঘণ্টা সময় লাগল রি-ফুয়েলিং করতে। এবার মধ্যপ্রাচ্য থেকে আফ্রিকার উদ্দেশে যাত্রা। বিমানটি ‘টেক অফ’ করল ভালোভাবে। আকাশে পাখা মেলে দিয়ে দিক নির্ণয় করল সোজা পশ্চিমে। সৌদি আরবকে পূর্ব দিকে রেখে পশ্চিমে ছটে চলল বিমানটি। গতিবেগ ঘণ্টায় ৫০০ কিলোমিটার। আকাশে ওঠার পর এবার যেন সময় আর কাটে না। বইয়ের পাতা উল্টাতে মন চায় না। আমার পাশের সারিতে বসা সাংবাদিক আবু রুশদ ভাই বই পড়তে গিয়ে মনে হলো ঘুমিয়ে পড়েছেন। তাকাতেই দেখি না তিনি ঘুমাননি। চাঁদরের ফাঁক দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। তারপর কিছুক্ষণ নীরবতা। পরে ফিসফিস করে বললেন, ‘আসলে আমরা কোথায় যাচ্ছি বলতে পারেন?’ আমি সংক্ষেপে উত্তর দিলাম আপনি কি ভয় পেয়েছেন? কোথায় যে পাইলট বলতে পারবেন।’ সংক্ষিপ্ত এমন কথাবার্তার মধ্যেই সময় কাটছে। আমি কিছু বললেই তিনি হাসেন। লে. কর্নেল তাবিবকে বললাম বিমানে এ ধরনের কোনো অভিজ্ঞতা আপনার আগে ছিল কি? তিনি চিন্তাযুক্ত মুখে, আল্লাহ আমাদের হেফাজত করেছেন। আমি বললাম, আজকে এই বিমানের কোনো দুর্ঘটনা হলে বাংলাদেশের সব পত্রিকায় লিড নিউজ হয়ে যেত। লাল বড় হরফে ব্যানার হেডিং’। সাংবাদিক বন্ধুদের কাছে এটি হতো সবচেয়ে ‘ভালো’ নিউজ। আমাদের কারো আর সময় কাটছে না। দীর্ঘ জার্নি তা নয়, তবে কত তাড়াতাড়ি মাটিতে গিয়ে নামব সেটিই ছিল সবার মনের আসল কথা। শারজায় বিমানের সব পাইলট, ক্রু, এয়ার হোস্টেজ বদলি হয়ে গেছে। নতুন টিম বিমান চালাচ্ছে হামিদা জাফরি নেমে গেছেন শারজা। অলস সময় আর অবসাদ কাটাতে কফি পান করছি। পত্রিকার পাতায় চোখ রাখতে চেষ্টা করি। কিন্তু সারা পথে একবারও ঘুম পায়নি। ফ্লাইট যে দিকে যাচ্ছে, সেদিকে রাত। পেছনে সূর্যের রক্তিম আভা ঝিলিক দিয়ে উঠছে। ভোরের আলো আমাদের ধরতে পারছে না। যে দিকে ঘর অন্ধকার সেদিকে বিমানটি ছুটে চলেছে। মনে মনে ভাবছি অন্ধকার এক আফ্রকার দিকে যাওয়ার মধ্যে কি কোনো আনন্দ আছে। পেছনে সূর্য ওঠার অপূর্ব দৃশ্য এবং সামনে কবরের মতো ঘন অন্ধকারের মধ্যে যে মিলন রেখা তা দেখা যায়। ঘন অন্ধকারকে যেন ধাওয়া করছে সোনালি আলো। আলোকিত আকাশ নিয়ে পেছনের বিশাল পৃথিবী। সামনে শত শত মাইল অন্ধাকার। আমরা কি আসলে আফ্রিকার অন্ধকারের দিকে যাচ্ছি? আসলে আমাদের সঙ্গে আফ্রিকা সময় তিন ঘণ্টা পিছিয়ে। বাংলাদেশে যখন সকাল ৬টা তখন সুদানে রাত ৩টা। সে কারণে আফ্রিকায় সকাল হয় দেরি করে। উত্তর সুদানের রাজধানী ঋার্তুম হয়ে আমরা দক্ষিণ সুদানের রাজধানী ‘জুবা’য় যাচ্ছি। উত্তর সুদান থেকে বিমানে দক্ষিণ সুদান যেতে সময় লাগে ২ ঘণ্টা। বিমানটি যখন দক্ষিণ সুদানে অবতরণের প্রস্তুতি নিচ্ছে, তখন ওপর থেকে শুধু বিশাল বন এবং বিরান ভূমিই নজরে এল। ল্যান্ডিং গিয়ার ফেলার