আবদুল মান্নান

একাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ তথা মহাজোট প্রার্থীদের চোখ-ধাঁধানো বিজয় দেখে দেশে ও দেশের বাইরে যারা বাংলাদেশে ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাস করেন, তাঁরা সবাই শুধু খুশিই হননি, হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছেন। যদিও এমন ফলাফল অভাবনীয়, তথাপি দেশের মানুষ কিছুটা হলেও শঙ্কিত ছিল। কারণ কোনো দৈব-দুর্বিপাকে যদি ফলাফল উল্টোটা হতো, তাহলে ২০০১ সালের নির্বাচনের পর দেশে যে ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল তার চেয়েও ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো, যা চিন্তা করলেও গা শিউরে ওঠে। সেই নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াতের বিজয়ের পর দক্ষিণবঙ্গসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় যে মাত্রার সন্ত্রাস সৃষ্টি করা হয়েছিল, এবার যদি বিএনপি-জামায়াত জোট বিজয় লাভ করত, সেই সন্ত্রাসের মাত্রা বহুগুণ বৃদ্ধি পেত। সেবার শুধু দক্ষিণবঙ্গে প্রায় ৩০ হাজার মানুষ ভিটামাটি থেকে উচ্ছেদ হয়ে এলাকা ছেড়েছিল এবং তাদের মধ্যে কয়েক হাজার মানুষ দেশত্যাগ করেছিল। এই ভয়াবহ পরিস্থিতি প্রায় এক বছর স্থায়ী হয়েছিল।

সদ্যঃসমাপ্ত নির্বাচন বানচাল করার জন্য লন্ডনে বসে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান পাকিস্তানি সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইকে নিয়ে যে ষড়যন্ত্র করেছিল, তা বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশ যে অন্ধকারে তলিয়ে যেত, তা থেকে উঠে আসা কঠিন হতো। এবারের নির্বাচনে সব প্রার্থী যে নিজের যোগ্যতায় বিজয়ী হয়েছেন তা ভাবলে ভুল হবে। অনেকের বিজয়ের পেছনে দুটি প্রতীক কাজ করেছে। প্রথমটি হচ্ছে আওয়ামী লীগপ্রধান ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার ব্যক্তি ইমেজ আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে আওয়ামী লীগের ঐতিহাসিক দলীয় প্রতীক নৌকা। শেখ হাসিনা এখন শুধু একজন প্রধানমন্ত্রীই নন, তিনি এরই মধ্যে দেশের ও দলের জন্য একটি ব্র্যান্ডে পরিণত হয়েছেন। বিশ্বে স্বীকৃত হয়েছেন একজন রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে। ১৯৯৬ সালের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আর ২০১৮ সালের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মধ্যে অনেক তফাত। ১৯৯৬ সালে তিনি ছিলেন সদ্য অভিষিক্ত একজন অনভিজ্ঞ প্রধানমন্ত্রী, তবে তিনি চেষ্টা করেছেন দ্রুত রাষ্ট্রাচার রপ্ত করে নিতে। এটি স্বীকার করতেই হয়, তখন প্রশাসন তাঁর নিয়ন্ত্রণে তেমন একটা ছিল না। তাঁর অনেক উদ্যোগ সাফল্যের মুখ দেখেনি প্রশাসনিক বাধার কারণে। তবে সেই মেয়াদে তিনি বাংলাদেশকে উন্নয়নের সড়কে তুলে দিয়েছিলেন, যা ২০০১ সালে খালেদা জিয়া ক্ষমতায় এসে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। সদ্যঃসমাপ্ত নির্বাচনের ফলাফল অনেকটা ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন আর ১৯৭০ ও ১৯৭৩ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পুনরাবৃত্তি। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে পরম পরাক্রমশালী মুসলিম লীগের কবর রচনা করে দিয়েছিল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট। এবারের নির্বাচনে এই ধস নামানো বিজয়ের জন্য শেখ হাসিনাকে টুপি খোলা অভিনন্দন।

