প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলন : অনেক উত্তেজনার প্রশমন

0
73

চীন সফর শেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ৮ জুলাই যথারীতি এক সংবাদ সম্মেলন গণভবনে আয়োজন করেন। প্রধানমন্ত্রী পদে দায়িত্বপালনকালে শেখ হাসিনা বিদেশ সফর শেষে এমন সাংবাদিক সম্মেলন সব সময় করে আসছেন, তাতে বিদেশ সফরের অভিজ্ঞতা ছাড়াও দেশে নানা রাজনৈতিক ও জনআকাক্সিক্ষত বিষয়ে সাংবাদিকদের নানা প্রশ্নের তিনি উত্তর দিয়ে থাকেন। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এসব সংবাদ সম্মেলন শুধু সাংবাদিকদেরই আকর্ষণ করেন না, দেশবাসীরও যথেষ্ট আগ্রহের বিষয় হয়ে আছে। তাছাড়া প্রতিটি সাংবাদিক সম্মেলনে যেভাবে তিনি নানা প্রশ্নের উত্তর দিয়ে থাকেন, যে ধরনের প্রস্তুতি থাকে তা বেশ উল্লেখ করার মতো। তিনি প্রায় প্রতিটি সাংবাদিক সম্মেলনে সরকারি নানা তত্ত-উপাত্ত টেবিলে রেখে দেন, প্রয়োজনে সেগুলোর তিনি সদ্বব্যবহার করেন। গত সভাতেও তিনি তা খুব চমৎকারভাবে পড়েছেন, যার ফলে উপস্থিত সাংবাদিকরা তো বটেই, টিভি দশকরাও প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তুতি এবং তত্ত উপস্থাপনা দেখে মুগ্ধ হয়েছেন। বিশেষত এই সময়ে দেশে এলএমজি গ্যাস এর মূল্য বৃদ্ধি নিয়ে বিরোধী মহল বেশ উত্তেজনা মনে হয় তৈরি করতে যাচ্ছিলো। আমাদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বাম দলগুলোর ‘বড়’ ‘বড়’ নেতারা গণমাধ্যমে সেই উত্তেজনা ছড়িয়ে দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন।

গত রবিবার তারা দেশব্যাপী আধাবেলা হরতাল ডাকলেও সেটি তারা পালন করেছেন জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে, শাহ্বাগ চত্ত¡র এবং অন্য দু’একটি শহরের দু’একটি রাস্তার মোড়ে। সেখানে তারা খুব গলা ফাটিয়ে দাবী করেছিলেন যে, ভারতে যখন গ্যাসের দাম কমছে তখন বাংলাদেশে শেখ হাসিনার সরকার গ্যাসের দাম অসহনীয়ভাবে বৃদ্ধি করে ব্যাপক অর্থ লুটপাঠের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। তারা এ বিষয়ে নানা ধরনের পরিসংখ্যানও দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। তাদের এই আন্দোলনকে বিএনপি ‘নৈতিকভাবে’ সমর্থন দিলেও রাস্তায় নামেনি। কেন বিএনপির মতো এতো বড় দল এতোজন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কোন আন্দোলনের কর্মসূচি নিজেরা না দিয়ে ছোট ছোট বাম দলদের ডাকা হরতালকে সমর্থন জানালো এবং বামদের ভাষাতেই সরকারকে গণমাধ্যমে তুলুধনাই করল? বিএনপি তো নিজেরই পারতো এ বিষয়ে দেশবাসীকে সরকারের বিরুদ্ধে মাঠে নামাতে। কিন্তু বিএনপি কেন করেনি সেটি তো বুঝা গেল সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশ হয়ে ভারতে গ্যাস নেওয়ার একটি সুযোগকে বিএনপি কাজে না লাগিয়ে তখন বাংলাদেশের ভূমি ভারতকে ব্যবহার করতে না দেওয়ার বাহবা নিয়ে কিছু মানুষের হাততালি লাভ করলেও সেই সময়ে মিয়ানমার থেকে এই গ্যাস ভারতে নেওয়ার চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশও মিয়ানমার থেকে দীর্ঘদিনের মতো গ্যাস কমমূল্যে ক্রয় করার সুযোগ পেত, অধিকন্তু ভারতকে গ্যাস পাইপ লাইন দেওয়ার বিনিময়ে বিপুল অর্থও লাভ করত। কিন্তু তখন বিএনপি বিষয়টি নিয়ে ভারত বিরোধিতার রাজনীতি করেছিল। এর ফলে মিয়ানমার থেকে কম মূল্যে গ্যাস পাওয়ার বাংলাদেশের সম্ভাবনা চিরকালের জন্য রুদ্ধ হয়ে গেল। সে কারণেই এখন বাংলাদেশকে বিদেশ থেকে বেশি মূল্যের এলএমজি গ্যাস এনে দেশের চাহিদা পূরণ করতে হচ্ছে। এর কোন বিকল্প বাংলাদেশের সম্মুখেতো এখন নেই।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেদিনের সেই সাংবাদিক সম্মেলনে স্পষ্ট বলে দিয়েছিলেন ‘আমি তখন প্রধানমন্ত্রী থাকলে ভারতকে পাইপ লাইন দেওয়ার পাশাপাশি মিয়ানমার থেকে গ্যাস আনার ব্যবস্থাও করে নিতাম’। প্রধানমন্ত্রীর মুখে এই বক্তবটি মনে হয় দেশবাসী শুনেছে এবং গ্যাস এলএমজি মূল্য বৃদ্ধির যুক্তিকতা উত্তর পেয়েছে। ফলে এলএমজির মূল্য বৃদ্ধি নিয়ে বাম এবং ডানদের যে উত্তেজনা তৈরির সম্ভাবনার দেখা হয়েছিল সেটি বোধ হয় মাঠে মারা গেল।