শব্দ শোনা গেল। বিমানটি প্রথম দফায় অবতরণ না করে আবার আকাশে উঠে যায়। বিমানবন্দরের কাছেই রয়েছে একটি পাহাড়। পুরোটাই কালো পাথরের। পাহাড়ের ওপর দিয়ে এসে রানওয়ে নির্ধারণ করার পর দেখা গেল বিমানবন্দর বলতে একটি বিশাল টিনের ঘর। কন্ট্রোল টাওয়ারটি মাথা উঁচু করে শুধু দাঁড়িয়ে। এর চেয়ে উঁচু কিছু আর গোটা এলাকায় নেই। নজরেও আসে না। চারপাশে ধুধু বিরানভূমি। গভীর জঙ্গল আর ছন বিচালিতে ঢাকা। পাইলট ঘোষণা দিলেন, আমরা এই মুহূর্তে জুবা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করতে যাচ্ছি।’ বাংলাদেশ সময় দুপুর সাড়ে ১২টার সময় বিমানটি সুদানের মাটি স্পর্শ করল। দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে রানওয়ের উত্তর পাশে গিয়ে থামল। হাঁফ ছেড়ে যেন সবাই বাঁচলেন।
বিমানবন্দরের চারপাশে কোনো স্থান নেই। বিমানটি থাকতেই সশস্ত্র কিছু কালো মানুষ অস্ত্র তাক করে দাঁড়িয়ে আছে। পরে জানা গেল এরা এসপিএলএ’র সদস্য। জাতিসংঘ শান্তি মিশনের সেনারা এসএএফ ও এসপিএলএ সদস্যদের একই টেবিলে আলোচনা বসিয়েছে। এটি তাদের সবচেয়ে বড় সাফল্য। অস্ত্রের ভাষায় নয়। আলোচনার টেবিলে সব সমস্যা সমাধান করার উদ্যোগ নেয় জাতিসংঘ সৈন্যরা।
দুই.
দক্ষিণ সুদানের সবচেয়ে বড় এলাকা হচ্ছে ‘সেক্টর ওয়ান’। এটি নিয়ন্ত্রণ করে থাকে বাংলাদেশের সৈনিকরা। সেক্টর ওয়ানের সেক্টর কমান্ডার হচ্ছেন কর্নেল কুদরত ইলাহী। তিনি বিমানবন্দরে উপস্থিত হয়েছেন স্বাগত জানানোর জন্য। স্থানীয সময় সকাল ৯টার কিছুক্ষণ পর সূর্যের প্রখরতা আমাদের বিচলিত করে তুলল। বিমানবন্দরে উপস্থিত সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে পরিচয় শেষে আমরা চললাম ক্যাম্পের উদ্দেশ্যে। বিমানবন্দর থেকে ১৫ মিনিটের দূরত্বে বাংলাদেশের সেনা ক্যাম্প। বিশাল এলাকাজুড়ে স্থাপনা। তাঁবুর পর তাঁবু। অফিসারদের স্থাপনা স্টিলের ফ্রেমের ওপর একতলা ঘর। তাতে ‘এসি’ লাগানো রয়েছে। বিশেষ করে দুপুরে এসি ছাড়া থাকা অসম্ভব ব্যাপার। কমান্ডিং অফিসারদের বাসস্থান, কম্পিউটার বিভাগ, ডাইনিংসহ জরুরি বিভাগগুলো এ এলাকায় রয়েছে। চারপাশে কাঁটাতারের বেস্টনী। ভেতরে প্রবেশ করতে তিনটি নিরাপত্তা গেট পার হতে হয়। আগে থেকেই সিডিউল ছিল চূড়ান্ত। ফলে মিটিং, ইন্টারভিউ ও রিপোর্ট করার সব কিছু ছিল নির্ধারিত। হাতের কাছেই ছিল কম্পিউটার বিভাগ। সংযুক্ত ইন্টারনেট। হঠাৎ হঠাৎ নেটওয়ার্ক হারিয়ে যেত। আফ্রিকা বলে কথা। দক্ষিণ সুদানের কোথাও বিদ্যুৎ নেই। জাতিসংঘ মিশনগুলোর অফিস জেনারেটরের সাহায্যে চলে। ক্যাম্পের বাইরে গোটা সুদানে রাতে নেমে আসে ঘন অন্ধকার। সন্ধ্যা হলেই মশার ভয়। আফ্রিকার মশা কামড়ালে ম্যালেরিয়া জ্বর হয়। এই জ্বর এতটাই ভয়ঙ্কর