উন্নয়নের মহাসড়কে প্রবাসীদের সম্পৃক্ততা

0
583

বাংলা খবর ডেস্ক: স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম বাজেটের আকার ছিল ৭৮৬ কোটি টাকা। আর ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাজেটের আকার দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকায়।

প্রথম বাজেটে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি-এডিপির আকার ৫০০ কোটি টাকা ধরা হলেও বর্তমানে তা ২ লাখ কোটি টাকার ওপরে। অর্থনীতির এই যে ফুলে-ফেঁপে ওঠা, তার পেছনে রয়েছে তৈরি পোশাকশিল্প, কৃষি ক্ষেত্রে বিপ্লব আর প্রবাসী আয়।

জাতীয় অর্থনীতিতে রফতানি খাতের অবদান তথা মূল্য সংযোজনের হার তুলনামূলকভাবে কম। কারণ পণ্য রফতানি বাবদ যে অর্থ উপার্জিত হয়, তার একটি বড় অংশই কাঁচামাল আমদানিতে চলে যায়। কিন্তু জনশক্তি রফতানি খাত এমনই এক অর্থনৈতিক খাত, যার উপার্জিত বৈদেশিক মুদ্রার পুরোটাই জাতীয় অর্থনীতিতে মূল্য সংযোজন করে।

একই সঙ্গে বেকার সমস্যা নিরসনেও এর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। তাছাড়া জনশক্তি রফতানির ফলে বিরাট সংখ্যক জনগণের দৈনন্দিন চাহিদা ও খাদ্যসামগ্রীও স্থানীয়ভাবে জোগাড় করতে হচ্ছে না। সারা বিশ্বের দেড় শতাধিক দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে প্রায় সোয়া কোটি বাংলাদেশি; যারা সার্বিকভাবে আমাদের অর্থনীতিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখছেন।

এদিকে এবার প্রবাসী আয়ে রেকর্ড গড়ল বাংলাদেশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে প্রবাসীরা যে পরিমাণ অর্থ পাঠিয়েছেন, দেশের ইতিহাসে এক অর্থবছরে এত পরিমাণ প্রবাসী আয় আগে কখনও আসেনি। গত জুন মাসে প্রবাসীরা ১৩৬ কোটি ৮০ লাখ ডলার পাঠায়।

ফলে গত অর্থবছরে প্রবাসী আয় বেড়ে ১ হাজার ৬৪২ কোটি ডলার হয়েছে। বিপুল পরিমাণ প্রবাসী আয় আসায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়ে হয়েছে ৩ হাজার ২৫৭ কোটি ডলার, যা বিএনপির গত শাসনামলে ছিল গড়ে ৩ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি। তুলনা করলে দেখা যায়, সে সময়ের চেয়ে বর্তমানে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়েছে ১০ গুণের বেশি।

সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, যুক্তরাষ্ট্র ও কুয়েত থেকে দেশের মোট রেমিটেন্সের ৫৫ শতাংশ এসেছে। এ সময়ে বরাবরের মতো সৌদি আরব থেকে সবচেয়ে বেশি ২৫৯ কোটি ১৫ লাখ ডলার এসেছে, যা মোট রেমিটেন্সের ১৭ দশমিক ৩০ শতাংশ। সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে এসেছে ২৪৩ কোটি ডলার। যুক্তরাষ্ট্র থেকে রেমিটেন্স এসেছে ২০০ কোটি ডলার। এ তিন দেশ থেকেই মোট রেমিটেন্সের ৪৬ দশমিক ৮৪ শতাংশ এসেছে।

