নিউজিল্যান্ডে মসজিদে হামলা : ৩ বাংলাদেশিসহ নিহত ৪৯

0
370

বাংলা খবর ডেস্ক:
নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চ। মসজিদ আল নূর ও লিনউড মসজিদের বাইরে শান্তভাবে গাড়ি পার্কিং করে হামলাকারী ব্রেনটন টেরান্ট। তার গাড়িতে বাজছিল গান। ঠাণ্ডা মাথায় গাড়ি থেকে নেমে যায় সে। গাড়ির পিছন থেকে বের করে অটোমেটিক রাইফেল। সেখানে আরো অস্ত্র ছিল। দেখে মনে হয়েছে আধুনিক কোনো অ্যাসাল্ট রাইফেল। এর ১০ মিনিট আগে জুমার নামাজ শুরু হয়েছে মসজিদে।

তখন মুসল্লিতে ঠাসা ওই মসজিদ দুটি। শান্ত পায়ে অস্ত্র হাতে নিয়ে মসজিদে ঢুকে সে। এরপর সামনে যাকেই পেয়েছে তাকেই গুলি করেছে। ভেতরে প্রবেশ করে এলোপাতাড়ি গুলি করতে থাকে। গুলি শেষ হয়ে গেলে বারবার ম্যাগাজিন রিলোড করছিল। একপর্যায়ে মসজিদের মধ্যে থাকা আহতদের গুলি করে মৃত্যু নিশ্চিত করে। মসজিদের ভেতরে রক্তের বন্যা বাধিয়ে শান্তভাবে বেরিয়ে আসে হামলাকারী।

Police cordon off the area in front of the Masjid al Noor mosque after a shooting incident in Christchurch on March 15, 2019. – Attacks on two Christchurch mosques left at least 49 dead on March 15, with one gunman — identified as an Australian extremist — apparently livestreaming the assault that triggered the lockdown of the New Zealand city. (Photo by Tessa BURROWS / AFP)

হামলার পর আল নুর মসজিদের সামনে নিরাপত্তারক্ষা কর্মীরা। ইনসেটে হামলাকারী ব্রেন্টন টারান্ট – এএফপি

তার নৃশংসতার কবল থেকে মাত্র দু’চার মিনিটের জন্য রক্ষা পেয়েছেন বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের তারকারা। শুক্রবার জুমার নামাজ আদায় করতে তারা ওই সময় গিয়েছিলেন মসজিদে। ভিতরে রক্তে তখন সয়লাব। রক্তাক্ত এক নারী মসজিদ থেকে বেরিয়ে আসছিলেন রুদ্ধশ্বাসে। আরেকজন নারী তাদের ভিতরে প্রবেশ করতে বারণ করেন। বলেন মসজিদের ভিতরে গোলাগুলি হচ্ছে। গা শিউরে ওঠে বাংলাদেশ অধিনায়ক মাহমুদুল্লাহ বাহিনীর। তাদের সঙ্গে ছিলেন সাবেক টেস্ট অধিনায়ক মুশফিকুর রহিম। তিনি লিখেছেন, ক্রাইস্টটার্চ মসজিদে হামলার সময় আল্লাহ আজ আমাদের রক্ষা করেছেন। আমরা অত্যন্ত ভাগ্যবান। সন্ত্রাসী ব্রেনটন টেরান্ট ততক্ষণ মসজিদের ভিতরে এলোপাতাড়ি গুলি করে কমপক্ষে ৪৯ জনকে হত্যা করেছে। তার মধ্যে রয়েছেন তিনজন বাংলাদেশি। নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে দুটি মসজিদে গতকাল এভাবেই সন্ত্রাসী হামলা হয়। এরপর ক্রাইস্টচার্চ কর্তৃপক্ষ ওই শহরের সব মসজিদ পরবর্তী নোটিশ না দেয়া পর্যন্ত বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছে। বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে সব স্কুলও।

এ হামলায় বিশ্বজুড়ে নিন্দার ঝড় উঠেছে। বৃটিশ পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ হাউস অব কমন্সে নিহতদের স্মরণে পালন করা হয়েছে এক মিনিট নীরবতা। বিশ্বনেতারা নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন। তবে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প কোনো নিন্দা জানান নি। এ দিনটিকে নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জেসিনদা আর্ডেন অন্ধকারময় দিন হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি এ হামলাকে সন্ত্রাসী কার্যক্রম হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। বলেছেন, যারা এ হামলার সঙ্গে জড়িত তারা সকলেই সন্ত্রাসী। তবে নিরাপত্তা বাহিনীর নজরদারির তালিকায় তাদের নাম ছিল না। তিনি প্রথমে নিশ্চিত করেন নিহতের সংখ্যা কমপক্ষে ৪০। পরে পুলিশ নিশ্চিত করে নিহতের সংখ্যা কমপক্ষে ৪৯। আহতদের মধ্যে কমপক্ষে ২০ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। হামলার পর ৪ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ধারণা করা হয়, এর মধ্যে ৩ জনই হামলার সঙ্গে সমপৃক্ত।