যে, দ্রুত ও সঠিক চিকিৎসা না হলে রোগী মারা যাওয়ার আশঙ্কা তাকে। দক্ষিণ সুদানের রাজধানী ‘জুবা’ এবং আশপাশের জাবেল কুজুর, ইয়েই, মালাকাল, ইয়ামবিও ও মারিদি এলাকায় এ মশার উপদ্রব বেশি। বাংলাদেশ থেকে যারা জুবায় যায়, তাদের ম্যালেরিয়ার ওষুধ ও ভেকসিন দেয়া থাকে। আফ্রিকার জ্বর মানেই ম্যালেরিয়া। কোনো কারণে জ্বর এলে সঙ্গে সঙ্গে তাকে উচ্চমাত্রার ‘কুইনাইন’ ডোজ দেয়া হয়। তা না হলে ফুসফুসে পানি জমে রোগীর মৃত্যুর আশঙ্কা থাকে। পৃথিবীর সবচেয়ে তিতো ওষুধ হিসাবে পরিচিত কুইনাইন ম্যালেরিয়ার একমাত্র প্রতিষেধক। প্রবাদ আছে কুইনাইন জ্বর সারাবে বটে। তবে কুইনানইন সারাবে কে। মশার হাত থেকে বাঁচার জন্য সন্ধ্যার আগে মোটা কাপড়ের প্যান্ট, মোজা, ফুলহাতা জামা পরতে হয়্ জাতিসংঘ মিশনে কর্মরত সবাই এই সতর্কতা অবলম্বন করে থাকেন। দিনে গরম রাতে মশা। সুদানে বিদ্যুৎ ও পানি কোনোটাই নেই। সাধারণ মানুষ মাসের পর মাস গোসল করে না। সারা দিন এক বোতল পানি পান করার সামর্থ্য ও সুযোগ অধিকাংশের নেই। কিন্তু তাতে কি। সন্ধ্যার পর তারা পানাহারে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কঙ্গো ও উগান্ডা থেকে আসা এক ধরনের বিয়ার পানির বিকল্প হিসাবে তারা পান করে। তারা আনন্দ ফুর্তি করে একে-৪৭ এর শত শত রাউন্ড গুলি আকাশে ছুড়ে দিয়ে। তাই রাতে কান পাতলেই গুলির শব্দ পাওয়া যায়।
সুদানের প্রাকৃতিক পরিবেশ এশীয়দের জন্য অত্যন্ত প্রতিকূল। প্রচ- গরম হওয়ায় নাক দিয়ে রক্ত ঝরে। এই সমস্যা শতকরা ৯০ জনের ক্ষেত্রে হয়। কতগুলো অসুখ হয় মারাত্মক। এর মধ্যে ম্যালেরিয়া, স্লিপিং সিকসেন, ইয়েলো ফিভার, মেনিনজাইটিস, লাসা ফিভার ও এইডস অন্যতম। সুদানের সীমান্ত এলাকা নাবিয়াপাই। জুবা থেকে হেলিকপ্টারে করে আড়াই ঘণ্টার দূরত্বে ইয়ামবিও প্রদেশ। সেখান থেকে সড়ক পথে ৫০ কিলোমিটার দূরে নাবিয়াপাই। গভীর অরণ্য। চারপাশে পিনপতন নীরবতা। পথের দুই পাশে শত বছরের পুরনো গাছপালা। এই অরণ্য পথেই কঙ্গো বা উগান্ডা থেকে এলআরও সন্ত্রাসীরা এসে থাকে। সুদানে যুদ্ধ চলা অবস্থায় তারা একটি নেটওয়ার্ক থেকে অস্ত্র, রসদ, গোলাবারুদ, নগদ অর্থ ও খাবার পেত। কিন্তু ২২ বছরের গৃহযুদ্ধ ২০০৫ সালে জাতিসংঘের হস্তক্ষেপে স্থগিত হয়ে যায়। তারপরই এলআরএ বা তাদের মতো বিভিন্ন সশস্ত্র অস্ত্রবাজ সঙ্কটে পড়ে। প্রত্যন্ত এলাকায় তারা মানুষের ওপর অত্যাচারের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য বিদেশীদের অপহরণ করে মুক্তিপণও আদায় করে। তাদের প্রতিরোধ করতে জাতিসংঘ মিশনে কর্মরত সেনা সদস্যরা অভিযান চালান। অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ সড়কে গভীর অরণ্য দিয়ে যেতে হয় নাবিয়াপাই বা কঙ্গো সীমান্তে। এসব