দেশের অর্থনীতিতে রেমিটেন্সের গুরুত্ব অনুধাবন করে তা বাড়াতে সরকারি উদ্যোগ অব্যাহত রয়েছে। প্রবাসী আয় প্রেরণে ব্যয় হ্রাস, বিদেশে কর্মরত ব্যাংকের শাখা ও এক্সচেঞ্জ হাউসগুলোকে রেমিটেন্স প্রেরণে দক্ষ করে তোলা, প্রবাসীরা যেসব দেশে কর্মরত সেসব দেশের স্থানীয় ব্যাংকগুলোর সঙ্গে এ দেশের ব্যাংক/আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ড্রয়িং ব্যবস্থা জোরদারকরণ এবং প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের মাধ্যমে রেমিটেন্স প্রেরণে উদ্বুদ্ধকরণ।

এ বছরের বাজেটে রেমিটেন্স পাঠালে অতিরিক্ত ২ শতাংশ প্রণোদনা দেয়ার ঘোষণাও এসেছে সরকারের পক্ষ থেকে। জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া থেকে আসা রেমিটেন্স প্রবাহ আরও সহজ করতে আগ্রহী বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে দু’দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে লেনদেন সহজীকরণের ব্যাপারে অনুমোদন দিচ্ছে।

মোবাইল ফোনে হুন্ডি প্রতিরোধে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কড়াকড়ি, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি ও ডলারের বিপরীতে বেশি টাকা পাওয়ায় ব্যাংকিং চ্যানেলে বেড়েছে রেমিটেন্স। অবৈধপথে অভিবাসী শ্রমিকদের টাকা পাঠানো বন্ধে বিকাশ অথবা রকেটের অবৈধ কার্যক্রম বন্ধের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক নানা ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।

প্রবাসী আয় বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিদেশে জনশক্তি রফতানির জন্য নতুন নতুন শ্রমবাজার খুঁজছে সরকার। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ‘অর্থনৈতিক ডিপ্লোমেসি’ এ উদ্যোগের নতুন এক দিক। নতুন শ্রমবাজারের জন্য ৭৭ দেশে সম্ভাব্যতা যাচাই করছে সরকার।

বর্তমানে বাংলাদেশি শ্রমিক আছে, এমন ৩০টি দেশে আরও শ্রমিকের চাহিদা আছে কিনা; তা যাচাই করছে। আর বাকি ২৭টি হবে সম্পূর্ণ নতুন। বিশেষ করে অস্ট্রেলিয়া, রাশিয়া, থাইল্যান্ড ও মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নতুন নতুন শ্রমবাজারে বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি রফতানি করার জন্য সরকার ব্যাপক উদ্যোগ হাতে নিয়েছে।

সৌদি আরব, মালয়েশিয়া ও কাতারে যাতে বিনা খরচে বাংলাদেশের কর্মীরা যেতে পারেন, তারও উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। নতুন নতুন শ্রমবাজার সৃষ্টি পাশাপাশি দীর্ঘসময়ের পুরনো বাজারগুলো আরও চাঙ্গা করতে সক্ষম হয়েছে সরকার।

যেসব দেশে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বাংলাদেশের কর্মী রয়েছে, তাদের সেবা এবং কল্যাণ নিশ্চিতকল্পে ‘শ্রম উইং’ খোলার পরিকল্পনা করছে সরকার। বর্তমানে বিভিন্ন দেশে ২৯টি ‘শ্রম উইং’ কাজ করছে। আরও কয়েকটি দেশে ‘শ্রম উইং’ খোলা হবে। প্রবাসে বাংলাদেশের বেশিসংখ্যক কর্মক্ষম লোক যাতে কাজ করতে পারে এবং প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আসে, সে চেষ্টাই করছে সরকার। দেশে প্রতিবছর ২০ লাখেরও বেশি পুরুষ ও মহিলাকর্মী শ্রমবাজারে যুক্ত হচ্ছে।

প্রবাসে যাওয়ার ক্ষেত্রে জনসাধারণের প্রবণতা খানিকটা পরিবর্তন হয়েছে। অনেকেই কারিগরি শিক্ষা, ভাষা, কম্পিউটার ও ড্রাইভিং ইত্যাদির ওপর প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশ ছাড়ছেন। প্রবাসীদের মধ্যে চিকিৎসক, প্রকৌশলী, শিক্ষক এবং বৃত্তিমূলক শিক্ষায় ডিগ্রিধারীরাও রয়েছেন অনেক।