একটি কার্যকর সংসদের জন্য প্রয়োজন এমন একটি বিরোধী দল, যারা সরকারের গঠনমূলক সমালোচনা করবে। বিএনপি কখনো শুধু সরকারি বা বিরোধী দল নয়, একটি দায়িত্বশীল রাজনৈতিক দল হিসেবে সংসদে ভূমিকা পালন করেনি। সংসদে তাদের দুবার বিরোধী দলে বসতে হয়েছে। একবার ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে, আর দ্বিতীয়বার ২০০৮-২০১৩ মেয়াদে। দুবারই তারা সংসদে ফাইল ছোড়া, টিভি-ক্যামেরা আর চেয়ার ভাঙা ও গালাগাল করা ছাড়া তেমন কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি। পরেরবার সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া মাত্র পাঁচ দিন উপস্থিত ছিলেন। প্রথমবারের চিত্রটাও ভিন্ন কিছু নয়। যেহেতু জাতীয় পার্টি এই নির্বাচনে নিজেদের প্রতীক নিয়ে ২২টি আসনে বিজয় লাভ করেছে, সেহেতু তারা হতে পারে একটি দায়িত্বশীল বিরোধী দল। গতবারও তাদের ভূমিকা খারাপ ছিল না, যদিও তারা সরকারেরও অংশ ছিল। বিশ্বের অনেক দেশে এর আগে এমনটি হয়েছে। মালয়েশিয়া বা সিঙ্গাপুরে দীর্ঘদিন ধরে তেমন কার্যকর বিরোধী দল নেই। তার পরও তাদের সংসদ বেশ প্রাণবন্ত ও কার্যকর। সব সংসদ সদস্য দেশের কল্যাণে কথা বলেন, কাজ করেন। কোনো কিছু ভাঙাভাঙির মধ্যে তাঁরা নেই। ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ২৯৩টি আসনে জয়ী হয়েছিল। তার পরও সংসদ অত্যন্ত দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করেছে। সত্তরের নির্বাচেন বিজয়ী সব জাতীয় পরিষদ সদস্য ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের নিয়ে গণপরিষদ গঠিত হয়েছিল, যাঁরা দেশের প্রথম সংবিধান, ১৯৭২ সালের সংবিধান সংসদে পাস করিয়েছিলেন। সেই সংসদে সিলেটের একটি আসন থেকে নির্বাচিত ন্যাপের সুরঞ্জিৎ সেনগুপ্ত ছিলেন একমাত্র উচ্চকণ্ঠ বিরোধীদলীয় সদস্য। কখনো স্পিকার তাঁকে থামতে বললে বঙ্গবন্ধু ফ্লোর নিয়ে স্পিকারকে অনুরোধ করতেন, তিনি যেন সুরঞ্জিৎ সেনগুপ্তকে বলতে দেন। সংসদে সুরঞ্জিৎ সেনগুপ্তের বাগ্মিতা যেকোনো মানুষকে বিমোহিত করত।

এবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠন করবে, তা নিয়ে ড. কামাল হোসেনের ঐক্যফ্রন্ট ও বিএনপি ছাড়া অন্য কারো মনে তেমন কোনো সন্দেহ ছিল না। ঐক্যফ্রন্টের কিছু নেতা তো শেষের দিকে নিজেদের সার্কাসের ক্লাউনের পর্যায়ে নিয়ে এসেছিলেন। একজন জানিয়ে দিলেন, আওয়ামী লীগ যদি উনিশটার বেশি আসন পায়, তাহলে তিনি চুড়ি পরবেন। অন্য আরেকজন ঘোষণা করলেন, ৩০ তারিখ নির্বাচনে বিজয় লাভ করে তাঁরা জানুয়ারির ২ তারিখ খালেদা জিয়াকে মুক্ত করে আনবেন। আরেকজন বললেন, খালেদা জিয়া ১ তারিখে মুক্ত হবেন। সবার কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছিল, ঐক্যফ্রন্ট কিছু মানসিকভাবে অসুস্থ ব্যক্তির সমষ্টি ছাড়া আর কিছু নয়।