নিউজিল্যান্ডের মসজিদগুলোতে শুক্রবারই সবথেকে বেশি মানুষ নামাজ পড়তে যান। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, হামলাকারী ব্রেনটন টেরান্ট একাই অস্ত্র হাতে নিয়ে গুলি শুরু করে। ইতিমধ্যে পুলিশ তার ছবি ও পরিচয় প্রকাশ করেছে। ব্রেন্টন টেরান্ট নামের এই সন্ত্রাসী অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক। হামলার পর এর সমর্থনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ৮৭ পৃষ্ঠার একটি ঘোষণা প্রকাশ করে সন্ত্রাসীরা। পুলিশ বলেছে, ‘ব্রেনটন টেরান্ট ফ্রম’ অ্যাকাউন্টের মালিকও হামলায় যুক্ত ছিল। ঘোষণায় তারা, মুসলিম শরণার্থীবিদ্বেষী বক্তব্য তুলে ধরে। তবে এতে কারো কোনো স্বাক্ষর ছিল না।

পুলিশ কমিশনার মাইক বুশ নিহতের সংখ্যা নিশ্চিত করেছেন। তিনি স্থানীয় সময় শুক্রবার বিকালে সংবাদ সম্মেলন করেন। বলেন, ডিন্স এভিনিউয়ে আল নূর মসজিদে ৪১ জন এবং লিনউড এলাকার অন্য মসজিদে সাত জন নিহত হয়েছেন। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন আরো একজন। আহত কমপক্ষে ৪৮ জন ক্রাইস্টচার্চ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। এর মধ্যে রয়েছে শিশুরাও। খুব জরুরি না হলে আহতদের দেখতে হাসপাতালে ভিড় না করতে সবার প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। মাইক বুশ বলেছেন, এ হামলায় আটক করা হয়েছে চারজনকে। এর মধ্যে তিনজন পুরুষ ও একজন নারী। এর মধ্যে ২০ বছর বয়সী এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। এ কথা জানিয়ে মাইক বুশ বলেছেন, শনিবার ওই ব্যক্তিকে আদালতে উপস্থাপন করা হবে।

এ হামলাকে ‘নজিরবিহীন’ এবং ‘সন্ত্রাসী হামলা’ বলে বর্ণনা করেছেন প্রধানমন্ত্রী অর্ডেন। তিনি বলেছেন, নিশ্চিতভাবেই পরিকল্পনা করে এ হামলা চালানো হয়েছে। হামলার পর শোক প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী আর্ডেন বলেন, এটা নিউজিল্যান্ডের অন্ধকারতম দিনগুলোর একটি। এখানে যে ঘটনা ঘটেছে সেটা পরিষ্কারভাবেই অস্বাভাবিক এবং অপ্রত্যাশিত নৃশংসতা।

এ হামলার প্রত্যক্ষদর্শী মোহন ইব্রাহিম বাংলাদেশি। তিনি নিউজিল্যান্ডে গিয়ে থিতু হয়েছেন। যখন আল নূর মসজিদে ওই হামলা হয় তখন এর ভিতরে ছিলেন তিনি। তবে কৌশলে তিনি জীবন বাঁচিয়ে বেরিয়ে আসতে পেরেছেন। তিনি এখন থেকে ৫ বছর আগে একজন ছাত্র হিসেবে নিউজিল্যান্ডে গিয়েছেন। বলেছেন, ওই এলাকার বহু মানুষকে আমি চিনি, জানি। মসজিদে গেলেই তাদের সঙ্গে নিয়মিত দেখাসাক্ষাৎ হতো। এখন আর এসব মানুষ বেঁচে নেই। এ কথা মেনে নিতে পারছি না। যা দেখেছি, তার জন্য আমার চোখকে বিশ্বাস করতে পারছি না। তিনি বলেন, এমন দৃশ্য কখনোই প্রত্যাশিত ছিল না। আমি তো জানি নিউজিল্যান্ড হলো বিশ্বের সবচেয়ে নিরাপদ দেশগুলোর অন্যতম। কিন্তু এখন আমি আতঙ্কিত। আমি নিজের চোখে যা দেখেছি তা আমি কখনো কল্পনাও করতে পারি নি।