বর্তমানে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সরকারের উন্নয়নের রূপরেখা বাস্তবায়নের জন্য তিনটি বিষয়ের ওপর খুব জোর দিচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে ইকোনমিক ডিপ্লোমেসি, পাবলিক ডিপ্লোমেসি ও প্রবাসে স্বদেশি নাগরিকদের সেবার মান বৃদ্ধি।

এর মধ্যে ইকোনমিক ডিপ্লোমেসির প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে অধিকতর বিনিয়োগ বাড়ানো, রফতানি বাণিজ্য বাড়ানো ও এর পরিধি এবং ডেসটিনেশন বাড়ানো। রয়েছে বিদেশে জনবল বাড়াতে নতুন নতুন দিগন্তের উন্মোচনও।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ স্বাধীন হয়েছে বা সাধারণ মানুষের দুর্গতি তিরোহিত হয়েছে বা কমেছে প্রবাসী নেতৃত্বের জন্য। উদাহরণস্বরূপ ভারতের মহাত্মা গান্ধী, জামালউদ্দিন আফগানি, বাংলার হাজী শরীয়ত উল্লাহ বা তিতুমীর, রাশিয়ার লেনিন, জার্মানির কার্ল মার্কস, ফ্রান্সের ভলতেয়ার বা রুশো, ভিয়েতনামের হো চি মিন, ইরানের ইমাম খোমেনী প্রমুখ।

এমনকি বাংলাদেশের রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনাকেও বাধ্য হয়ে প্রায় ৬ বছর প্রবাসে থাকতে হয়েছে। আমাদের প্রবাসী ভাইবোনরা প্রতিনিয়ত রেমিটেন্স পাঠানোর মাধ্যমে দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড অব্যাহত রেখেছেন, তাই তাদেরও দেশ গড়ার কারিগর উপাধি দেয়া যায় নিঃসন্দেহে।

তবে তাদের অংশগ্রহণ বাড়াতে আমার একটি প্রস্তাবনা রয়েছে- রাইপেন। রাইপেন বিশ্লেষণ করলে যা পাওয়া যায়, তা হল- আর-এ রেমিটেন্স, আই-এ ইনভেস্টমেন্ট, পি-তে ফিলানথ্রপি, ই-তে এক্সচেঞ্জ এবং এন-এ নেটওয়ার্কিং।

প্রতি বছর যে রেমিটেন্স আসে, তার ব্যবহারে সতর্কতা বাড়াতে হবে। আমাদের রিজার্ভের একটি বড় অংশ বলতে গেলে অলস পড়ে থাকে। অবশ্য প্রবাসীদের রেমিটেন্স ও রিজার্ভের অর্থ কাজে লাগাতে একটি সেল করার কথা ভাবা হচ্ছে।

এসব অর্থ কাজে লাগিয়ে আমরা বড় বড় প্রজেক্ট করতে পারি, গভীর সমুদ্রবন্দরও হতে পারে। এতে কারও প্রতি মুখাপেক্ষী থাকতে হবে না। এরপর ‘আই’ অর্থ ইনভেস্টমেন্ট। আমি দীর্ঘদিন দেশের বাইরে ছিলাম।

দেশের হয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে অনেক ওকালতি করেছি, দেনদরবার করতে হয়েছে অনেক। বিশেষত ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর যখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কেউ কেউ নির্বাচনের ব্যাপারে জানতে চাইলেন, তখন অনেক তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করতে হয়েছে।

পরে তারা দেশের সামগ্রিক অবস্থা অবশ্য বুঝতে পেরেছিলেন। আমাদের এখানে ইনভেস্টমেন্ট সেলকে আরও সক্রিয় করতে হবে, সবকিছু সহজ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সম্পন্ন করার ব্যবস্থা চালু করতে হবে।

