বিভুরঞ্জন সরকার

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আর মাত্র ১৭ দিন বাকি। নির্বাচনকে সামনে রেখে চলছে বেশুমার জল্পনা-কল্পনা এবং ভবিষ্যৎবাণী। রাজনৈতিক ভাষ্যকার, বিশ্লেষক, পন্ডিত এবং নেতা-পাতিনেতা-হবু নেতা -গবু নেতা –সবাই মতামত দিচ্ছেন, মন্তব্য করছেন, ভবিষ্যৎবাণী করছেন। কেউ বলছেন আওয়ামী লীগ ৩০ টির বেশি সিট পাবে না, কেউ বলছেন, সরকারের সময় শেষ, কেউ বলছেন, ২ জানুয়ারি খালেদা জিয়া আইনি প্রক্রিয়ায় মুক্তি পাবেন, কেউ আবার আরো এক ধাপ এগিয়ে বলছেন, ১ জানুয়ারি জেলের তালা ভেঙে খালেদা জিয়াকে মুক্ত করে আনা হবে।

কোনো কোনো মহল আবার নানা রকম ভয়ভীতি-আতঙ্ক ছড়াচ্ছেন। নির্বাচনে ব্যাপক সংঘাত হবে, মানুষ ভোট দিতে পারবে না, সরকার ভোট চুরির নানা মেকানিজম করেছে। কারো বক্তব্য, বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় এসে গেছে। আওয়ামী লীগ পালানোর পথ পাবে না। ব্যাপক রক্তপাতের আশঙ্কাও কেউ কেউ করছেন। মত প্রকাশের স্বাধীনতা নেই বলে একদিকে প্রচারণা চলছে, অন্যদিকে সব ধরনের নেতিবাচক কথাই গণমাধ্যমে প্রচার করা হচ্ছে।

আমি একজন সাধারণ সংবাদকর্মী। রাজনৈতিক জ্যোতিষী নই। তবে রাজনীতির একজন নিবিড় পর্যবেক্ষক। একসময় সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মীও ছিলাম। আমার কাছেও অনেকেই আগামী নির্বাচন সম্পর্কে জানতে চান। নির্বাচন সুষ্ঠু হবে কিনা? আওয়ামী লীগ জিতবে, নাকি বিএনপি জিতবে? সংখ্যালঘুরা জানতে চান, ২০০১-এর পুনরাবৃত্তি হবে কিনা, দেশ ছাড়তে হবে কিনা ইত্যাদি ইত্যাদি।
এই প্রেক্ষাপটে আমার কয়েকটি স্পষ্ট বক্তব্য। এগুলো গণনা নয়, পর্যবেক্ষণ।

আমার প্রথম কথা, যারা নানা রকম ভবিষ্যৎবাণী করছেন অতীতে তাদের কোনো ভবিষ্যৎবাণী সঠিক হয়েছিলো কি? অতীতে ভবিষ্যৎবাণী করা হয়েছিলো, চল্লিশ বছরেও আওয়ামী লীগ আর ক্ষমতায় আসতে পারবে না। সেটা কি ঠিক হয়েছে? বলা হয়েছিলো, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে মসজিদে আজানের বদলে উলুধ্বনি শোনা যাবে। সেটা কি ঠিক হয়েছে? বলা হয়েছিলো, পার্বত্য শান্তিচুক্তি হলে ফেনী পর্যন্ত ভারতের দখলে চলে যাবে। গিয়েছি কি?

গত নির্বাচনের পর বলা হয়েছিলো, এমন নামকাওয়াস্তের নির্বাচন করে শেখ হাসিনা এক মাসও ক্ষমতায় থাকতে পারবে না। তো, কী হয়েছে তারপর? বিএনপি গত দশ বছরে কতো বার আওয়ামী লীগ সরকারের বিদায়ঘণ্টা বাজিয়েছে? কতো বার আল্টিমেটাম দিয়েছে? কী ফল হয়েছে সে সবের। বিএনপি নেতাদের কোন কথা ঠিক হয়েছে? তত্তাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচন নয়, শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচন নয়, খালেদা জিয়াকে ছাড়া নির্বাচন নয় – কোন কথা তারা রেখেছে?