নিউজিল্যান্ডে হামলায় নিহতদের মধ্যে তিনজন বাংলাদেশি
নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে দুই মসজিদে হামলায় নিহতদের মধ্যে অন্তত তিনজন বাংলাদেশি রয়েছেন বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশের অনারারি কনসাল ইঞ্জিনিয়ার শফিকুর রহমান। তিনি বলেছেন, গুলিবিদ্ধ অবস্থায় আরো চার বাংলাদেশিকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। অন্যদিকে এই ঘটনায় একজন নিখোঁজ রয়েছেন বলে স্থানীয় বাংলাদেশি কমিউনিটির কাছ থেকে খবর পেয়েছেন তিনি। নিহত বাংলাদেশিরা হলেন- লিংকন ইউনিভার্সিটির শিক্ষক ড. আবদুস সামাদ ও তার স্ত্রী এবং হোসনে আরা ফরিদ নামের এক গৃহবধূ। আবদুস সামাদ এক সময় বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। আবদুস সামাদ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ছেড়ে নিউজিল্যান্ডে যান।

সেখানে দীর্ঘদিন ধরে বাস করছেন তিনি। লিংকন ইউনিভার্সিটিতে কৃষি বিষয়ে অধ্যাপনা করতেন। গতকাল শুক্রবার জুমার নামাজের সময় ক্রাইস্টচার্চের আল নূর ও লিনউড মসজিদে এই হামলার ঘটনায় অন্তত ৪৯ জন নিহত হন। আহত হন আরো ৪৮ জন। শুক্রবার অনেকেই জুমার নামাজ পড়তে আল নূর মসজিদে গিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে কয়েকজন না ফেরায় পরিবারের সদস্যরা ফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেন। কিন্তু না পেয়ে খোঁজ শুরু করেন। পরে হাসপাতালে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় কয়েকজনের ভর্তি হওয়ার খবর পাওয়া যায়। তাদের মধ্যে তিনজন মারা যান। শুক্রবার জুমার নামাজের সময় এই হামলা চালায় মুসলিম বিদ্বেষী অস্ট্রেলিয়ান এক নাগরিক। প্রথমে আল নূর মসজিদে হামলা চালায় সে। পরে পার্শ্ববর্তী লিনউড মসজিদে হামলা চালায়। নৃশংস ওই হত্যাকাণ্ডের পুরো ঘটনা ফেসবুক লাইভে প্রচার করে হামলাকারী।

সন্ত্রাসীর অস্ত্র কেড়ে নেন মসজিদের খাদেম

নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে আল নুর ও লিনউড মসজিদে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলায় এখন পর্যন্ত মারা গেছেন ৪৯ জন। হামলায় আল নূর মসজিদে হতাহতের সংখ্যাই বেশি। তবে লিনউড মসজিদে হামলা শুরুর পর মসজিদের খাদেম যদি হামলাকারীর কাছ থেকে অস্ত্র না কেড়ে নিতো তবে হতাহতের সংখ্যা আরো কয়েক গুণ বেড়ে যেত।
নিউজিল্যান্ড হেরাল্ড অনলাইনে লিনউড মসজিদ থেকে বেঁচে ফেরা একজন প্রত্যক্ষদর্শীর বরাত দিয়ে এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শী এই ব্যক্তির নাম সৈয়দ মাজহারউদ্দিন।
সৈয়দ মাজহারউদ্দিন নিউজিল্যান্ড হেরাল্ডকে বলেন, মসজিদে ওই সময় ৬০ থেকে ৭০ জন ছিলেন। গুলি শুরু হলে আতঙ্কে তারা সবাই ছুটোছুটি শুরু করেন। ওই সময় তিনি দেখেন এক লোক অস্ত্র নিয়ে মসজিদের দরজা দিয়ে ঢুকেই দরজার কাছে থাকা কয়েকজন বয়স্ক ব্যক্তিকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়া করেছে।
সবাই যখন জীবন বাচাতে ছুটোছুটি করছে তখন মসজিদের খাদেম রুখে দাঁড়ান।

ঝাঁপিয়ে পড়েন ওই হামলাকারীর ওপর এবং বন্দুকটা কেড়ে নেন। তিনি হামলাকারীকেও ধরার চেষ্টা করেন। কিন্তু হামলাকারী পালিয়ে যায়। পরে তাকে নিউজিল্যান্ড পুলিশ তাকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়।

