বর্ণাঢ্য আয়োজনে বাংলাদেশ সোসাইটি’র মহান বিজয় দিবস উদযাপন

0
505

নিউইয়র্ক: একাত্তুরের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মাননা প্রদান, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের দুই শিল্পীকে বিশেষ সম্মাননা, বিজয়ের আলোচনা আর মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজনের মধ্যদিয়ে বাংলাদেশের ৪৭তম বিজয় দিবস পালন করেছে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বাংলাদেশীদের ‘মাদার সংগঠন’ হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশ সোসাইটি ইনক। এ উপলক্ষ্যে গত ১৭ ডিসেম্বর সোমবার সন্ধ্যায় সিটির উডসাইডরে কুইন্স প্যালেসে বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত ও গীতা পাঠের মধ্য দিয়ে শুরু হওয়ার অনুষ্ঠানটি বিভিন্ন পর্বে সাজানো হয়। প্রথম পর্বে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনের পর ছিলো বাংলাদেশ সোসাইটি পরিচালিত বাংলা স্কুলের শিক্ষার্থীদের পরিবেশনা ও কার্যকরী পরিষদের কর্মকর্তাদের শুভেচ্ছা বক্তব্য। সোসাইটির সভাপতি কামাল আহমেদ ও সাধারণ সম্পাদক রুহুল আমীন সিদ্দিকী ছাড়াও এই পর্বে বক্তব্য রাখেন সংগঠনের সিনিয়র সহ সভাপতি আব্দুর রহিল হাওলাদার, সহ সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ এম কে জামান, কোষাধ্যক্ষ মোহাম্মদ আলী, সাংস্কৃতিক সম্পাদক মনিকা রায়, প্রচার ও জন সংযোগ সম্পাদক রিজু মোহাম্মদ, সাহিত্য সম্পাদক নাসির উদ্দিন আহমেদ, ক্রীড়া ও আপ্যায়ন সম্পাদক মোহাম্মদ নওশেদ হোসেন, স্কুল ও সাহিত্য সম্পাদক আহসান হাবিব, কার্যকরী সদস্য ফারহানা চৌধুরী, মাইনুল উদ্দিন মাহবুব, মোহাম্মদ আজাদ বাকির সাদী মিন্টু, আবুল কাশেম চৌধুরী প্রমুখ।



দ্বিতীয় পর্বে ছিলো প্রবাসের মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মাননা। জনপ্রিয় শিল্পী রথীন্দ্রনাথ রায় ও শহীদ হাসান সহ মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে যাদেরকে সম্মানণা জানানো হয় তারা হলেন- এম এ মহসিন ভূইয়া, মীর মশিউর রহমান, সরাফ সরকার, কাজী আজহারুল হক মিলন, ফিরোজুল ইসলাম পাটোয়ারী, সৈয়দ খোকা, হাজী আব্দুর রহমান, তোফাজ্জল করীম, মীর মশিউর রহমান প্রমুখ। এসময় সোসাইটির একেকজন কর্মকর্তা একেকজন মুক্তিযোদ্ধাকে লাল-সবুজের ‘উত্তরীয়’ পরিয়ে দেন।
এরপর একুশে পদকপ্রাপ্ত কন্ঠযোদ্ধা ও জনপ্রিয় শিল্পী রথীন্দ্রনাথ রায় এবং অপর কন্ঠযোদ্ধা ও জনপ্রিয় শিল্পী শহীদ হাসানকে সোসাইটির পক্ষ থেকে প্ল্যাক দিকে বিশেষভাবে সম্মানিত করা হয়। শিল্পী রথীন্দ্রনাথ রায়ের হাতে প্ল্যাক তুলে দেন সভাপতি কামাল আহমেদ। আর শিল্পী শহীদ হাসানের হাতে প্ল্যাক তলে দেন সাধারণ সম্পাদক রুহুল আমীন সিদ্দিকী। এসময় অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি সোসাইটির সাবেক সভাপতি ও ট্রাষ্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান এম আজিজ, সোসাইটির সাবেক সভাপতি নার্গিস আহমেদ, সাবেক সাধারণ সম্পাদক ফখরুল আলম, ট্রাষ্টিবোর্ডের সদস্য যথাক্রমে সরাফ সরকার, ওয়াসী চৌধুরী, আজিমুর রহমান বুরহান প্রমুখ মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন।
