নিউজ ডেস্ক: নিশিরাতের নির্বাচনে ক্ষমতা নেয়া সরকারের আশ্রয়-প্রশ্রয় ও ছত্রছায়ায় দেশে দুর্নীতির মচ্ছব চলছে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। এসব দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয়ায় দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কড়া সমালোচনা করেছেন তিনি।
রাজধানীর নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বৃহস্পতিবার দুপুরে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন।
দুদকের সমালোচনা করে রিজভী বলেন, দেশের প্রতিটি সেক্টরে যখন দুর্নীতি মহামারী আকার ধারণ করেছে, তখন দুদক নীরব ভূমিকা পালন করছে। কারণ ক্ষমতাসীনদের দিকে তাকানো যাবে না।
‘এই দুনীতি দমন কমিশন এমন আরব্য রজনীর একচোখা দৈত্য, যে তার এক চোখ দিয়ে বিরোধী দলকে দেখে। সেখানে অন্যায় না থাকলেও জোর করে সরকার যেটি বলেন- এই আরব্য রজনীর সেই দৈত্যের মতো একদিকে দেখে। অন্যদিকে তারা কিছুই দেখতে পায় না।’
তিনি বলেন, ‘আমরা মনে করি- এই দুদকের চোখটি তৈরি করে দিয়েছে বর্তমান শাসকগোষ্ঠী। তার হাত-পা শাসক দলের কাছে বাঁধা রয়েছে। এই দুদক কী করছে আজকে জাতি জানতে চায়।’
সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে রিজভী বলেন, বর্তমানে দুর্নীতি আর লুটপাটের রাজত্বে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ। দুর্নীতি এখন মহামারী রূপ ধারণ করেছে। দেশের আর্থিক খাত আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। ব্যাংকগুলো তারল্য সংকটে ধুঁকছে। বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপি ঋণের ব্যাপারে দক্ষিণ এশিয়ায় শীর্ষে, যা ১২ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। ধানের ন্যায্যমূল্য না পেয়ে শোকে-দুঃখে কৃষক ধান পুড়িয়ে দেয়, কোরবানির চামড়ার ন্যায্যমূল্য না পেয়ে মানুষ চামড়া মাটির নিচে পুঁতে রাখে, অথচ দেশের সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে চলছে হরিলুট। ব্যাংকগুলো পরিণত হয়েছে লুটেরাদের মানিব্যাগে। দেশে বর্তমানে খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় এক লাখ ১২ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা। ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী ব্যবসায়ীরা এই ঋণখেলাপি হওয়ায় তাদের পক্ষে সাফাই গাইছেন স্বয়ং মধ্যরাতের নির্বাচনের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
দুর্নীতির ফলে ব্যাংকিং খাতে দূরাবস্থা চলছে মন্তব্য করে রিজভী বলেন, ব্যাংকগুলোতে এখন মূলধন সংকট দেখা দিয়েছে। টাকা পাচারকারী, ব্যাংক ডাকাত আর ঋণখেলাপিদের বেপরোয়া লুটপাটে দেশের ব্যাংকগুলো প্রায় দেউলিয়া। শেয়ারবাজারের লুটপাট ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের নিঃস্ব করে দিচ্ছে, অথচ সরকার নির্বিকার। লুটপাটের কারণে গত কয়েক মাসে শেয়ারবাজার থেকে বিদেশিরা ৬০০ কোটি টাকা পুঁজি প্রত্যাহার করে নিয়েছে।
কেবল ব্যাংক আর শেয়ারবাজার নয়, দুর্নীতির দুরন্তগতি চলছে সরকারের সব প্রকল্প এবং প্রতিষ্ঠানজুড়ে। চারদিকে শুধু ‘উল্টে-পাল্টে দে মা, লুটেপুটে খাই’ অবস্থার বিস্তার ঘটেছে। সাবেক রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান একবার তার দলের লোকজনের সর্বগ্রাসী দুর্নীতি দেখে দুঃখ করে বলেছিলেন- পাকিস্তান সব নিয়ে গেছে, চোরগুলো সব রেখে গেছে; সেই চোর আর চাটার দল একত্রিত হয়ে সোনার বাংলা লুটে নিচ্ছে। আজও সেই আওয়ামী লীগের লোকজন লুটপাট আর দুর্নীতিকে তাদের নীতি করে নিয়েছে।