এলাকায় এলআরএ যোদ্ধারা অবস্থান করে মেশিনগান, একে-৪৭, আরজেস গ্রেনেডের মতো মারণাস্ত্র নিয়ে। জুবাকে ঘিরে জাতিসংঘ মিশনের সেনাবাহিনীর কর্মতৎপরতা। পৃথিবীর ৬৩টি দেশের সেনাবাহিনী সুদান মিশনে কাজ করে। বাংলাদেশের সেক্টর কমান্ডার কর্নেল কুদরত ইলাহী এবং তার কমান্ডিং ফোর্স অত্যন্ত দক্ষতা, নিয়মানুবর্তিতা ও নিষ্ঠার মধ্য দিয়ে সুনাম অর্জন করেছে। এর মধ্যে মেজর কবীর, মেজর মাহফুজ, লে. কর্নেল তাবিব, মেজর সালাম, লে. কনেৃল রেজা, ক্যাপ্টেন মোমতাজ, ক্যাপ্টেন শাহরিয়া, ক্যাপ্টেন ইমাদ, ক্যাপ্টেন ফারুক, ক্যাপ্টেন আজমসহ দক্ষ অফিসাররা প্রতিদিন দেশের সুনাম বৃদ্ধি করে চলেছেন। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত অবিরাম কাজ করছেন তারা।
সুদানের গভীর অরণ্য পরিষ্কার করে তৈরি হচ্ছে সড়ক। আবাসিক এলাকায় বাড়ানো হয়েছে নিরাপত্তা। তৈরি হচ্ছে ড্রেনেজ সিস্টেম। ফলে দীর্ঘ গৃহযুদ্ধের সময় যারা এলাকা ছেড়ে চলে গিয়েছিল, তারা ফিরতে শুরু করেছে। চেষ্টা চলছে বিদ্যুৎ ব্যবস্থা চালু করার জন্য। তবে সাধারণ মানুষ কবে বিদ্যুৎ পাবে, তা অনিশ্চিত। রাজধানী জুবায় পাকা সড়ক রয়েছে মাত্র পাঁচ কিলোমিটার। বাকি সব সড়ক কাঁচা। সারা সুদানে পাথরের ছড়াছড়ি। সড়কে মাইলের পর মাইল পাথর বিছিয়ে দেয়া হয়েছে। ট্রাফিক আইল্যান্ড বলতে কয়েকটি মাত্র ইট দিয়ে ঘেরা একটি স্থান। ট্রাফিক নেই। তারপরও গাড়িগুলো চলে নিয়ম মেনে। বিপরীত দিক থেকে কোনো গাড়ি এলে থেমে যাওয়া গাড়ি বহর। সারা শহরে পৃথিবীর নামীদামি গাড়ি ছুটে চলেছৈ। কিন্তু কোথাও গাড়ির হর্ন শোনা যায় না। শহরের সর্বত্র অস্ত্রের ঝনঝনানি। মেসাড়ে মোড়ে যুবকরা অস্ত্র নিয়ে আড্ডা দিচ্ছে। একেকটি আড্ডাস্থল যেন মিনি ক্যাপ্টনমেন্ট। কাঁধে একে-৪৭ নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে যুবকরা। গোষ্ঠীগত দাঙ্গার সাথে এলাকাভিত্তিক আধিপত্য বিস্তারের প্রতিযোগিতা। কিন্তু কোটি টাকা নিয়ে হেঁটে গেলেও কেউ জিজ্ঞেস করবে না। ছিনতাই বলে কিছু নেই। সুদানে বাংলাদেশ পুলিশের কয়েক শ কর্মকর্তা কাজ করছেন। তাদের একজন হচ্ছেন বখশি জাহিদ। তিনি জুবা থেকে চার কিলোমিটার দূরে বসবাস করেন। সেখানেই তার অফিস। গোটা এলাকায় বিদ্যুৎ নেই। সন্ধ্যার পর আয়োজন করা হয়েছিল খাবারের। স্থানীয় ফল এবং হাতে তৈরি খাবরই ছিল বেশি। তিনি জানালেন, সুদানিরা নিয়ম-নিষ্ঠার ক্ষেত্রে অটল। যুবক ছেলেরা কোনো কাজ করে না। মেয়েরা ঘরে বাইরে কাজ করে। ছেলেরা ১৫ বছর হলেই এসপিএলএ সদস্য হয়ে যায়। দামি হোন্ডা ও আধুনিক অস্ত্র হচ্ছে তাদের সঙ্গী। ছেলেরা বিয়ের সময় মেয়ের বাবাকে পণ দিতে বাধ্য। ছেলে পক্ষ থেকে কম করে হলেও ২০টি গরু মেয়ের বাবাকে দিতে হয়, না হলে বিয়ে হবে