এতে একদিকে বিনিয়োগকারীরা লাভবান হবেন, অন্যদিকে দেশও লাভবান হবে। এখানে এনার্জি কস্ট কম, লেবার কস্ট কম, মোটের ওপর লাভবান হবে দেশ। প্রবাসীদের সম্পৃক্ত করা হবে এখানে।

দেশের বাইরে থাকাকালীন প্রবাসী অনেকের সঙ্গেই হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। প্রতি বছর অনেক অনেক প্রবাসী স্বদেশের উন্নয়নের জন্য বহুমুখী বিনিয়োগ প্রস্তাব নিয়ে আসেন। তবে তার অধিকাংশই কার্যকর হয় না। সুতরাং তাদের প্রস্তাবগুলো ফ্যাসিলেট করার জন্য বিনিয়োগ সেলের কার্যকারিতা বাড়াতে হবে।

এরপর পি-তে ফিলানথ্রপি। প্রবাসীরা দাতব্যমূলক কাজে সহায়তা করে থাকেন। কিন্তু এখানেও অনেক আমলাতান্ত্রিক জটিলতা থাকে। সে জটিলতাগুলোও দূর করতে হবে আমাদের। ই-তে দাঁড়ায় এক্সচেঞ্জ অব এক্সপেরিয়েন্স অ্যান্ড এক্সপার্টাইজ। অর্থাৎ অভিজ্ঞতা ও বিশেষজ্ঞ জ্ঞানবিনিময়।

বিদেশে আমাদের বহু অভিজ্ঞ প্রবাসী আছেন বিভিন্ন ক্ষেত্রে। প্রবাসী ডাক্তার বা শিক্ষক যখন দেশে আসেন, আমরা যদি তাকে অনুরোধ করি- আপনি এক সপ্তাহ বিনামূল্যে সেবা দিন। তিনি কিন্তু সেটি সানন্দেই দেবেন।

কিন্তু তিনি কখন আসেন, সে খবরই আমাদের হাতে নেই। বহু বড় বাঙালি আছেন, যারা সাইবার নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করছেন বিদেশে। তারা সেবা ও প্রশিক্ষণ দিতে পারেন আমাদের। তাদের জ্ঞান কাজে লাগানোর জন্য একটি সেল হতে পারে। এন-এর অর্থ হচ্ছে নেটওয়ার্কিং।

এখন অনেক বাঙালি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বড় বড় রাজনৈতিক পদে অধিষ্ঠিত। এ দেশে বিভিন্ন ধরনের সংকট যখন দেখা দেয়, তা সমাধানেও তারা কাজ করতে পারেন; যা আমাদের জন্য বড় ধরনের সহায়ক হতে পারে।

যেমন রোহিঙ্গা ইস্যু। আমাদের অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা আমাদের দেশের হয়ে লবিং করতে পারেন রোহিঙ্গা সমাধানে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা চাওয়ার জন্য। তারা সেখানে বিভিন্ন ক্ষেত্রে আস্থা অর্জন করেছেন, তারা একটি সুপারিশ করলে সেটি কাজে আসবে।

তাছাড়া অনেক বাঙালি এখন বহুজাতিক নানা প্রতিষ্ঠানের শীর্ষপদ বা দায়িত্বশীল পদে আসীন। তারা যদি দেশে বিনিয়োগ বা সেবামূলক কর্মসূচিতে বিনিয়োগের জন্য ওই প্রতিষ্ঠানে সুপারিশ করেন, তা খুব কাজে দেবে; যা দেবে না ১০টি বড় রোড শো করলে বা মন্ত্রী-এমপিদের ১০টি সফরেও।

সুতরাং, আমাদের এগুলো সংগঠিত রূপে করতে হবে। দক্ষিণ কোরিয়া করছে, ভারত, হন্ডুরাসের মতো রাষ্ট্রও করছে। আমরা কেন পিছিয়ে থাকব?

ড. এ কে আব্দুল মোমেন : মন্ত্রী, পররাষ্ট্রবিষয়ক মন্ত্রণালয়

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here