আরেকটি বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি সকলেরই নানা অজানা তথ্যের উত্তর দিয়েছেন। মূলত সরকারি চাকুরিতে প্রবেশের বয়স ৩৫ বছর করার বিষয়টি নিয়ে একটি মহল বেশ প্রস্তুতি নিচ্ছিল। তারা গত নির্বাচনের আগেও এ নিয়ে দাবি তুলেছিল যে তাদের বিসিএস পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ ৩৫ বছর পর্যন্ত করা। বিএনপি তো তখন প্রতিশ্রতি দিয়েছিল যে ক্ষমতায় গেলে তারা চাকরিতে প্রবেশের কোনো বয়সসীমা রাখবে না। এখন অনেকেই আশা করেছিল যে বিষয়টি নিয়ে আবার মাঠে নামা যাবে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পাবলিক সার্ভিস কমিশন থেকে সংগৃহিত তথ্য ও উপাত্তের ভিত্তিতে ৩ বছরের বিসিএস পরীক্ষার যে ফলাফল তুলে ধরেছেন তাতে দেখা যায় ২৯ বছরের পর যারা পরীক্ষা দেন তাদের উত্তীর্ণের হার এতটাই কম যে তাদের জন্য বিশেষ কোন ব্যবস্থা রাখার আর যৌক্তিকতা থাকে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ দুটো বিষয়ে যেসব তথ্য-উপাত্ত ও সরকারি পরিসংখ্যান ব্যবহার করে সাংবাদিকদের মাধ্যমে দেশবাসীকে জানার সুযোগ করে দিয়েছেন তার ফলে সম্ভবত আন্দোলনকারীদের নতুন করে আর কিছু করার প্রয়োজনীয়তা পড়ছে না। বিশেষ করে বাম রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা যে অনেক ক্ষেত্রেই তত্ত উপাত্ত সঠিকভাবে সংগ্রহ না করে কথা বলেন, মানুষকে উত্তেজিত করার চেষ্টা করেন- সেটি বোধহয় এবার অনেকটাই স্পষ্ট হয়ে গেছে। আমার ধারণা তাদের এসব নিয়ে নিকট ভবিষ্যতে আন্দোলনের সুযোগও বোধহয় শেষ হয়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা এখন সরকার পরিচালনায় কতটা তত্ত-উপাত্ত ও পরিসংখ্যানে সমৃদ্ধ থাকেন- সেটি বোধহয় অনেকেই এখন বুঝতে পারছেন।

এতে কারো কারো মধ্যে তাঁর সম্পর্কে পরশ্রীকাতরতা থাকতে পারে, কিন্তু আমরা খুবই ভারমুক্ত হচ্ছি যে আমাদের দেশে সরকার প্রধান হিসেবে যিনি এখন দায়িত্বে আছেন তিনি আসলে আমাদের দেশকে তার সর্বোচ্চ মেধা দিয়ে নেতৃত্ব দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে নিয়ে আমাদের অনেক হতাশা, ক্ষোভ এবং অভিযোগ আছে। কিন্তু শেখ হাসিনাকে নিয়ে বোধহয় আমাদের গর্ব করা ছাড়াও দেশকে এগিয়ে নেওয়ার যথেষ্ট বাস্তবতা তিনি দেখাতে পারছেন। আমরা তাতে অনেকটাই আপাতত ভারমুক্ত। তবে দেশে যারা গণতন্ত্র নিয়ে মায়াকান্না করেন তাদের উচিত হবে দেশকে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো ভিশনারী-মিশনারী গুনাবলী অর্জন করা- যা একসময় দেখিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু এখন গত কয়েক বছর ধরে দেখাচ্ছেন শেখ হাসিনা।

লেখক : শিক্ষাবিদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here