গত ৩ জানুয়ারি ঐক্যফ্রন্টের সাতজন বিজয়ী ছাড়া বাকি নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা শপথ নিয়েছেন। এরশাদ এখনো বাদ আছেন। সম্ভবত তিনি আরো কয়েক দিন পর শপথ নেবেন। সৈয়দ আশরাফ অসুস্থতাজনিত কারণে শপথ নিতে পারেননি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে ৩ জানুয়ারি রাতে তিনি ব্যাংককের একটি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেছেন। আওয়ামী লীগ তাদের একজন পরীক্ষিত নক্ষত্র হারাল। সোমবার মন্ত্রিসভার শপথ নেওয়ার দিন। নির্বাচনের পর সবার প্রশ্ন—প্রধানমন্ত্রী বা নতুন সরকারের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ কী? এর উত্তর হচ্ছে, প্রথমে মন্ত্রিসভায় যোগ্য ও সৎ ব্যক্তিদের ঠাঁই দেওয়া, যাঁরা হবেন কর্মনিষ্ঠ, পরিশ্রমী এবং আধুনিক চিন্তা-চেতনা সহজে ধারণ করতে পারেন। তাঁরা হবেন বিনয়ী এবং নিজের ওপর অর্পিত দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন। আমার এই কলামে নির্বাচনের আগে লিখেছিলাম, ‘শেখ হাসিনার দৃষ্টিসীমায় ইতিহাস’। সেই ইতিহাস রচনা করার সময় এখন সমাগত। পর পর তিনবার দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়ে শেখ হাসিনা ইতিহাস সৃষ্টি করবেন, যা ড. কামাল হোসেন গং একেবারে বরদাশত করতে পারছেন না। তিনি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিয়ে প্রশ্ন রেখেছেন—কেন পর পর তিনবার একটি দল ক্ষমতায় থাকবে। থাকবে এ কারণেই, কারণ বাংলাদেশে এই মুহূর্তে শেখ হাসিনার সমকক্ষ প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতাসম্পন্ন কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব নেই, ড. কামাল হোসেনও না। ভবিষ্যতেও দেখা যাবে, তেমনটি এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে না। নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ তথা শেখ হাসিনা একটি নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেছিলেন।

একটি ইশতেহার হচ্ছে, একটি দল নির্বাচনে বিজয় লাভ করলে জনগণের জন্য কী করবে তার একটি বিস্তারিত খতিয়ান। বলা যেতে পারে অঙ্গীকার। ২০০৮-এর নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের ইশতেহারের শিরোনাম ছিল ‘দিনবদলের সনদ’। তার ধারাবাহিকতায় ২০১৪ সালের নির্বাচনও অনুষ্ঠিত হয়েছিল, যাতে জামায়াত-বিএনপি অংশগ্রহণ করেনি। টানা দুই মেয়াদে সরকারে থাকার পর সরকারি দল তো এই দাবি করতেই পারে, তারা শুধু বাংলাদেশের জনগণের দিনই বদল করে দেয়নি, বরং বিদায়ি সরকার বাংলাদেশকে উন্নয়নের এক ঈর্ষণীয় পর্যায়ে নিয়ে গেছে। সর্বক্ষেত্রে বর্তমান বাংলাদেশ আর দশ বছর আগের বাংলাদেশ এক নয়। যদিও এই পরিবর্তন রিজভী-মান্না গংয়ের চোখে পড়ে না। অবশ্য তা বিশ্ব স্বীকার করে নিয়েছে। এবারের ইশতেহারের মূল বিষয় হচ্ছে, উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা এবং বাংলাদেশকে ২০২৪ সালের আগেই উন্নয়নশীল দেশের কাতারে শামিল করে দেওয়া। এই অঙ্গীকার কত দ্রুত বাস্তবায়ন হবে, তা প্রাথমিকভাবে নির্ভর করবে মন্ত্রিসভার দক্ষতার ওপর, যা গঠন করতে পিতা বঙ্গবন্ধুর মতো তাঁর কন্যাও যে পারদর্শী, এরই মধ্যে তিনি সেই স্বাক্ষর রেখেছেন। নির্বাচনের পর বিভিন্ন জেলা থেকে দাবি ওঠে, তাদের জেলা থেকে এবার এতজনকে মন্ত্রিসভায় স্থান দিতে হবে। মন্ত্রিসভার দায়িত্ব বণ্টন পিঠা ভাগ করা নয়। কাকে দিয়ে কী কাজ হবে, বঙ্গবন্ধুকন্যা তা ঠিকই জানেন। বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভায় বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রী ছিলেন মফিজ চৌধুরী (মফিজ আলী চৌধুরী, গণপরিষদ সদস্য, বগুড়া-১)। তিনি ‘বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভায়’ শিরোনামে একটি বই লিখেছিলেন। সেই বই পড়লে যেকোনো পাঠক বুঝতে পারবেন, বঙ্গবন্ধু কত চিন্তাভাবনা করে তাঁর মন্ত্রিসভা সাজিয়েছিলেন। তবে তাঁর অনেক কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নে বাদ সেধেছিলেন বেশ কিছু আমলা, যাঁদের অনেকেই তাঁর মৃত্যুর পর জিয়ার মন্ত্রিসভায় ঠাঁই পেয়েছিলেন। মন্ত্রিসভার গঠনটি যদি ঠিকমতো হয়, তাহলে সাধারণ মানুষের কাছে এই বিশ্বাস জন্মাবে যে দলের ইশতেহারে যে অঙ্গীকার করা হয়েছিল, তা তিনি বাস্তবায়নে বদ্ধপরিকর।

বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করার পর তাঁদের বিরুদ্ধে অসততার কোনো অভিযোগ কেউ আনতে পারেনি। কেউ বলতে পারেনি, মন্ত্রী হওয়ার পর অমুক মন্ত্রী এত সম্পদের মালিক হয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর উপ-রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের স্ত্রী (মৃত্যু, ফেব্রুয়ারি ২০০১) মৃত্যুর আগে টিভিতে এক সাক্ষাৎকার দিয়ে বলেছিলেন, তিনি রাজউকের কাছে ঢাকায় একটি প্লট পাওয়ার জন্য আবেদন জমা দিয়েছিলেন। প্লট তো পানইনি, তাঁর জমা করা টাকাটাও আর ফেরত পাননি। সদ্যঃপ্রয়াত তাঁর বড় সন্তান সৈয়দ আশরাফের স্ত্রী কিছুদিন আগে লন্ডনে মৃত্যুবরণ করেছেন। তাঁর একমাত্র কন্যা একটি ব্যাংকের কর্মকর্তা। মন্ত্রী ছাড়াও সৈয়দ আশরাফ দলের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। শেখ হাসিনার মন্ত্রিসভায় সৈয়দ আশরাফ ছিলেন সততার এক উজ্জ্বল উদাহরণ। শুধু বঙ্গবন্ধু বা জাতীয় চার নেতাই নন, তাঁদের হত্যা করার পর তাঁদের পরিবারের বা বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভা বা আওয়ামী লীগের কোনো সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে দুর্নীতির কোনো অভিযোগ কেউ তুলতে পারেনি। সেই সময় অনেক সুযোগ থাকা সত্ত্বেও দলে বা রাজনীতিতে কোনো তারেক রহমান বা হাওয়া ভবন সৃষ্টি হয়নি, যদিও সুযোগ ছিল অনেক। কারণ তখন অর্থনীতি লাইসেন্স আর পারমিটনির্ভর ছিল। এর সুযোগ গ্রহণ করেছিল কিছু অসৎ ব্যবসায়ী আর জাত চোরাকারবারি। এরা পরে সবাই জিয়ার সঙ্গে গিয়ে জুটেছিল।

বৃহস্পতিবার শপথ নেওয়ার পর দলের সংসদ সদস্যদের উদ্দেশে ভাষণ দিতে গিয়ে দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘ক্ষমতাকে সম্পদ অর্জনের হাতিয়ার বানাবেন না। ক্ষমতা ব্যক্তিসম্পদ নয়।’ এরপর সংসদ সদস্যদের প্রতি উপদেশ দেওয়ার মতো আর কিছু থাকে না। এ কথাগুলো এবার যাঁরা প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য হয়েছেন, তাঁদের বেলায় সবচেয়ে বেশি প্রযোজ্য। কারণ তাঁদের সামনে রাজনীতির অনেক দীর্ঘপথ অপেক্ষা করছে। এবার শেখ হাসিনা মনোনয়ন দেওয়ার সময় একঝাঁক নতুন প্রজন্মকে মনোনয়ন দিয়েছিলেন। এতেই তাঁর প্রজ্ঞার পরিচয় মেলে। এই নতুন প্রজন্মই তো হবে আগামী দিনে বাংলাদেশের কাণ্ডারি। এখান থেকেই হয়তো উঠে আসবে একজন বঙ্গবন্ধু কিংবা শেখ হাসিনা।

