মোস্তফা কামাল

সদ্য পাস হওয়া ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন’ নিয়ে সাংবাদিক সমাজ উদ্বিগ্ন। এই আইন সাংবাদিকতা পেশার জন্য বড় ধরনের হুমকি বলে মনে করি। একটি গণতান্ত্রিক দেশে এ ধরনের নিবর্তনমূলক আইন হতে পারে না। উদ্বিগ্ন-বিক্ষুব্ধ সাংবাদিক সমাজের পক্ষে সম্পাদকরা ২৯ সেপ্টেম্বর জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন কর্মসূচি দিয়েছেন। এর আগে তাঁরা দফায় দফায় বৈঠক করেছেন, প্রতিবাদ জানিয়েছেন, গণমাধ্যমে বিবৃতি দিয়ে আইনটি বাতিলের দাবি জানিয়েছেন।

বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ও সাংবাদিক সংগঠনের পক্ষ থেকেও আইনটি বাতিলের দাবি জানানো হয়েছে। গণমাধ্যমে পাঠানো বিবৃতিতে তারা বলেছে, আইনটি মত প্রকাশের স্বাধীনতার পরিপন্থী। একই সঙ্গে স্বাধীন সাংবাদিকতার জন্য হুমকিস্বরূপ। অবিলম্বে আইনটি বাতিল করা হোক। দেশের বিশিষ্ট নাগরিকরাও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন।

স্বৈরশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের আমলে তাঁর সমালোচনা করে রিপোর্ট প্রকাশ করলেই পত্রিকা বন্ধ করে দেওয়া হতো। ওই আমলে ঠুনকো অজুহাতে অনেক পত্রিকা বন্ধ হয়েছে। অনেক সাংবাদিক নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। এরশাদের পতনের পর তখনকার প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই পত্রিকা বন্ধের ধারাটি বাতিল করেছিলেন। সেই থেকে সাংবাদিকরা অনেক স্বাধীনতা ভোগ করে আসছেন। দিনে দিনে গণমাধ্যম সত্যিকার অর্থেই রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভে পরিণত হয়ে উঠেছিল। বিগত ১০ বছরে গণমাধ্যম কার্যত বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করে আসছে। অবাধ তথ্যপ্রবাহের যুগে সাংবাদিকদের স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করার কথা। মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রটি আরো প্রসারিত হওয়ার কথা। অথচ মত প্রকাশের বড় বাধা হয়ে এলো ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন।

এ কথা সবাই স্বীকার করবেন যে গণতন্ত্রকে স্থায়ী ভিত্তি দিতে স্বাধীন সাংবাদিকতার কোনো বিকল্প নেই। স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করতে না পারলে গণতন্ত্র পরিশীলিত হয় না। আমরা যদি প্রকৃত অর্থে গণতন্ত্র চাই, গণতান্ত্রিক চর্চা অব্যাহত রাখতে চাই, তাহলে মত প্রকাশের স্বাধীনতায় কেন বাধা আসবে? আইন তো হবে দেশ ও দেশের মানুষের স্বার্থে! সরকার নিজেদের সুরক্ষার স্বার্থে কোনো আইন করতে পারে না। যদি তা-ই করা হয়, তাহলে বুঝতে হবে সেখানে কোনো দুরভিসন্ধি আছে।