স্বামীকে বাঁচাতে গিয়ে প্রাণ গেল সিলেটের হোসনে আরার

গুলির শব্দ শুনেই অসুস্থ স্বামীর কাছে দৌড় দেন হোসনে আরা পারভীন। কিন্তু স্বামী বাঁচলেন ঠিকই। ঘাতকের বুলেট প্রাণ কেড়ে নিলো হোসনে আরা পারভীনের। ঘটনার খবর বাংলাদেশে পৌঁছার পর থেকে কান্নার রোল পড়েছে সিলেটে। নিহত হোসনে আরার বিশ্বনাথ ও গোলাপগঞ্জের স্বজনরা কাঁদছেন। হোসনে আরা পারভীনের বয়স প্রায় ৪০ বছর। স্বামী ফরিদ উদ্দিন আহমদকে নিয়ে তিনি বসবাস করেন নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চ এলাকায়। গতকাল যখন মসজিদে সন্ত্রাসী হামলা হয় তখন মহিলাদের মসজিদে অবস্থান করছিলেন হোসনে আরা পারভীন।

আর তার স্বামী ফরিদ উদ্দিন আহমদ ছিলেন পুরুষদের মসজিদে। মসজিদের ভেতরে হঠাৎ গুলির শব্দ শুনতে পান হোসনে আরা।

এমন সময় তিনি অসুস্থ স্বামীর কাছে দৌড় দেন। কিন্তু কিছু দূর যাওয়ার পরপরই ঘাতকের বুলেট তাকে বিদ্ধ করে। এতে ঘটনাস্থলেই মারা যান হোসনে আরা পারভীন। তবে, প্রাণে বেঁচে যান স্বামী ফরিদ উদ্দিন আহমদ। এ ঘটনার খবর গতকাল সকাল ১০টার দিকে নিউজিল্যান্ডে থাকা স্বজনদের মাধ্যমে দেশে থাকা স্বজনরা জানতে পান। খবর পেয়ে কান্নার রোল পড়েছে বিশ্বনাথ ও গোলাপগঞ্জে। স্বজনরা জানিয়েছেন, হোসনে আরা পারভীনের স্বামী ফরিদ উদ্দিন আহমদের বাড়ি বিশ্বনাথ উপজেলার মীরের চক গ্রামে। আর হোসনে আরা পারভীনের বাড়ি গোলাপগঞ্জ উপজেলার জাঙ্গালহাটা গ্রামে। ১৯৯৪ সালে বিয়ে হয় ফরিদ ও হোসনে আরার। বিয়ের কয়েক বছর পর তারা নিউজিল্যান্ড চলে যান। তাদের একটি কন্যা সন্তান রয়েছে। ২০০৯ সালের দিকে স্বামী ও সন্তানকে নিয়ে বাড়িতে বেড়াতে এসেছিলেন হোসনে আরা পারভীন। তখন তিনি স্বামীর বাড়ির পাশাপাশি পিতার বাড়িতেও বসবাস করেন।


গোলাপগঞ্জের জাঙ্গালহাটা বাড়িতে তার ভাই নাজিম উদ্দিন বসবাস করেন। তিনিও অসুস্থ। স্বজনরা জানান, ক্রাইস্টচার্চে হামলার ঘটনার পরপরই স্বজনরা এসে মসজিদ থেকে ফরিদ উদ্দিন আহমদকে নিয়ে যান। তাকে বাসায় রাখা হয়। এরপরও ঘটনার বিবরণ জানতে নিউজিল্যান্ড পুলিশ তার সঙ্গে কথা বলেছে। তবে, গতকাল বিকাল পর্যন্ত হোসনে আরা পারভীনের মরদেহ পুলিশের কাছে ছিল। এখনো লাশ নিউজিল্যান্ড থাকা স্বজনদের কাছে বুঝিয়ে দেয়া হয়নি। ঘটনার বিবরণ দিয়ে দেশে থাকা হোসনে আরার স্বজনরা জানিয়েছেন, ক্রাইস্টচার্চ এলাকায় একটি মসজিদে দুটি আলাদা ইউনিট রয়েছে। এর মধ্যে এক ইউনিটে পুরুষ ও অন্য ইউনিটে মহিলারা নামাজ আদায় করেন। নামাজের প্রায় আধা ঘণ্টা আগে হোসনে আরা স্বামী ফরিদ উদ্দিনকে হুইল চেয়ারে করে নিয়ে যান মসজিদে।

