মাঠের রাজনীতিতে আ. লীগের অভ্যন্তরে দ্বন্দ্ব

0
61

মাঠে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ শক্ত না হওয়ায় দেশের অধিকাংশ স্থানেই আওয়ামী লীগের মুখোমুখি এখন আওয়ামী লীগই। প্রায় প্রতিটি সাংগঠনিক জেলা শহরেই দলের মধ্যে অভ্যন্তরীণ কোন্দল-দ্বন্দ্ব অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি। সর্বশেষ অনুষ্ঠিত উপজেলা নির্বাচনে দলের মধ্যে চরম বিভেদ স্পষ্ট হয়েছে। তৃণমূল আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যারা নিবেদিতপ্রাণ বলে পরিচিত, দলের দুর্দিনে যারা ত্যাগের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন, তৃণমূলের সেই ত্যাগী অনেক নেতার এখন দুর্দিন চলছে।

উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে নৌকার পক্ষে কাজ করে হামলা-মামলার ভয়ে ঘর ও নিজের এলাকা ছাড়া আওয়ামী লীগের অনেক ত্যাগী নেতাকর্মী। নৌকার পক্ষে কাজ করার জন্য মন্ত্রী-এমপি ও প্রভাবশালী নেতাদের দ্বারা নির্যাতন-হয়রানির শিকার হওয়া সংক্রান্ত দুই হাজারেরও বেশি অভিযোগ ইতোমধ্যে কেন্দ্রে জমা পড়েছে।

জানা গেছে, এবারের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়ার ক্ষেত্রে তৃণমূলের পছন্দের প্রার্থীকে অগ্রাধিকার দেয় আওয়ামী লীগ; কিন্তু যেসব এলাকায় কেন্দ্র মনোনীত প্রার্থী স্থানীয় এমপি-মন্ত্রীদের পছন্দ হয়নি, সেসব এলাকায় নিজের পছন্দের ব্যক্তিকে স্বতন্ত্র হিসাবে দাঁড় করান তারা। আর যেসব নেতাকর্মী এমপি পছন্দের প্রার্থীর বিপক্ষে অর্থাত্ নৌকার পক্ষে কাজ করেছেন তাদের অনেকে এখন মন্ত্রী-এমপিদের রোষানলে পড়ে নিজের এলাকা ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।

আওয়ামী লীগের সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বরাবরে তৃণমূল নেতাদের লেখা ২ হাজারেরও বেশি চিঠি দেখেছেন এমন কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা জানান, অধিকাংশ চিঠিতেই মন্ত্রী-এমপি ও প্রভাবশালী নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়েছে। নড়াইল জেলার লোহাগড়া উপজেলায় নৌকার মনোনয়ন পান মো. রাশিদুল বাশার ডলার।

আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বরাবর পাঠানো চিঠিতে ডলার লিখেছেন, ‘আমার নির্বাচনী এলাকায় উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক দুই জনই আপনার দেওয়া নৌকা প্রতীকের বিরুদ্ধে নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে অংশগ্রহণ করেন। এর ফলে নৌকার বিপর্যয় ঘটে। আমাকে আমার নিজ এলাকায় ভোটারদের ভোট প্রদানে চরম সমস্যার সৃষ্টি করে। জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে বারবার বিষয়টি অবহিত করার পরও তারা নৌকার পক্ষে কাজ করেননি। একটি বারও তারা লোহাগড়ায় আসেননি।

এছাড়া আমার এলাকার স্থানীয় এমপির শ্বশুর বাড়ির এলাকার ভোট কেন্দ্রে স্বতন্ত্র প্রার্থী ভোট পান ১১৩০ এবং নৌকার প্রার্থীর পক্ষে ভোট পড়ে মাত্র ১০টি। অথচ এই কেন্দ্রে গত ৩০ ডিসেম্বর জাতীয় নির্বাচনে নৌকা ৯৩ ভাগ ভোট পেয়েছিল।’