আমরা স্বীকার করি, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন থাকা প্রয়োজন। যেভাবে ফেসবুক, ব্লগ, টুইটারসহ অন্যান্য সামাজিক মাধ্যমে মত প্রকাশের স্বাধীনতার নামে অরুচিকর মন্তব্য, ছবি প্রকাশ করা হয়, তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। সব কিছুরই একটা সীমা থাকা চাই। অনেকেই সীমার বাইরে চলে যায়। দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব, জাতির জনককে অসম্মান করে অনেক আনন্দ পায়। তাদের নিয়ন্ত্রণের জন্য আইন থাকা প্রয়োজন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এ ধরনের আইন রয়েছে। কিন্তু তা গণমাধ্যমের টুঁটি চেপে ধরার জন্য করা উচিত নয়।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্যরা মিডিয়াবান্ধব বলে আমরা জানি। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা সাংবাদিকদের কল্যাণে অনেক কাজ করেছেন। মিডিয়া ট্রাস্ট গঠন করেছেন। কবি-সাহিত্যিকদের তিনিই সবচেয়ে বেশি সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন। চিকিৎসার জন্য অনেককে আর্থিক সহায়তা দিয়েছেন। মোট কথা, লেখক-সাংবাদিকদের সঙ্গে তাঁর একটা আত্মিক সম্পর্ক রয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী ছাত্রজীবনে লেখালেখি করতেন এবং এখনো তিনি নিজে লেখালেখি করেন। তাঁর উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বই রয়েছে। স্বাধীন মত প্রকাশের স্বাধীনতা তিনি খর্ব করবেন—এটা বিশ্বাস করা যায় না। তাঁর হাত দিয়ে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে নিপীড়নমূলক আইন হবে—এটা চিন্তাও করা যায় না।

আইনটি সংসদে উত্থাপনের আগেই বিভিন্ন পর্যায় থেকে মন্ত্রিসভার গুরুত্বপূর্ণ সদস্যদের অনুরোধ করা হয়েছিল, গণমাধ্যমের টুঁটি চেপে ধরতে ‘তথ্য-প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা’র মতো ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে যেন কোনো ধারা রাখা না হয়। ইতিমধ্যেই ৫৭ ধারার মামলায় সাংবাদিকরা নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। এতে সাংবাদিকদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। ৫৭ ধারা নিয়ে সংবাদপত্রে অনেক লেখালেখি হয়েছে। টিভি মাধ্যমে বিশেষ প্রতিবেদন ও টক শো প্রচারিত হয়েছে।

সবাই এ কথা স্বীকার করেছেন যে ৫৭ ধারা প্রবর্তনের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সাংবাদিক সমাজ। এই ধারা প্রত্যাহারের দাবি জানানো হয়েছে লেখক-সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবী মহল থেকে। মন্ত্রিসভার সদস্য ছাড়াও প্রধানমন্ত্রীকেও বিষয়টি অবহিত করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভার সদস্যরা সাংবাদিকদের আশ্বস্ত করেছেন, স্বাধীন সাংবাদিকতা বাধার মুখে পড়ে—এমন কোনো ধারা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে রাখা হবে না।

সরকারের উচ্চপর্যায়ের আশ্বাসের পরও আমরা দেখলাম, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ৫৭ ধারার চেয়ে আরো কঠিন কিছু ধারা; যেমন—২১, ২৫, ২৮, ৩১, ৩২ ও ৪৩ ধারা সম্পৃক্ত করা হয়েছে। এ ধারাগুলো বলবৎ থাকলে স্বাধীন সাংবাদিকতায় তা নিঃসন্দেহে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে। পাস হওয়া বিলে কয়েকটি ধারায় কিছু পরিবর্তন আনা হলেও ৩২ ধারাসহ বেশির ভাগ ধারা বহাল রয়েছে।

বিলের ৩২(১) ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি অফিশিয়াল সিক্রেসি অ্যাক্টের আওতাভুক্ত অপরাধ কম্পিউটার, ডিজিটাল ডিভাইস, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, ডিজিটাল নেটওয়ার্ক বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক মাধ্যমে সংঘটন করেন বা করিতে সহায়তা করেন; তাহা হইলে তিনি অনধিক ১৪ বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ২৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।

৩২(২) ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি উপধারা-১-এ উল্লিখিত অপরাধ দ্বিতীয়বার বা পুনঃপুন সংঘটন করেন, তাহা হইলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা অনধিক এক কোটি টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।

বিলটি পাস হয় ১৯ সেপ্টেম্বর রাতে। ওই দিন বিকেলে সাংবাদিক নেতারা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩২ ধারাসহ কিছু ধারা পুনর্বিবেচনার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে অনুরোধ জানিয়েছেন। এতে সবাই ধারণা করেছিলেন, সংসদে বিলটি উত্থাপন করা হবে না। ওই দিনই কিন্তু প্রধানমন্ত্রী দুস্থ সাংবাদিকদের অর্থ সহায়তা দিয়েছেন। সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্টে ২০ কোটি টাকা অনুদান দিয়েছেন। সাংবাদিকদের আবাসন সুবিধা দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন। সেদিনই রাতে সংসদে পাস হয়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। এতে বিস্মিত হয়েছে সাংবাদিক সমাজ। মিডিয়াবান্ধব প্রধানমন্ত্রীকে ভুল বুঝিয়ে যারা আইনটি পাস করেছে, তারা আওয়ামী লীগের ভালো চায় না।