বিএনপিপন্থি এবং বামপন্থিদের কোন অতীত ভবিষ্যৎবাণী সঠিক হয়েছে? মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে চীনা বামেরা। তারা বুঝতেই পারেনি কী ঘটছে, ঘটতে যাচ্ছে। সিপিবি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছে। কিন্তু ‘মুক্তিযুদ্ধ দীর্ঘ স্থায়ী হইবে’- বলে তারা যখন তাত্ত্বিক দলিল তৈরি করছিলো, তখনই দেশ স্বাধীন হয়ে যায়। কাজেই আগামী নির্বাচন নিয়ে যারা আগাম সব বাণী দিচ্ছেন তার বেশির ভাগই হচ্ছে স্রেফ প্রোপাগান্ডা, বিএনপি-জামায়াতের পক্ষে এক ধরনের প্রচারণাযুদ্ধ। আওয়ামী লীগ তথা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ শক্তির মনোবল দুর্বল করার কৌশল।

আমি মনে করি :

১. আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করবে এবং সরকার গঠন করবে। প্রধান বিরোধী দল হবে বিএনপি। বিরোধী দলের নেতা হবেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
২. নির্বাচন শতভাগ সুষ্ঠু হবে না। অনিয়ম হবে। এটা রোধ করার মতো অবস্থা থাকবে না ।
৩. নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি কম হবে। কোনো নির্বাচনেই সব মানুষ ভোট দিতে যান না। ১৯৭০-এর নির্বাচনেও প্রায় অর্ধেক ভোটার ভোটকেন্দ্রে যাননি।
৪. ভোটের ফলাফল নিয়ে বিএনপি হৈচৈ করবে। কিন্তু তাতে পরিস্থিতির খুব হেরফের হবে না।
৫. নির্বাচন সুষ্ঠু না হলে মারাত্মক কিছু হওয়ার আশঙ্কা যারা ছড়াচ্ছেন তারা মতলববাজ। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, আমেরিকা, বৃটেন অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন যেমন চায়, তেমনি জামায়াতের খপ্পর থেকে বিএনপির মুক্তিও চায়। জামায়াতকে বুকে নিয়ে বিএনপি পশ্চিমা দুনিয়ার সহানুভূতি পাবে না।
৬. নির্বাচনে কারচুপি, অনিয়ম হলেও তার বিরুদ্ধে ব্যাপক আন্দোলন হবে না। কারণ মানুষ খালেদা জিয়া-তারেক রহমানের জন্য জীবন দিতে চাইবে না।
৭. আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে যারা হম্বিতম্বি করছেন তারা কেউ আন্দোলন করার মানুষ নন। তারা জনসমর্থনহীন, পরগাছা।
৮. শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা, তার ক্যারিশমা তাকে আবার প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসানোর জন্য যথেষ্ট।

প্রসঙ্গত আমার একটি ঘটনা মনে পড়ছে । ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সভাপতি অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ নানা ধরনের কৌতুককর মন্তব্য করতে পারদর্শী। আমরা তার কাছে কোনো রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে প্রশ্ন করলে তিনি সরাসরি জবাব না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করতেন অথবা স্যাটায়ার করে জবাব দিতেন। একবার আমি তার সঙ্গে আলোচনার এক পর্যায়ে বলেছিলাম, স্যার, যদি –
তিনি আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, তোমার যদি নিয়া নদীতে ফেলো। আরে, যদি দিয়ে কী সব হয়? মামির যদি গোঁফ হয় তো কী হবে? মামি কি মামা হবে?

আমরা যদি এটা হয়, যদি ওটা হয় – এরকম আলোচনা চালিয়ে যেতে পারি কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে, রাজনীতির চালকের আসনে বসে আছেন শেখ হাসিনা। তিনি এতোদিনের রাজনৈতিক জীবনে প্রমাণ করেছেন, তিনি যা পারেন, অন্যরা তা পারেন না। আগামী নির্বাচনেও তিনি তার দক্ষতারই প্রমাণ রাখবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here