না। ২০টি গরুর মূল্য বাংলাদেশী প্রায় ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা। সুদানের মেয়েরা অত্যন্ত সুঠাম দেহের অধিকারিণী। তারা ছোটবেলা থেকে বাইসাইকেল চালায়, মাইলের পর মাইল হাঁটে এবং ভাত জাতীয় কোনো খাবার খায় না। খাদ্য তালিকায় সব থাকে শুকনো খাবার। মুসলিম পরিবারেও একই নিয়ম। খাবারের কারণেই তারা শারীরিকভাবে সুঠাম ও সুন্দর দেহের অধিকারিণী।
বিশাল বদ্ধভূমি। বড় বড় গর্ত আর খাল হয়ে রয়েছে বিস্তীর্ণ এলাকা। এর মূল কারণ হলো উদ্ধারকৃত ল্যান্ডমাইন, গ্রেনেড, শক্তিশালী বোমার বিস্ফোরণ ঘটানোর ফলে গোটা এলাকায় মাটি ওলটপালট হয়ে গেছে। মনে হয় যেন হাল চাষ করে রাখা হয়েছে। এই এলাকায় হাঁটতে গেলে খুব সাবধানে পা ফেলতে হয়। কারণ মাটির নিচেই হয়তো রয়েছে কোনো অ্যান্টি পার্সোনাল মাইন। রাশিয়ার তৈরি প্রোমজ-২ বা এম-১৪ বা এম-৪২ মাইনগুলো। যুদ্ধকালীন এসপিএল-এর সদস্যরা গোটা এলাকায় এ ধরনের মাইন পুঁতে রাখে সুদান সরকারি বাহিনীকে (এসএএফ) টেখানোর জন্য। ২২ বছর পর এসব মাইনই এখন গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে সুদানবাসীর। এসব মাইন যারা পুঁতেছিল, তাদেরও কোনো সন্ধান নেই। হয়তো তারা মারা গেছে। নয়তো দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। মাইন পুঁতে রাখার কোনো নকশাও বর্তমান শাসকদের হাতে নেই। ফলে ঝুঁকির মধ্যে এবং নিখুঁতভাবে মাইনগুলো জাতিসংঘ মিশনে কর্মরত বাংলাদেশের সেনারা অপসারণ করছেন। সেনা বাহিনীর বোমা বিশেষজ্ঞ হিসাবে পরিচিত ক্যাপ্টেন মোমতাজ অত্যন্ত দক্ষতা দেখিয়ে উদ্ধারকৃত বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে থাকেন। ৬ ফেব্রুয়ারি এক সাথে ৩৯টি শক্তিশালী বোমার বিস্ফোরণ ঘটানো হলো জাবেলকুজুর পাহাড়ি এলাকায়। বিস্ফোরণের ঠিক আগ মুহূর্তে নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে নেয়া হলো। বোমার বিস্ফোরণ ঘটার সময় গোটা জাবেলকুজুরের পাহাড় কেঁপে ওঠে। কালো ধোঁয়ার বিশাল কু-ুলি আকাশের দিকে মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়। আমরা নিরাপদ দূরত্বে ছিলাম। প্রশিক্ষণপাপ্ত একেকটি কুকুর প্রতিমাসে জাতিসংঘ থেকে ১ হাজার ২০০ ডলার বা ৮৪ হাজার টাকা করে খরচ ভাতা পাচ্ছে। কুকুরগুলো প্রথমে মাটি শুঁকে মাইনের সন্ধান দেয়। তারপর মাইন ডিরেক্টর দিয়ে তা নিশ্চিত হয় গর্ত করে তুলে আনা হয়। জাতিসংঘ মিশনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী মাইন অপসারণ করে সবচেয়ে বেশি খ্যাতি অর্জন করেছে।