আমরা জানতে পারলাম, পুলিশ বিভাগের উচ্চপর্যায়ের একটি প্রতিনিধিদলের পরামর্শে শেষ মুহূর্তে তড়িঘড়ি করে আইনটি পাস করা হয়েছে। এ আইনের বদৌলতে পুলিশ বিভাগকে আরো ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এমনিতেই পুলিশের হয়রানির কারণে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস ওঠার দশা, তার পরও নতুন আইনের খড়্গ! এবার পুলিশ আরো বেপরোয়া হয়ে উঠবে। এ খবর দেখে অনেকেই অবশ্য প্রশ্ন তুলেছেন, এটা কি পুলিশি রাষ্ট্র?

ডিসেম্বরে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। আসন্ন নির্বাচন ক্ষমতাসীন দলের জন্য অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। দলের ভেতরেই অসন্তোষের দাবানল জ্বলছে। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত অনেক সংসদ সদস্যের কারণে অসন্তোষ তৈরি হয়েছে। বিক্ষুব্ধ হয়েছে অনেক নিবেদিতপ্রাণ নেতাকর্মী। আওয়ামী লীগবিরোধী গ্রুপটিও এলাকায় বেশ সরব। এ পরিস্থিতিতে আগামী নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন খুব কঠিন হবে। তা ছাড়া দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারীরা সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপকভাবে কাজ করছে। আওয়ামী লীগকে পরাজিত করতে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করা হয়েছে। জঙ্গিগোষ্ঠীর হাতেও বিপুল পরিমাণ অর্থ বিভিন্ন দেশ থেকে আসছে।

এ রকম পরিস্থিতিতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস করে সাংবাদিক সমাজকে আওয়ামী লীগের বিপক্ষে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছে; যদিও গণমাধ্যমের বেশির ভাগ সাংবাদিকই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির। সংগত কারণেই বেশির ভাগ সাংবাদিক আওয়ামী লীগকে সমর্থন করে। একটি কুচক্রী মহল সরকারকে ডোবানোর জন্যই এটা করেছে বলে অনেকে মনে করেন।

রাষ্ট্রপতি বিলটি স্বাক্ষরের আগেই সরকারের উচিত আইনটি পুনর্বিবেচনা করা। তা না হলে একটি কালো আইন হিসেবে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন চিহ্নিত হয়ে থাকবে। শেখ হাসিনার হাত দিয়ে একটি কালো আইন এ দেশে প্রবর্তন করা হবে, তা কেউ বিশ্বাস করে না।

আমরা জানি, বঙ্গবন্ধু সারা জীবন গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করেছেন। জেল-জুলুম-নিপীড়ন সহ্য করেছেন। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাও ১৯৮১ সাল থেকে গণতন্ত্রের জন্যই সংগ্রাম করছেন। তিনিও জেল-জুলুমের শিকার হয়েছেন। কিন্তু গণতান্ত্রিক আন্দোলন থেকে পিছপা হননি। বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার সঙ্গে এ দেশের গণমাধ্যম সব সময়ই ছিল। এখনো বেশির ভাগ সাংবাদিক প্রগতিশীল রাজনৈতিক ধারার সঙ্গে আছে।

যদিও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০ সেপ্টেম্বর সংসদের ২২তম অধিবেশনের সমাপনী ভাষণে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রসঙ্গ টেনে বলেছেন, সাংবাদিকদের উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনো কারণ নেই। আমরাও তা বিশ্বাস করি। স্বাধীন সাংবাদিকতা হুমকির মুখে ঠেলে দিতে পারে—এমন কোনো আইন অনুমোদন পাবে না। রাষ্ট্রপতি এই আইনে স্বাক্ষর করবেন না।

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here