ছাত্রলীগের নেতৃত্বে দুই ভারপ্রাপ্ত : সভাপতি জয় সম্পাদক লেখক

0
317

বাংলা খবর ডেস্ক: চাঁদাবাজিসহ নানা অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও গোলাম রাব্বানীকে ছাত্রলীগের নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। সংগঠনের সিনিয়র সহ-সভাপতি আল-নাহিয়ান খান জয়কে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এবং সিনিয়র যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্যকে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক করা হয়।

শনিবার সন্ধ্যায় গণভবনে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। দলের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে এ সভা অনুষ্ঠিত হয়।

এখানেই সিদ্ধান্ত হয়, ২০ এবং ২১ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। এর আগে তৃণমূল সম্মেলন শেষ করার নির্দেশ দেন আওয়ামী লীগ সভাপতি।

বৈঠক শেষে গণভবনে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেন, শোভন-রাব্বানীকে পদত্যাগ করতে বলা হয়। ২০ ও ২১ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে বলেও তিনি জানান।

বৈঠক উপস্থিত একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা জানান, গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির মেয়াদ ২ বছর। সে হিসাবে বর্তমান কমিটির মেয়াদ আরও ১০ মাস বাকি আছে। এ সময়ের জন্য ভারপ্রাপ্ত হিসেবে এ দু’জনকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।

আগামী সম্মেলনের আগ পর্যন্ত তারা ভারপ্রাপ্ত হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। তারা আরও জানান, যেসব বিদ্রোহী প্রার্থী বরাবর শোকজ চিঠি পাঠানো হয়েছে তাদের জবাব পাওয়ার পর কেস টু কেস বিবেচনা করে ব্যবস্থা নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

বৈঠকে ক্যাডার পলিটিক্স চিরতরে বন্ধ করতে দলীয় নেতাদের নির্দেশ দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, সাংগঠনিক সম্পাদকরা বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে নিজেদের মতো করে একচেটিয়া কমিটি করে। জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয় নেতাদের উপেক্ষা করে।

দল দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকায় যেসব জায়গায় নেতারা ক্যাডার তৈরি করেছে সেই ক্যাডাররা প্রকাশ্যে অস্ত্র মহড়া করে দলের ভাবমূর্তি নষ্ট করছে। প্রত্যেককে তাদের ক্যাডার নিবৃত্তি করার নির্দেশ দিয়ে তিনি বলেন, না হলে যেভাবে জঙ্গি দমন, সন্ত্রাস দমন, মাদক দমন করা হয়েছে সেইভাবে ক্যাডার দমন করা হবে। কে কোন দলের ক্যাডার সেটা দেখা হবে না। ক্যাডার পলিটিক্স চিরতরে বন্ধ করতে হবে। আওয়ামী লীগ ক্যাডার পলিটিক্সে বিশ্বাস করে না।

চাঁদাবাজিসহ নানা অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ৭ সেপ্টেম্বর দলের মনোনয়ন বোর্ডের যৌথসভায় ছাত্রলীগের কমিটি ভেঙে দেয়ার নির্দেশ দেন শেখ হাসিনা। সেদিনের বৈঠকে উপস্থিত একাধিক নেতা জানান, মূলত ছাত্রলীগের কমিটি পুনর্গঠনের প্রক্রিয়া সেদিন শুরু হয়েছিল।

এরপর ৮ ও ৯ সেপ্টেম্বর গণভবনে দলীয় সভাপতির সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে ফেরত আসেন শোভন-রাব্বানী। এরই মধ্যে তাদের গণভবনে প্রবেশের স্থায়ী পাস স্থগিত হয়ে যায়। এ কারণে শোভন-রাব্বানীর পিছু ছাড়েন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের বড় একটি অংশ।

সংগঠনের সহ-সভাপতি, যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক, সাংগঠনিক সম্পাদক ও সম্পাদক পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ অনেক নেতা শোভন-রাব্বানীকে পাশ কাটিয়ে চলেন। এমনকি শেষ দিকে ফেসবুকেও আগের মতো সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের পক্ষে সে ধরনের প্রচারণা ছিল না।

বিষয়টি নিয়ে পরদিন সংসদ ভবনে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে দেখা করতে যান দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। কিন্তু তিনিও খালি হাতে ফিরে আসেন। এছাড়া ছাত্রলীগের দায়িত্বে থাকা কেন্দ্রীয় চার নেতা পরপর দু’বার বিশেষ সুপারিশের জন্য গণভবনে গিয়ে ফিরে আসেন।

ভুল সংশোধনের সুযোগ চেয়ে ও ক্ষমাপ্রার্থনা করে প্রধানমন্ত্রী বরাবর চিঠি লিখেছিলেন গোলাম রাব্বানী। শুক্রবার ‘ভিসির কাছে চাঁদা দাবি’- শিরোনামে যুগান্তরে সংবাদ প্রকাশিত হলে আলোচনা নতুন মোড় নেয়।

সারা দেশে ছাত্রলীগ সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের প্রতি নিন্দার ঝড় ওঠে। শনিবারের বৈঠকে তাদের বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

শোভন-রাব্বানীকে পদ থেকে অব্যাহতি দেয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে আনন্দ-উল্লাস করেছেন ছাত্রলীগের পদবঞ্চিত নেতাকর্মীরা। রাতে টিএসসিতে জড়ো হয়ে তারা পরস্পরকে জড়িয়ে ধরেন এবং আনন্দ-উল্লাস করেন।