সেখানে পুরুষ ইউনিটে স্বামীকে রেখে তিনি নামাজ পড়তে মহিলা ইউনিটে চলে যান। প্রায় ১৫ মিনিট পর পুরুষদের মসজিদের ভেতরে গুলির শব্দ শুনে পারভীন তার স্বামীকে বাঁচানোর জন্য বের হন। এ সময় অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী তাকে গুলি করলে তিনি ঘটনাস্থলে মারা যান। নিউজিল্যান্ডে ক্রাইস্টচার্চে নিহত হওয়া হোসনে আরা পারভীনের ভাগ্নে মাহফুজ চৌধুরী গতকাল বিকালে মানবজমিনকে জানিয়েছেন, মসজিদের বাইরে গুলির শব্দ শোনার সঙ্গে সঙ্গে কয়েকজন মুসল্লি হুইল চেয়ারে করে ফরিদ উদ্দিনকে মসজিদ থেকে বের করে নেন। এতে ফরিদ উদ্দিন আহমদ প্রাণে রক্ষা পান। কিন্তু পেছনে স্বামীর দিকে দৌড়ে যাওয়া পারভীনের উপর এসে বুলেট লাগে। এতে ঘটনাস্থলেই মারা যান পারভীন বেগম। নিউজিল্যান্ডে বসবাস করেন নিহত হোসনে আরা পারভীনের ভাবি হিমা বেগমসহ কয়েকজন স্বজন। তারা ফোন করে দেশে মৃত্যুর খবরটি নিশ্চিত করেন। মাহফুজ জানান, ঘটনার পর থেকে তার মামা ও তাদের পরিবারে কান্নার রোল পড়েছে।

ঘটনা শুনে তিনিও বাড়িতে পৌঁছেছেন। বোনের মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে তার মাও শোকে কাতর। ফরিদ উদ্দিন আহমদের বিশ্বনাথের বাড়ি উত্তর মীরের চক গ্রামে বসবাস করেন ভাই মইন উদ্দিন। তিনি সন্ধ্যায় মানবজমিনকে জানিয়েছেন, গতকাল জুমার পর ফরিদ উদ্দিনের সঙ্গে তার মোবাইল ফোনে কথা হয়েছে। ওই সময় ফরিদ উদ্দিন তাকে জানিয়েছেন, তার স্ত্রী হোসনে আরা পারভীন নিহত হয়েছেন। ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে মুসল্লিরা তাকে মসজিদ থেকে বের করে নেয়ায় তিনি বেঁচে যান। মইনউদ্দিন জানান, ফরিদ ও হোসনে আরার পরিবারের তাদের এক কন্যা সন্তান রয়েছে। ওই মেয়ের নাম শিপা বেগম। সে বর্তমানে পিতার কাছেই আছে। এক সময় ভিজিট ভিসায় নিউজিল্যান্ড যান ফরিদ উদ্দিন। পরে দেশে এসে বিয়ে করে নিজের স্ত্রীকে নিয়ে যান। দেশে বেড়াতে এলে বিশ্বনাথেই থাকতেন বলে জানান তিনি।

‘নিউজিল্যান্ডের অন্ধকারতম দিন’

নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চের আল নুর মসজিদে সন্ত্রাসী হামলা বিশ্বের সংবাদমাধ্যমে প্রধান আলোচিত খবর ছিল। বিশ্বের শীর্ষ সংবাদমাধ্যমগুলোর প্রতিটিই তাদের অনলাইনে হামলার ঘটনাপ্রবাহের প্রতি মুহূর্তের হালনাগাদ জানিয়েছে। টেলিভিশন ও বেতার চ্যানেলগুলো সংবাদ প্রচার করেছে সারাক্ষণ। বিশ্বের প্রথম সারির অনেক সংবাদমাধ্যম এই ঘটনার প্রভাব নিয়ে তাৎক্ষণিক মতামত ও বিশ্লেষণ প্রকাশ করেছে। তবে হামলার ভিডিও ও হামলাকারীর মৌলবাদী ও বর্ণবিদ্বেষী ইশতেহার প্রচার করে জনমনে ভীতি ছড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগে নিউজিল্যান্ডসহ অনেক দেশের শীর্ষ গণমাধ্যমের সমালোচনাও হয়েছে বিস্তর।

