বাংলাদেশে সাধারণত প্রেমের ছবিই সফল হয়। কিন্তু এ মাসের ব্লকবাস্টারটি হলো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জীবনী নিয়ে নির্মিত একটি তথ্যচিত্র। নির্বাচনের মাত্র সপ্তাহকয়েক আগে এটি মুক্তি দেওয়া হয়েছে। ছবির কাহিনী শুরু হয় শেখ হাসিনার পিতা, দেশের স্বাধীনতার নায়ক শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকা- দিয়ে। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের কাহিনীর সঙ্গে মেলবন্ধন ঘটানো হয় হাসিনার জীবন-কাহিনীর।

৩০শে ডিসেম্বর বাংলাদেশী ভোটাররা রায় দেবেন, ২০০৮ সাল থেকে ক্ষমতায় থাকা শেখ হাসিনা ও তার দল আওয়ামী লীগের মেয়াদ বাড়বে কিনা। বাংলাদেশ এশিয়ার সবচেয়ে দ্রুত বর্ধিষ্ণু অর্থনীতির একটিতে পরিণত হওয়ায় সমর্থকরা হাসিনাকে কৃতিত্ব দিয়ে থাকেন। তবে তার সমালোচকরা বলেন, হাসিনা দেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহের মর্যাদা ক্ষুণè করেছেন ও বিপজ্জনক ইসলামিস্টদের ক্ষমতাশালী করেছেন।

১৯৭১ সালে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার যুদ্ধের মাধ্যমে রক্তক্ষয়ী অভ্যুত্থান ঘটে বাংলাদেশের। এরপর থেকে বাংলাদেশের সংক্ষিপ্ত ইতিহাসের বেশিরভাগ জুড়েই ছিল স্বৈরতন্ত্র, অভ্যুত্থান ও রাজনৈতিক হত্যাকা-।

১৯৯১ সাল থেকে দুই বিবদমান নারীর মধ্যেই ক্ষমতার পালাবদল ঘটে। একজন শেখ হাসিনা, আরেকজন খালেদা জিয়া।
২০০৮ সালে শেখ হাসিনার ভূমিধ্বস বিজয়ের মাধ্যমে ক্ষমতা পালাবদলের প্রচলিত ধারার অবসান ঘটে। ২০১৪ সালে খালেদা জিয়ার বিএনপি নির্বাচন বয়কট করে। তবে এবার দলটি নির্বাচনে লড়ছে।