তৃতীয় পর্বের মূল আলোচনায় শিল্পী রথীন্দ্রনাথ রায় একাত্তুরের মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করে বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় ১১ সেক্টর থাকলেও কন্ঠযোদ্ধাদের আরেকটি সেক্টর ছিলো। মহান মুক্তিযুদ্ধে শিল্পীরাও ব্যাপক ভূমিকা ও অবদান রাখেন। কিন্তু আজো সেই সেক্টর মূলায়িত হয়নি। অথচ স্বাধীনতা যুদ্ধে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পীদের বড় অবদান রয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় কোন সরকারই আমাদের সঠিক মূল্যায়ন করেনি। আমাদের কোন শিল্পীকেই কোন খেতাব দেয়া হয়নি। অথচ আমরাও খেয়ে না খেয়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের মাধ্যমে দেশের মানুষকে উৎসাহ দিয়েছি। তিনি বলেন, পৃথিবীর অনেক দেশেই মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে। কিন্তু আলাদা কোন স্বাধীন বেতার কেন্দ্র হয়নি। এটা একটা ইতিহাস। তিনি বলেন, রাজাকার প্রতিদিন তৈরী হতে পারে, কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা আর তৈরী হবে না। তিনি তার বক্তব্যের শেষ পর্যায়ে ‘জাতির জনক’ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও জাতীয় চার নেতাকে স্মরণ করে গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রত্যাশা করেন।
শিল্পী শহীদ হাসান বলেন, মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ কারো একার অবদান নয়। সবার অবদানেই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে।
নার্গিস আহমেদ বাংলা ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতার আন্দোলন আর গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ার আন্দোলনে সকল শহীদের স্মরণ করে বলেন, মুক্তিযোদ্ধারা দেশ স্বাধীন করেছিলেন বলেই আমরা যুক্তরাষ্ট্রে আসতে পেরেছি। ১৯৭৫ সালে প্রতিষ্ঠা থেকে শুরু করে যারা সোসাইটিকে আজকের পর্যায়ে নিয়ে এসেছেন তাদের স্মরণ করে সোসাইটিতে যোগ্য ও সঠিক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা কামনা করেন। সেই সাথে সোসাইটি তথা কমিউনিটিকে সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি আরো জোরদার করে প্রবাসে জাতীয় পতাকা-কে সমুন্নত রাখার আহ্বান জানান।
ফখরুল আলম বলেন, সোসাইটির অনুষ্ঠান সময়মত শুরুর উপর গুরুত্বারোপ করে বলেন, বাংলাদেশ সোসাইটি কমিউনিটির বাগান। সোসাইটির বর্তমান কমিটির বিজয় উল্লাসের আয়োজন প্রশংসার দাবী রাখে। তিনি সোসাইটির আহ্বানে সাবেক নেতৃবৃন্দের সাড়া দেয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, আমামের দায়িত্ব কমিউনিটিকে ঐক্যবদ্ধ করা, বিভক্ত করা নয়। তবে ভালো, সুন্দর, ঐক্যবদ্ধ কমিউনিটি গড়তে শিক্ষিত, দায়িত্বশীল কমিউনিটি নেতৃবৃন্দের ভূমিকা অনেক। তাদের নিষ্কিয়তা কমিউনিটিকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। তিনি বলেন, সোসাইটিতে কোন রাজনীতি নয়, বিএনপি-আওয়ামী লীগ নয়। আমরা সবাই মিলে সোসাইটিকে এগিয়ে নিতে চাই।
মুক্তিযোদ্ধা তফাজ্জল করীম বলেন, মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জাতির গৌরবের ব্যাপার। ভাষা আন্দোলনও গৌরবের ব্যাপার। ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা আন্দোলন, বঙ্গবন্ধু-কে বাদ দিয়ে বাংলাদেশ হয় না। যুক্তরাষ্ট্রে ‘ফাউন্ডিং ফাদার্স’-দের খুব সম্মান করে। আমাদেরও জাতীয় নেতাদের যথাযথ সম্মান করা উচিৎ।
মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ খোকা বলেন, মুক্তিযুদ্ধকালীন সময় বাংলাদেশের মানচিত্র থেকে বাইরে ছিলাম। সেই সময়ের ৬ মাস রণাঙ্গনে আর ২ মাস বেতার কেন্দ্রে এক মাস ব্রাক্ষণবাড়িয়া জেলে আটক ছিলাম। ১৫৬ জনের মধ্যে ১৫৪ জন পাক বাহিনীর হাতে মারা গেলেও আমি সহ আরো একজন বেঁচে যাই। তিনি সোসাইটির কর্মকান্ড আর বিজয়ের অনুষ্ঠান আয়োজন করায় ধন্যবাদ জানান।