বিবিসি, হাফিংটন পোস্ট, দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল, দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট, ভারতের এনডিটিভি, হিন্দুস্তান টাইমস, টাইমস অব ইন্ডিয়ার শীর্ষ খবর ছিল ক্রাইস্টচার্চ হামলা। হামলাকে ‘নিউজিল্যান্ডের ইতিহাসে কালোতম দিন’ বলেছে তাদের অনেকেই। বার্তা সংস্থা এপিসহ অনেক সংবাদমাধ্যমে হামলায় বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের বেঁচে যাওয়ার প্রসঙ্গটি গুরুত্বসহকারে এসেছে।

বার্তা সংস্থা এএফপি ফেসবুকে হামলার সরাসরি সম্প্রচারিত ভিডিওটি আসল বলে শনাক্ত করেছে। ভিডিওটি যে মিথ্যা নয়, এটি নির্ণয় ডিজিটাল ভেরিফিকেশন পদ্ধতি ব্যবহার করেছে বার্তা সংস্থাটি। হামলাকারী অস্ট্রেলীয় নাগরিক (২৮) হামলার আগে গতকাল সকালে তাঁর টুইটারে ‘দ্য গ্রেট রিপ্লেসমেন্ট’ শিরোনামের ৭৪ পাতার একটি ইশতেহারের লিংক পোস্ট করেন। ওই ইশতেহার বিশ্লেষণ করে এএফপি জানিয়েছে, বন্দুকধারীর লক্ষ্য শুরু থেকেই মুসলিমরাই ছিল। একই নামে ফ্রান্সে উদ্ভাবিত একটি ষড়যন্ত্রতত্ত্বের প্রসঙ্গ মনে করিয়ে দিয়েছে এএফপি। ওই তত্ত্বে প্রচার করা হয়েছিল, ইউরোপে অভিবাসীদের উচ্চ জন্মহারের কারণে সাদারা নিজ দেশ থেকে বাস্তুচ্যুত হচ্ছে।
বার্তা সংস্থা রয়টার্সে হামলার খবর ও ছবি প্রকাশ করে শিরোনাম দেওয়া হয়েছে, ‘নিউজিল্যান্ডের অন্ধকারতম দিন।’
যুক্তরাজ্যের ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের বিশ্লেষক অন্বিতা বসু সন্ত্রাস ছড়ানোয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ভূমিকার দিকে আলোকপাত করেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বৈশ্বিক নিরাপত্তা উদ্বেগ নিশ্চিতভাবেই বাড়িয়েছে।’ যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকা চার্লি ওয়াজেলের একটি তাৎক্ষণিক মতামত নিবন্ধ প্রকাশ করেছে। শিরোনাম ‘আ নিউ এজ অব ভাইরাল টেরর’। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সন্ত্রাসবাদ কীভাবে ইন্ধন পাচ্ছে, ক্রাইস্টচার্চের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ওয়াজেল বিশ্লেষণ করেছেন সেটি।
যুক্তরাজ্যের ‘দ্য গার্ডিয়ান’ পত্রিকা যুক্তরাজ্য, নিউজিল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার শীর্ষ সংবাদমাধ্যমগুলোর খবর বিশ্লেষণ করেছে। নিউজিল্যান্ডের সরকারের অনুরোধে ইউটিউব, ফেসবুক ও টুইটার ক্রাইস্টচার্চ হামলার ভিডিও অনলাইন থেকে সরিয়ে ফেলতে যেখানে জোর প্রচেষ্টা চালিয়েছে, সেখানে যুক্তরাজ্যের মূলধারার গণমাধ্যম মেইল অনলাইন, দ্য সান ও দ্য মিরর হামলার সম্পাদনাকৃত ভিডিও তাদের ওয়েবসাইটে প্রচার করেছে। অস্ট্রেলিয়ার স্কাই নিউজ, টেন ডেইলি, নিউজ ডট কম ডট, চ্যানেল নাইন, দ্য হেরাল্ড-সান ভিডিওর কর্তিত অংশ তাদের ওয়েবসাইট ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের পেজে প্রচার করেছে। এবিসি নিউজ ইশতেহারের অংশবিশেষ প্রচার করেছে।
সিএনএনকে কলাম লেখক মেহেদি হাসান বলেছেন, ‘প্রত্যেক মুসলিমের জন্য এই হামলা ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন হয়ে থাকবে।’ পাকিস্তানের ডন পত্রিকা এএফপির তথ্য দিয়ে লিখেছে, ‘ইসলামভীতি ও বর্ণবাদী ঘৃণার বিপদ এ ধরনের হামলা।’

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here