২০২০ সালে পালিত হবে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী আর ২০২১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর। এই সময় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় থাকাটা খুবই জরুরি ছিল এবং দেশের মানুষ নির্বাচনে সেই ম্যান্ডেটই দিয়েছে। নির্বাচিত সংসদ সদস্য বা মন্ত্রিসভার সদস্যদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে শুধু যুদ্ধ ঘোষণা করলেই হবে না, নিজেরা সব দুর্নীতি থেকে দূরে থাকতে হবে। পূর্ব-অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, কিছু সংসদ সদস্য ও মন্ত্রীকে ঘিরে ফেরেববাজ, ধান্দাবাজ আর দুর্নীতিপরায়ণদের একটি বলয় সৃষ্টি হয়। এরা ব্যক্তি আর সরকারের সুনামের বারোটা বাজায়। যেকোনো পরিস্থিতিতে এ ব্যাপারে সবাই সজাগ থাকবে বলে দেশের মানুষ আশা করে। এটা সবার জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জ। সুশাসন প্রতিষ্ঠা যেকোনো সরকারের জন্যই একটা বড় চ্যালেঞ্জ। সেই সুশাসন শুধু যে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে হবে তা কিন্তু নয়, হতে হবে সব প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে। নির্বাচনের পরপরই দলের নাম ব্যবহার করে নোয়াখালীর সুবর্ণচরে একদল দুর্বৃত্ত নতুন সরকারের যাত্রার প্রাক্কালেই এক গৃহবধূকে গণধর্ষণ করে আরেকটি পূর্ণিমা শীলের অঘটনের জন্ম দিয়েছে। এরই মধ্যে তাকে ও তার দলের অন্য দুর্বৃত্তদের পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। দেশে সুশাসন আছে, তা প্রমাণিত হবে তখন, যখন এইসব দুর্বৃত্তকে আইনের আওতায় এনে সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান করা হবে। এমন দুর্বৃত্তের কোনো প্রয়োজন তো আওয়ামী লীগের হতে পারে না। খোঁজ নিলে দেখা যাবে, এরা হচ্ছে দলে অনুপ্রবেশকারী সেই সব হাইব্রিড, যাদের ডাকনাম হয় ‘কাউয়া’।

যাত্রার শুরুতে নতুন সরকারের কাছে প্রত্যাশার কথা বলতে গিয়ে এত কথা বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে একটাই। আর তা হচ্ছে, বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা এই দেশে একটি নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন তা-ই নয়, তিনি ইতিহাসে অমরত্ব লাভ করার দোরগোড়ায়। আর সেটি নির্ভর করে তাঁর দলের সংসদ সদস্য আর তাঁর গঠিত আগামী দিনের মন্ত্রিসভার ওপর। এই মুহূর্তে নতুন সরকারের জন্য যেসব সংস্কারকাজে দ্রুত হাত দিতে হবে, তা হচ্ছে ব্যাংকিং, শিক্ষা আর জনপ্রশাসন। এই সেক্টরগুলো সঠিকভাবে চললে বাংলাদেশের উন্নয়নের অগ্রযাত্রা কেউ রুখতে পারবে না। কোনো কোনো সময় শাসককে জনগণের স্বার্থে কিছু ব্যাপারে নির্দয় হতে হয়। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ ব্যাপারে যে সজাগ, তা তিনি এর আগে অনেকবার প্রমাণ করেছেন। এবারের প্রেক্ষাপট কিছুটা ভিন্ন্ন, কারণ সামনে বঙ্গবন্ধুর জন্মশত বছর আর বাংলাদেশের স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর সামনে। বাংলাদেশের এমন বিজয় চলমান থাকুক, তাতেই দেশের জন্য জীবন উৎসর্গকারী ৩০ লাখ শহীদ শান্তিতে ঘুমাবেন।

লেখক : বিশ্লেষক ও গবেষক

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here