বিএনপির আন্তর্জাতিক মুখপাত্র হুমায়ুন কবির বলেন, ‘গত ১০ বছরে শেখ হাসিনা মানবাধিকার ধুলিস্যাৎ করেছেন। বাংলাদেশ বর্তমানে বেহাল দশায়। সরকার দুর্নীতিতে নিমজ্জিত। ভুগছে সাধারণ মানুষ।’
শেখ হাসিনা তার প্রতিপক্ষের ওপর দমনপীড়ন চালিয়ে আসছেন। ২০১৩ সালে খালেদা জিয়াকে কার্যত গৃহবন্দী করে রাখা হয়। এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে তাকে দাতব্য সংস্থার তহবিল তসরুফের দায়ে ৫ বছরের কারাদ- দেওয়া হয়। সর্বমোট এই ৭২ বছর বয়সী সাবেক প্রধানমন্ত্রী, যিনি ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ ও ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেছিলেন, তার বিরুদ্ধে মামলার সংখ্যা ৩৪টি। তার ছেলে তারেক রহমান বর্তমানে লন্ডনে নির্বাসিত থেকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন। ২০০৪ সালে আওয়ামী লীগের এক সমাবেশে গ্রেনেড হামলায় জড়িত থাকার অভিযোগে তাকে যাবজ্জীবন কারাদ- দেওয়া হয়েছে।
নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে বিরোধী দলের সদস্য ও সমর্থকদের গ্রেপ্তার বেড়েছে। বিএনপি দাবি করছে, কেবল সেপ্টেম্বরেই ৪৫০০ জন আটক হয়েছেন। এছাড়া নির্বাচন কমিশন বহু আসনে বিএনপি প্রার্থীদের অযোগ্য ঘোষণা করে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, ‘এমনও হয়েছে যে একজন প্রার্থীর বিরুদ্ধেই শতাধিক মামলা। এসবের বেশিরভাগই মিথ্যা।’ তিনি আরও বলেন, ‘অনেক বিএনপি প্রার্থী লড়তে ভয় পাচ্ছে। তাদের অনেক কর্মী ও অনুসারী আত্মগোপনে।’
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মীনাক্ষী গাঙ্গুলি বলেন, শেখ হাসিনা এমনিতেও হয়তো নায্যভাবে এই নির্বাচন জিততে পারতেন। এর একটি কারণ হলো, খালেদা জিয়ার গতবারের শাসনামলেও দুর্নীতি, সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন ও মানবাধিকার লঙ্ঘণ হয়েছে অনেক।
শেখ হাসিনার অর্জন অনেক। তার এক দশকের শাসনামলে, প্রতি বছর অর্থনীতি ৬.৩ শতাংশ করে বেড়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রবৃদ্ধির হার ভারত ও পাকিস্তানের সমান কিংবা বেশি ছিল বাংলাদেশের। এছাড়া ৪২০০ কোটি ডলারের চীনা বিনিয়োগও আকৃষ্ট করেছে বাংলাদেশ।
শিশুমৃত্যুর হার কমেছে। প্রজনন হার কমেছে। স্কুলে অংশগ্রহণ বেড়েছে ১০ শতাংশেরও বেশি। আওয়ামী লীগের মোহাম্মদ শাহাবুদ্দিন বলেন, ‘বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের ভূমিকা হলো গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ উন্নয়নের দিকে ধাবিত হচ্ছে।’
সাম্প্রতিককালে, মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা ৭ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রশংসা পেয়েছেন শেখ হাসিনা। মীনাক্ষী গাঙ্গুলি বলেন, ‘কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হলো, শেখ হাসিনা এতটাই কর্তৃত্বপরায়ণ হয়েছেন যে মানুষ তার বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে বাধ্য হয়েছে। আওয়ামী লীগের উচিৎ ক্ষমতা থেকে বিদায় নেওয়া। তারা এখন স্রেফ উৎপীড়ক বৈ কিছু নয়।’
মীনাক্ষী গাঙ্গুলির মতে, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আইন নিজের হাতে তুলে নিচ্ছে। মে মাসের পর প্রায় ৩০০টি বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ের ঘটনা ঘটেছে। সেপ্টেম্বরে আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের সদস্যরা ঢাকায় নিরাপদ সড়কের দাবিতে প্রতিবাদরত শিক্ষার্থীদের পিটিয়েছে।
সরকার অবশ্য বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- ও হিংস্র আচরণ করার অভিযোগ অস্বীকার করে। সরকারের বক্তব্য, যারা মারা গেছে তারা গ্রেপ্তারে বাধা দিতে গিয়ে অথবা পুলিশের ক্রসফায়ারে পড়ে মারা গেছে। অপরদিকে ওই শিক্ষার্থী আন্দোলনের নেপথ্যে ছিল মূলত বিএনপির সদস্যরা, যাদের উদ্দেশ্য ছিল দেশে অস্থিরতা সৃষ্টি করা।
গণমাধ্যম ও বিচারবিভাগও আক্রমণের শিকার হয়েছে। তবে হাসিনার অনেক সমালোচক সবচেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন ধর্মনিরপেক্ষতার করুণ অবস্থা নিয়ে। সুইডেনে স্বেচ্ছা-নির্বাসনে থাকা বাংলাদেশী লেখক তাসনিম খলিল বলেন, ‘হাসিনা বিপজ্জনক ইসলামি গোষ্ঠীগুলোর জন্য জায়গা তৈরি করে দিচ্ছেন।’
আওয়ামী লীগ প্রায় ৪০টির মতো ইসলামিস্ট সংগঠনের সঙ্গে মৈত্রী করেছে। এদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো হেফাজতে ইসলাম, যেটি শরিয়া আইন প্রণয়নের আহ্বান জানায়। তাসনিম খলিল বলছেন, এই সংগঠনের সঙ্গে আল কায়দার মতো সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সম্পর্ক রয়েছে। তার ভাষ্য, ‘এই সংগঠনগুলো ও তাদের ভোট ব্যাংক প্রয়োজন হাসিনার। এ কারণে তিনি তাদেরকে সরকারের ছত্রছায়ায় নিয়ে আসছেন।’ আওয়ামী লীগ প্রায় ৩০ জনেরও বেশি হেফাজত সদস্যকে নির্বাচনে প্রার্থী করেছে। এছাড়া সম্পর্ক আরও গাঢ় করতে, শেখ হাসিনা মাদ্রাসা শিক্ষাকে মাস্টার্স ডিগ্রির সমমানে উন্নীত করেছেন।
অনেকেই মনে করেন, একসময় যারা ছিল বিচ্ছিন্ন কিছু গোষ্ঠী তারা এখন ক্রমেই মূলধারায় চলে আসছে। এটি দেশের সংখ্যালঘুদের জন্য বিশেষ করে উদ্বেগের বিষয়, যারা মোট জনসংখ্যার প্রায় ১০ ভাগ। এক খ্রিস্টান নারী, যিনি একবার প্রার্থণা শেষে পাথর নিক্ষেপের শিকার হয়েছিলেন, তার ভাষ্য, ‘আমি বিপন্ন বোধ করছি।’
সুশাসনের জন্য নাগরিক নামে একটি সংগঠনের প্রধান বদিউল মজুমদার বলেন, ‘বিষয়টা এখন এমন যে, কেউ যদি আমার বন্ধু না হয়, তার মানে তারা আমার শত্রু। সরকার যত ভয় পাচ্ছে ততই চরম আচরণ করছে।’
রাজনৈতিক মতপ্রকাশের সুযোগ সঙ্কুচিত হওয়ায়, বদিউল মজুমদারের আশঙ্কা, চরমপন্থীদের হাতে এই দেশের কর্তৃত্ব চলে যাওয়াটা হয়তো ঠেকানো যাবে না। তিনি বলেন, ‘ক্ষুদ্ধ ও বিরক্ত জনগণ ও তরুণরা হয়তো গণতান্ত্রিক পদ্ধতির ওপর আশা হারিয়ে ফেলবে। এরপর বিকল্প সমাধানের দিকে নজর দেবে, সেটা হলো ধর্মীয় সমাধান।’
(লন্ডন-ভিত্তিক সংবাদপত্র ফিন্যান্সিয়াল টাইমস বিশ্বের অন্যতম প্রধান আর্থিক পত্রিকা। ২৪শে ডিসেম্বর পত্রিকাটির অনলাইন সংস্করণে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ পোল সিন অ্যাজ চয়েস বিটুইন ফ্রিডম অ্যান্ড প্রসপ্যারিটি’ শীর্ষক প্রতিবেদনের অনুবাদ।)

সুত্র: মানবজমিন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here