স্থানীয় এক এমপির প্রভাবে কেশবপুর উপজেলায় নৌকার পরাজয় হয় এমন অভিযোগ কেন্দ্রে জমা পড়েছে। ওই এমপির হস্তক্ষেপে উপজেলা নির্বাহী অফিসারও (ইউএনও) স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে মাঠে নেমেছিলেন। তৃণমূলের একজন অনুগত নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে ‘জানান, সারাজীবন দল করেছি। বিএনপি-জামায়াতের আমলে হামলা-মামলার শিকার হয়েছি; কিন্তু বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতায় থাকার পর এভাবে পালিয়ে বেড়াতে হবে, তা কল্পনাও করিনি। নৌকার পক্ষে কাজ করায় স্থানীয় এমপির রোষানলে পড়ে এখন পালিয়ে বেড়াচ্ছি’।

একই অবস্থা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এমপিদের বিরুদ্ধে গিয়ে নৌকার পক্ষে সক্রিয়ভাবে কাজ করা অনেক নেতাকর্মীর। আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকার পরও নৌকার পক্ষে কাজ করার অপরাধে পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে তাদের। সূত্র জানায়, উপজেলা পরিষদ নির্বাচন নিয়ে তৃণমূল থেকে দুই হাজারেরও বেশি অভিযোগ ধানমন্ডিস্থ আওয়ামী লীগের সভানেত্রীর রাজনৈতিক কার্যালয়ে জমা পড়েছে।

অভিযোগে অনেক মন্ত্রী, এমপি ও প্রভাবশালী নেতার নাম রয়েছে। এগুলোর বিভাগওয়ারি সংক্ষিপ্ত তালিকা তৈরি করা হয়েছে। এসব তালিকা ধরে দায়িত্বশীলরা তদন্ত করছেন। জানা গেছে, তৃণমূলের অভিযোগে এমন কিছু প্রভাবশালী নেতা ও মন্ত্রীর নাম এসেছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দলীয় প্রধানের হস্তক্ষেপ লাগবে। দলটির স্থানীয় নেতাকর্মীদের অভিযোগ, ইসির নোটিসের বাইরেও অনেক মন্ত্রী ও এমপি নির্বাচনে অনৈতিক প্রভাব বিস্তার করেছেন। গাজীপুরে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীর পক্ষে মিছিলে অংশ নিয়ে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেন একজন মন্ত্রী।

এ পর্যন্ত চার ধাপে ৪৪৪টির মধ্যে ১৩৬টি উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে বিজয়ী হন আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী বা স্বতন্ত্র প্রার্থী। দলীয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিদ্রোহীদের পক্ষাবলম্বনকারী মন্ত্রী-এমপিদের দলীয় শৃঙ্খলাভঙ্গের অপরাধের বিষয়টি অধিকতর তদন্ত করা হচ্ছে। অপরাধ প্রমাণিত হলে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণের অংশ হিসেবে প্রথমে তাদের কাছে কারণ দর্শানো নোটিস পাঠানো হবে। আর যেসব এমপি-মন্ত্রী নৌকার বিরোধিতা করেছেন তাদের তালিকা করতে প্রধানমন্ত্রী সাংগঠনিক সম্পাদকদের নির্দেশ দিয়েছেন।

জানা গেছে, নৌকা নিয়ে এমপি নির্বাচিত হওয়ার চার মাসের মাথায় নৌকার বিরুদ্ধেই প্রকাশ্যে কাজ করার বিষয়টি ভালোভাবে দেখছে না কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ। এ নিয়ে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত দলের প্রেসিডিয়াম, সম্পাদকমণ্ডলী, কার্যনির্বাহী সংসদ এবং সর্বশেষ কার্যনির্বাহী সংসদ-উপদেষ্টামণ্ডলীর যৌথসভায় বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে।

নীতিনির্ধারণী ফোরামের সিদ্ধান্তের আলোকে নৌকার বিরুদ্ধে অবস্থানকারী নেতাদের চিহ্নিত করতে কাজ করছেন দলের নেতারা। দলীয় ফোরামে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা একাধিকবার বলেছেন, ‘তৃণমূলের নেতা-কর্মীরাই আওয়ামী লীগের প্রাণ। তারাই সংগঠনকে ধরে রেখেছেন। তাই তাদের মূল্যায়ন করতে হবে। তৃণমূলের ত্যাগী নেতাদের ওপর নির্যাতন সহ্য করা হবে না।’

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ বলেন, তৃণমূল থেকে আসা অভিযোগ খতিয়ে দেখা হচ্ছে। যার বিরুদ্ধে নৌকার বিপক্ষে কাজ করার অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যাবে তাকেই শোকজ করা হবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here