জাবেলকুজুর থেকে ক্যাম্পে ফেরার সময় পথে হলো বিচিত্র এক অভিজ্ঞতা। মদনটাক নামের এক ধরনের বিশাল পাখি রাস্তা আগলে আছে। পাখা ছড়িয়ে দিয়ে গাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায়। জুবা এলাকায় এসব পাখি বেশি দেখা যায়। এদের কোনো ভয় ডর নেই। পাখির উচ্চতা ছাগলের চেয়েও বেশি। রাখাল বালকরা একে-৪৭ নিয়ে গরু-ছাগল চড়ায়।
তীব্র প্রখরতার মধ্যে ক্যাম্পে এসে গোসল শেষে লাঞ্চ সেরে আবার ছুটে চলা ভিন্ন অনুষ্ঠানে। এ জন্য ক্যাপ্টেন ফারুক ও ক্যাপ্টেন শাহরিয়ারের ব্যস্তার শেষ ছিল না। তাদের গাইড লাইন ছাড়া ছিলাম অচল। ক্যাপ্টেন শাহরিয়ার একটি কম্পিউটার নেটওয়ার্ক তৈরি করেছেন। যার সদস্য সবাই। কম্পিউটার মানেই জুবায় শাহরিয়ার। নিউজ পাঠাতে গেলেই তার সহযোগিতার বিকল্প কিছু নেই।

তিন.
সেক্টর কমান্ডার কর্নেল কুদরত ইলাহীর নেতৃত্বে আমরা ক’জন যাত্রা করলাম ইয়ামবিও প্রদেশে। হেলিকপটারযোগে প্রায় দুই ঘণ্টার বেশি সময়ের রাস্তা। রাশিয়ান পাইলট। ‘টেক অফ’ করার পর দীর্ঘ পথ। জুবা থেকে যাত্রার পর শত শত মাইল শুধু বনাঞ্চল। উপজাতীয়রা আগুন লাগিয়ে বনাঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। মাইলে পর মাইল দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। এ এক নারকীয় দৃশ্য। হেলিকপ্টার থেকে বিশাল বনাঞ্চল পুড়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখা যায়। প্রতিদিন এভাবে সুদানে বহু মূল্যবান বনাঞ্চল পুড়িয়ে দেয়া হয়। কোনো কোনো সময় দাবানল আকারে তা ছড়িয়ে পড়ে।
জুবা এয়ারপোর্ট থেকে উত্তর দিকে কঙ্গো সীমান্তের কাছে ইয়ামবিও এয়ারপোর্ট। জুবা থেকে ইয়াবমিও যেতে হলে হেলিকপ্টারই একমাত্র বাহন। সড়ক পথে যাত্রা মানে জীবনের ঝুঁকি শতভাগ বাড়ানো। গহিন অরণ্যে ঘেরা সড়ক পথে গেরিলা হামলার আশঙ্কা। ইউপিডিএফ (উগান্ডান পিপলস ডেমোক্রেটিক ফোর্স) এবং এলআরএ (লর্ড রেজিসটেন্স আর্মি) সড়কে পাশে ওঁৎ পেতে থাকে। ইয়ামবিওর গহিন বনাঞ্চলের ভেতর মাটির একটি রানওয়ে। হেলিকপ্টার নামতে গেলে ধুলায় পৃথিবীর অন্ধকার হয়ে যায়। সারা পথে শুধুই আতঙ্ক ছিল নিচ থেকে গেরিলা অ্যাম্বুশ হলে উপায় থাকবে কি! দুপুরে আমরা পৌঁছলাম ইয়ামবিও এয়ারপোর্টে। সেক্টর কমান্ডারসহ আমাদের স্বাগত জানালেন ক্যাম্প ইনচার্জ ক্যাপ্টেন ইমাদ। এ সময় গোটা এয়ারপোর্ট কর্ডন করা ছিল। গেরিলারা হামলা চালাতে পারে এমন আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না। তাই এ ব্যাপক নিরাপত্তা প্রস্তুতি।
ইয়ামবিও প্রাকৃতিকভাবে বাংলাদেশের মতো। প্রচুর সবুজ গাছপালা। এখানে সারা বছর আম ধরে। আম গাছগুলো আমাদের দেশের বট গাছের মতো বিশাল। লাখ লাখ আম গাছ। তবে আম নিচে পড়লে কেউ খায় না। স্থানীয়দের বিশ্বাস শয়তান ওপর থেকে আম ছুড়ে ফেলে। শয়তানের ছোড়া আম মানুষ না খাওয়ায় স্তূপাকারে পড়ে তাকে। একই গাছে কাঁচা পাকা আম। ফলনও হয় প্রচুর।
ইয়ামবিও থেকে