বিভিন্ন প্রকল্পে দুর্নীতির বিষয়ে তিনি বলেন, গত মে মাসে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ফ্ল্যাটের জন্য ৬ হাজার ৭১৭ টাকায় একেকটি বালিশ ক্রয়ের মহাদুর্নীতিসহ ৩৬ কোটি টাকার বেশি লুটপাটের ঘটনা ফাঁস হওয়ার পর এবার দুর্নীতির বিশ্বরেকর্ড গড়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর আর ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ রোগীকে আড়াল করাতে একটি পর্দা কিনতে দাম দেখিয়েছে সাড়ে ৩৭ লাখ টাকা। ইতিমধ্যে হাসপাতালটির যন্ত্র ও সরঞ্জাম কেনাকাটাতেই অন্তত ৪১ কোটি টাকার দুর্নীতির প্রাথমিক প্রমাণ পেয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এখন অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে তদন্ত করতে দুদককে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। সম্প্রতি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল নাগরিক টিভির অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে আপনারা দেখেছেন, হাসপাতালের একটি অক্সিজেন জেনারেটিং প্ল্যান্ট কেনার খরচ দেখানো হয়েছে ৫ কোটি ২৭ লাখ টাকা। একটি ভ্যাকুয়াম প্ল্যান্ট ৮৭ লাখ ৫০ হাজার, একটি বিএইইস মনিটরিং প্ল্যান্ট ২৩ লাখ ৭৫ হাজার, তিনটি ডিজিটাল ব্লাড প্রেসার মেশিন ৩০ লাখ ৭৫ হাজার, আর একটি হেড কার্ডিয়াক স্টেথেসকোপের দাম ১ লাখ ১২ হাজার টাকা। এমন অবিশ্বাস্য দামে ১৬৬টি যন্ত্র ও সরঞ্জাম কিনেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। হাসপাতালটির ১১ কোটি ৫৩ লাখ ৪৬৫ টাকার মেডিকেল যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম কেনাকাটায় বিল দেখানো হয়েছে ৫২ কোটি ৬৬ লাখ ৭১ হাজার ২০০ টাকা। হাসপাতালের শীর্ষ কর্মকর্তারাও এই দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত। বই ক্রয়ে রীতিমতো পিলে চমকানো দুর্নীতি করেছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। সাড়ে ৫ হাজার টাকা দামের একটি বই স্বাস্থ্য অধিদফতর কিনেছে সাড়ে ৮৫ হাজার টাকায়! গোপালগঞ্জের শেখ সায়েরা খাতুন মেডিক্যাল কলেজের জন্য ‘প্রিন্সিপাল অ্যান্ড প্র্যাকটিস অব সার্জারি’ নামক সার্জারির পাঠ্যবইয়ের ১০টি কপি কিনেছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। ১০ কপি বইয়ের মোট দাম পরিশোধ করা হয়েছে ৮ লাখ ৫৫ হাজার টাকায়। শুধু এই একটি আইটেমের বই-ই নয়, দুটি টেন্ডারে ৪৭৯টি আইটেমের ৭ হাজার ৯৫০টি বই কিনেছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। এসব বইয়ের মূল্য বাবদ পরিশোধ করা হয়েছে ৬ কোটি ৮৯ লাখ ৩৪ হাজার ২৪৩ টাকা।
বিএনপির এই নেতা বলেন, নানা প্রকল্পের নামে ক্ষমতাসীন দলের লুটেরাদের কর্মকাণ্ডে উৎসাহিত হয়ে এখন প্রশাসনের লোকজনও জড়িয়ে পড়েছে স্বেচ্ছাচারিতা আর দুর্নীতিতে। হারিয়ে গেছে জবাবদিহি আর শৃঙ্খলার সব রীতিনীতি। পুকুর কাটা শিখতে রাজশাহীর বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের ১৬ কর্মকর্তা রাষ্ট্রের ১ কোটি ২৮ লাখ টাকা ব্যয় করে ইউরোপ সফরে যাচ্ছেন। আবহমানকাল ধরে এ দেশের সাধারণ মানুষ পুকুর কাটার যে দৃষ্টান্ত রেখে গেছে, এটিই তো সারাবিশ্বের কাছে শিক্ষণীয়। দেশব্যাপী যে বিখ্যাত দীঘিগুলো এখনও অস্তিত্বমান, তার জন্য কি এই পুকুর কাটার সঙ্গে জড়িতরা বিদেশ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে এসেছিল? শত শত বছর ধরেই তো দেশীয় লোকেরা মসজিদ, মন্দির, মাজার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সামনে অথবা আর্থিকভাবে সচ্ছলতাসম্পন্ন মানুষরা নিজেদের বাড়ির সামনে পুকুর-দীঘি তৈরি করেছেন তাদের তো বিদেশ থেকে প্রশিক্ষণের প্রয়োজন হয়নি।
তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, তা হলে রাজশাহী বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তাদের এটি কী আসলে অভিজ্ঞতা সফর নাকি ২০১৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের মধ্যরাতে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের ব্যালটবাক্স পূর্ণ করে ক্ষমতায় বসানোর পুরস্কার? তাই এসব দেখেশুনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি উদ্ধৃতি মনে পড়ে গেল- ‘আমাদের রাজা গুণীর পালক/মানুষ হইয়া গেল কত লোক। আসে এক বুড়ো গণ্যমান্য/করপুটে লয়ে দুর্বাধান্য/রাজা তার প্রতি অতি বদান্য/ভরিয়া দিলেন থলি।’ সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য আবুল খায়ের ভুঁইয়া, যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির খোকন, কেন্দ্রীয় নেতা আবদুস সালাম আজাদ, মুনির হোসেন, আবদুল আউয়াল খান, আমিনুল ইসলাম, মীর হেলাল প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।