মুক্তিযোদ্ধা ও সোসাইটির ট্রষ্টিবোর্ডের সদস্য সরাফ সরকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সহ সকল শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা আর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সম্মান জানিয়ে বলেন, কলেজে পড়ার সময় মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেই। আমার জীবনের বড় পাওনা আমি দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নিতে পেরেছি, আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। তিনি মা-মাটি-দেশ, মুক্তিযোদ্ধা আর দেশের সংস্কৃতিকে ভুলে না যাওয়ার জন্য তিনি প্রবাসীদের প্রতি আহ্বান জানান।
‘গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা’ খ্যাত মীর মশিউর রহমান বলেন, পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্তি পেতেই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেই। আজ আমরা প্রবাসেও বিজয় দিবস পালন করছি। আমাদের চাওয়া দেশ ভালো থাকুক, বাংলাদেশ ‘সোনার বাংলা’ হোক।
নিউইয়র্ক সিটির পাবলিক এডভোকেট পদপ্রার্থী হেলাল শেখ বলেন, আমি মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। একাত্তুরের মুক্তিযুদ্ধ আমাদের গৌরব, আমাদের অহংকার। তিনি আগামী নির্বাচনে সিটির পাবলিক এডভোকেট পদে তাকে সহযোগিতা এবং ভোট দিয়ে বিজয়ী করার জন্য কমিউনিটির প্রতি অনুরোধ জানান।
অনুষ্ঠানের মাঝে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে নিউইয়র্ক ষ্টেট সিনেটর জন ল্যু তার সংক্ষিপ্ত বাংলাদেশী কমিউনিটি ও সোসাইটির কর্মকান্ডের প্রশংসা করে বলেন, আমি ইমিগ্র্যান্টদের কল্যানে কাজ করে চলেছি এবং বাংলাদেশী কমিউনিটির সাথে আছি।
এম আজিজ বলেন, প্রবাসে মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক তথ্য আমাদের জানা নেই। তবু আমরা চেষ্টা করছি দেশের বীর সন্তানদের সম্মানিত করতে। তিনি বলেন, আমরা সোসাইটিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি। ছোট-খাটো ভুল-ভ্রান্তির পরও সম্মিলিতভাবে কাজ করছি। সোসাইটিকে আরো এগিয়ে নিতে তিনি সবার সহযোগিতা কামনা করেন।
সভাপতি কামাল আহমেদ বলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মাননা অব্যাহত রাখবে বাংলাদেশ সোসাইটি। এজন্য সবার সহযোগিতা চাই।
অনুষ্ঠানের বিভিন্ন পর্ব উপস্থাপনায় ছিলেন সভাপতি কামাল আহমেদ ও সাধারণ সম্পাদক রুহুল আমীন সিদ্দিকী।
অনুষ্ঠানের সবশেষে ছিলো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এই পর্বে দেশের গান পরিবেশন করেন শিল্পী রথীন্দ্রনাথ রায় ও শহীদ হাসান। এছাড়াও স্নিন্ধা ও ফাসিল কবির কাব্যসহ দেশ ও প্রবাসের জনপ্রিয় শিল্পীরা সঙ্গীত পরিবেশন করেন। আবহবাংলার গান ও নাচ পরিবেশন করেন সঙ্গীত একাডেমি ও সুর ছন্দ’র শিল্পীরা। সাংস্কৃতিক পর্ব সঞ্চালনা করেন বাংলাদেশ সোসাইটির সাংস্কৃতিক সম্পাদক মনিকা রায়।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ সোসাইটি আয়োজিত বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানটি উপস্থিত দর্শক-শ্রোতাদের মুগ্ধ করলেও কুইন্স প্যালেসে প্রবাসীদের উপস্থিতি ছিলো কম। এজন্য শীতের প্রচন্ড ঠান্ডা আর উইক ডে-তে অনুষ্ঠান আয়োজনকেই দায়ী করেন অনেকে।
ইউএনএ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here