স্লিপিং সিকসেন একটি জটিল রোগ। সেনাবাহিনীর ডাক্তার মেজর এনায়েত বলেন, স্লিপিং সিকসেন শুধু আফ্রিকায়ই রয়েছে। তিনি জুবার কাছে ইয়েই ক্যাম্পে কর্মরত। তবে আমার সঙ্গে দেখা হয় কঙ্গো সীমান্তে ‘ইয়ামবিও’ ক্যাম্পে। সন্ধ্যার পর আমরা নিরাপত্তা চৌকির পাশে বসে আফ্রিকার এসব দিক নিয়ে আলাপ করতাম। মাঝে মধ্যে ভয়ও হতো। মেজর এনায়েত জানালেন, স্লিপিং সিকসেন বাতাসের মাধ্যমে ছাড়য়। এ রোগ হলে প্রথম কয়েক দিন বেশ ঘুম পায়। পরে ঘুমের মধ্যেই সুস্থ সবল একজন মানুষ মারা যায়। কঙ্গো সীমান্ত এলাকায় এর ব্যাপকতা চোখে পড়ে। এ অবস্থায় রাতে আমরা অনেকে কম ঘুমাতাম। বেশি ঘুম পেলে মনে করতাম স্লিপিং সিকসেন হলো কি না। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সুনাম সুদানে ছড়িয়ে পড়ে তাদের কর্মদক্ষতা, নিষ্ঠা ও একাগ্রতার কারণে। জাতিসংঘ মিশনে বহু সামাজিক দায়িত্ব নিজ থেকে পালন করে বাংলাদেশের সৈনিকরা। ফলে প্রত্যন্ত গ্রামের শিশুরা পর্যন্ত ‘বাংলাদেশ বাংলাদেশ’ বলে স্লোগান দেয়। বিদেশের মাটিতে এবং প্রতিকূল পরিবেশে এই জনপ্রিয়তা অনেক ত্যাগ ও নিষ্ঠার বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে। সুদানের মানুষের আরেকটি জটিল রোগ লাসা ফিভার। এক ধরনের ইঁদুর থেকে এ রোগ ছড়ায়। ইঁদুরের কামড়ানো খাবার খেলে লাসা ফিভার হতে পারে। এ ছাড়া এ ধরনের ইঁদুর কামড়ালেও লাসা ফিভার হয়। লাসা ফিভার হলে ২৪ ঘণ্টার জ্বরে মানুষ মারা যায়। মৃত ব্যক্তিকে বিমানসহ কোনো পরিবহন বহন করে না। ফলে লাশ ১০ ফিট মাটির নিচে পুঁতে ফেলতে হয়। সুদানে এইডস আক্রান্তর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে, নবজাতকরা মাতৃগর্ভ থেকে এইডস আক্রান্ত হয়। ইয়ামরিওর একটি হাসপাতালে এইডস আক্রান্ত ১ দিনের এক নবজাতকের দেখা মেলে। নবজাতকের মা ২২ বছর বয়সে এইডসে আক্রান্ত হন। তারপর তিনি এইচআইভি পজিটিভ বহনকারী হিসাবে থেকে যান। বিয়ের পর সন্তান হয়। হাসপাতালের একটি আলাদা কেবিনে শিশু ও তার মাকে রাখা হয়েছে। ৯ ফেব্রুয়ারি সকালে এই নবজাতক দেখলাম। তখন তার নামও রাখা হয়নি। ফুটফুটে একটি শিশু মায়ের কোলে। সময়ের সঙ্গে বেড়ে উঠছে। তবে পৃথিবীতে বেঁচে থাকবে অতি অল্প সময়ের জন্য। নাইট কুইন ফুলের মতো ফুটেই অল্প সময়ে ঝরে যাওয়ার প্রস্তুতি। এইডস আক্রান্ত হওয়র পূর্বে মারাত্মক আকার ধারণ করতে সময় নেয় ১২-১৫ বছর। হাসপাতালের বারান্দায় অবিবাহিত বেশ কয়েকজন কিশোরীকে দেখা গেল, যারা এইচআইভি পজিটিভ বহন করছে। কিশোরী বয়সেই এইডস রোগে আক্রান্ত। তারা অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে এসেছে। এখানে ডাক্তার রয়েছেন মাত্র দুজন। মাঝে মধ্যে মেজর এনায়েতও এখানে এসে রোগী দেখে যান।।