ছাত্রলীগের সাবেক কর্মসূচি ও পরিকল্পনা সম্পাদক রাকীব হোসেন বলেন, সংগঠনের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণকারী ও রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হওয়ায় বহিষ্কৃতদের বিরুদ্ধে দেশের প্রচলিত আইনে ব্যবস্থা নিতে হবে।

ছাত্রলীগের কমিটির নতুন দায়িত্বশীলদের নাম ঘোষণার পরপরই ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকার ছাত্রলীগের নেতাকর্মী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হল শাখাগুলোর নেতাকর্মী টিএসসিতে জড়ো হতে থাকেন। রাত ১২টা পর্যন্ত সেখানে তাদের স্লোগান দিয়ে আনন্দ-উল্লাস করতে দেখা গেছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সাবেক ছাত্র ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আল-নাহিয়ান খান জয় আগের কমিটিতে আইনবিষয়ক সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সার্জেন্ট জহরুল হক হল শাখা ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক ছিলেন জয়। শোভনের সঙ্গে একই বর্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন তিনি।

বর্তমানে তিনি ক্রিমিনোলজি বিভাগ থেকে সান্ধ্যকালীন মাস্টার্স করছেন। বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলার আগরপুর ইউনিয়নের ঠাকুরমল্লিক গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা আবদুল আলী খানের ছেলে জয়। বঙ্গবন্ধুর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে বাবার হাত ধরে তিনি ছাত্রলীগের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হন।

বরিশাল জেলা স্কুলে পড়ার সময় ছাত্রলীগের রাজনীতিতে তার হাতেখড়ি। উপজেলা ছাত্রলীগেও তিনি সম্পৃক্ত ছিলেন। এসএসসি পাস করে ঢাকা কমার্স কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করেন তিনি। তার দক্ষ নেতৃত্বের কারণে এ কলেজে ছাত্রলীগের কার্যক্রম অনেকটা এগিয়ে যায়।

উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০০৮-০৯ সেশনে আইন বিভাগে ভর্তি হন জয়। মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তান জয়ের পরিবার আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত।

আর ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য এর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ বিভাগের স্নাতকোত্তর ছাত্র।

যশোরের মনিরামপুরের ছেলে লেখক ওই এলাকার এমপি ও স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্যের ভাতিজা। ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ও জগন্নাথ হল শাখার আগের কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন লেখক।

২০১৮ সালের ১১ ও ১২ মে ২৯তম ছাত্রলীগের জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ৩১ জুলাই আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভনকে সভাপতি ও গোলাম রাব্বানীকে সাধারণ সম্পাদক করে ছাত্রলীগের কমিটি ঘোষণা করেন।

শুরু থেকেই দুই নেতার জন্য প্রধানমন্ত্রীর দরজা খোলা ছিল। এর ফলে অতীতের মতো আওয়ামী লীগের জাতীয় বা স্থানীয় পর্যায়ের প্রভাবশালী কেউ চাইলেই ছাত্রলীগে সরাসরি হস্তক্ষেপের সুযোগ পাননি।

কিন্তু শোভন-রাব্বানী এ ইতিবাচক দিকটির সদ্ব্যবহার না করে এটিকে নেতিবাচক বিষয়ে পরিণত করেছেন বলে অভিযোগ করেন অনেক নেতা।

কেন্দ্রীয় কমিটির মেয়াদ ১ বছর না পেরোতেই শোভন-রাব্বানীর বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ ওঠে। আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের একাধিক নেতাসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনেও ছাত্রলীগের বর্তমান কমিটির বিরুদ্ধে নানা ধরনের নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের কথা উঠে আসে।

এর মধ্যে স্বেচ্ছাচারিতা, অদক্ষতা ও অদূরদর্শিতা, নেতাকর্মীদের প্রত্যাশিত মূল্যায়ন না করা অন্যতম। এছাড়া আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের উপেক্ষা, ফোন রিসিভ না করার অভিযোগও ছিল।

এর বাইরে রাতজাগা ও দেরিতে ঘুম থেকে ওঠা, কর্মসূচিতে বিলম্বে যাওয়া, প্রধান অতিথিদের বসিয়ে রাখা, জেলা সম্মেলন করতে না পারা, বিতর্কিতদের দিয়ে কমিটি গঠনের বিষয়ও এ তালিকায় রয়েছে।

তাদের বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির কাছে চাঁদা দাবির অভিযোগও আছে। এসব দেখে-শুনে ক্ষুব্ধ আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা শনিবার সংগঠনটির কেন্দ্রীয় কমিটি ভেঙে দিতে বলেন।

ছাত্রলীগসংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রধানমন্ত্রী কমিটি দেয়ায় শোভন-রাব্বানীর প্রতি আলাদা নজর ছিল আওয়ামী লীগের সব মহলের। তারা ছাত্রলীগকে শেখ হাসিনার প্রত্যাশা অনুযায়ী ‘নতুন ধারায়’ ফিরিয়ে আনবেন এমন আশা ছিল সংশ্লিষ্টদের।

অথচ সে আশায় গুড়ে বালি। একের পর এক বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িয়েছেন তারা। সংগঠনের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে চরম বিশৃঙ্খলা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here