গৃহযুদ্ধ থেমে গেলেও সুদানে সামাজিক অপরাধ বাড়ছে। সুদানে কর্মরত বাংলাদেশের পুলিশ সদস্যরা তাদের সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছেন। তবে বাংলাদেশের সঙ্গে তাদের যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। সুদানের জেলে আটক কয়েদিদের জন্য সরকার কোনো খাবার সরবরাহ করে না। আমরা সুদান জেলখানার পাশেই পুলিশ অফিসার বখশির বাসায় বসে কথা বলছিলাম। তিনি জানালেন, এখানকার কয়েদিরা অত্যন্ত ভালো, তাদের দুপুরে বা রাতের খাবারের সময় হলে কেউ যদি বাড়ি গিয়ে খেতে চায় তবে তাকে ছেড়ে দেয়া হয়। খাবার শেষে আবার জেলখানায় ফিরে আসে। খাবার কথা বলে তারা পালিয়ে যায় না। এই ব্যতিক্রম ঘটনা বোধহয় একমাত্র সুদানেই সম্ভব।
সুদানের দক্ষিণাঞ্চলে প্রায়ই দেখা যায় আগুন লাগে। ঘন ছন খেতের মধ্যে আগুন ইচ্ছা করেই লাগানো হয়। কারণ এসব খেতের মধ্যে লুকিয়ে থাকে বড় বড় ইঁদুর। আগুন লাগলে ইঁদুরগুলো পুড়ে ‘গ্রিল’ হয়ে যায়। তখন সুদানিরা ইঁদুরগুলো কুড়িয়ে নিয়ে খায়। একই অবস্থা জুবা, ইয়েই ও মারিদি এলাকাতেও ঘটে থাকে। তীব্র খরতাপের সময় কোথাও পানি পাওয়া যায় না। তখন রাখালের দল গরুর পায়ে রগ কেটে দেয়। তাতে তীব্র বেগে বের হয়ে আসে রক্ত। তৃষ্ণার্ত মানুষ রক্ত পান করে তৃষ্ণা মেটায়। তারপর রগটি বেঁধে দেয়া হয়। এই দৃশ্য দক্ষিণ সুদানের ইয়ামবিও, নাবিয়াপাই এলাকায় অহরহ ঘটে।
সুদান আকরিক, লোহা, স্বর্ণ, খনিজ তেল ও ইউরেনিয়াম দ্বারা সমৃদ্ধ। খনিজসম্পদ নিজেদের মধ্যে রাখতে পারলে সুদানের বর্তমান চেহারা আগামী কয়েক বছরের মধ্যে পাল্টে যাবে।
কর্নের ফরিদ, কর্নেল ইলাহী, কর্নেল নওরোজ, লে. কর্নের কিবরিয়া, মেজর কবীর, মেজর মাহফুজ, মেজর শামীম, মেজর নাসির, ক্যাপ্টেন শাহরিয়ার, ক্যাপ্টেন মোমতাজ, ক্যাপ্টেন ফারুকসহ অন্য নিষ্ঠাবান অফিসাররা ইউএন মিশনের সুবাস ছড়িয়ে দেয়ার কাজে সদা ব্যস্ত। আমার কাছে মনে হয়েছে, জাবেলকুজুরের পাহাড়ে দুর্লভ অতি বর্ণিল কিছু ফুলের মতোই তারা সবার দৃষ্টি কাড়তে পেরেছেন।
জাতিসংঘ মিশনে সেনা সদস্যরা কিভাবে কাজ করেন, তা দেখার অপূর্ব সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল। যারা এই সফরে আমাকে উৎসাহ জুগিয়েছিলেন তাদের কথা প্রতি মুহূর্তে মনে দাগ কেটে গেছে। আর মনে পড়ে আমাদের সাহসী সেনা সদস্যদের কথা, যারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে একটা দেশ গড়ে তোলার চেষ্টা করছেন। দুঃখ হয় এই ভেবে, সুদানের কালো মানুষরা নিজেদের অঢেল সম্পদ থাকা সত্ত্বেও শিক্ষার অভাব, গোষ্ঠিগত দাঙ্গা আর আধিপত্য বিস্তারের প্রতিযোগিতায় অনাহার আর অর্ধাহারে জীবনযাপন করছে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here