ভালোবাসায় বসন্ত বিলাস

0
83

ফারজানা ইসলাম লিনু

প্রকৃ্তির নিষ্ঠুর রসিকতায় আমি রীতিমতো ত্যক্ত-বিরক্ত। অসহ্য বিরক্তির শীতার্ত বিদায়ী বাতাসে ঠাণ্ডাজনিত ফ্লুতে আক্রান্ত হয়ে হাঁচি, কাশি এখন নিত্য সঙ্গী।

বিষাদগ্রস্ত মাঘের পাতা ঝরা দিনে আজ ঝলমলে রোদ উঠেছে। প্রভাতে নিদ্রা ভাঙতেই চোখ যায় জানালার পাশের বিশাল কড়ই গাছটার দিকে। অপলক তাকিয়ে দেখি একটাও পাতা নেই গাছে। কেমন দুঃখি ভাব নিয়ে কষ্টের কাষ্ঠ হাসি হাসছে মরা ডালপালাগুলো।

অথচ কিছুদিন আগেও পাখপাখালির মেলা ছিল পাতা বহুল গাছটাতে। পাখিদের ভীড়ে একজোড়া অসুখি কাক দম্পতির অহর্নিশ কাইজ্যায় আমার ভাত ঘুমে বিঘ্ন ঘটত।

কাকদের দাম্পত্য খুনসুঁটি শোনা যায় না আজ কতদিন। দরজা খুলেই দেখা হয় না কাক বউয়ের মান ভঞ্জনে কাক জামাইয়ের কসরত।

পত্র পল্লবহীন বৃক্ষের ডালে তাদের ভালোবাসা বা কলহ কিছুই জমে না মনে হয়। সবুজ পাতা গজালে কাকেরা হয়তো সদলবলে ফিরে আসবে আবার। তখন শুধু ঝগড়াটে কাক না রাজ্যের পাখিদের মেলা বসবে গাছটায়। তাদের উৎকট প্রণয়কাণ্ডের আতিশয্যে মুখরিত হবে আমার জানালার পাশের গবাক তরুর সারি।

পাখিদের বিরহে কিছুটা কাতর হয়ে ফোনটা হাতে নিতেই দেখি ইনবক্স, আউটবক্স ভর্তি ভালোবাসার পঙক্তি। তৎক্ষণাৎ মনে পড়ে যায়, আজ “ভালোবাসা দিবস”।

সেই অনন্তকাল থেকে কোকিলের কুহুতান, বসন্ত বাতাস আর ফাগুনের আগুন লাগা দিনের সাথে আমাদের সখ্যতা। বসন্ত আসলেই শুরু হয় যায়….

“বসন্ত বাতাসে সই গো, বসন্ত বাতাসে।
বন্ধুর বাড়ির ফুলের গন্ধ আমার বাড়ি আসে।”

বসন্ত বাতাসের এই গন্ধে ভাগ বসায় ভ্যালেন্টাইন ডে বা বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। বহু বছর আগের প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্যের এক কাহিনীর সূত্র ধরে প্রবর্তিত হয় এই বিশেষ দিবস।

কথিত আছে যুদ্ধবাজ এক রোমান রাজা দ্বিতীয় গ্লডিয়াস তার রাজ্যের পুরুষদের যুদ্ধযাত্রায় উৎসাহিত করতে বিবাহ নিষিদ্ধ করেন। ক্যাথলিক ধর্মযাজক সেন্ট ভ্যালেন্টাইন এই নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে প্রেমাসক্ত তরুণ তরুণীদের গোপনে বিয়ে দিয়ে দেন। ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর নিষেধাজ্ঞা অমান্যকারী যাজক ভ্যালন্টাইনকে কারাগারে বন্দি করা হয়। কিন্তু ভ্যালেনটাইনের ভালোবাসাকে আটকে রাখা করা যায় না। বন্দি অবস্থায় কারারক্ষীর মেয়ের সঙ্গে গড়ে উঠে তার গভীর প্রণয়। যাজকদের জন্য বিয়ে নিষিদ্ধ থাকলেও ভালোবাসার কাছে সব নিষেধ তুচ্ছ।

এইবারও ভ্যালেন্টাইনের বিরুদ্ধে প্রথা ভঙ্গের অভিযোগ ওঠে। গোপনে কারারক্ষীর মেয়েকে বিয়ে করার অপরাধে তার মৃত্যুদণ্ড হয়। দিনটি ছিল সম্ভবত ২৭০ খ্রিস্টাব্দের ১৪ ফেব্রুয়ারি। ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার আগে ভ্যালেন্টাইন প্রেয়সীর উদ্দেশে লিখে যান কয়েক ছত্র ভালোবাসার বাণী।

ভালোবাসার জন্য ভ্যালেন্টাইনের আত্মদানের সহস্র বছর পর পাশ্চাত্যে শুরু হয় “ভ্যালেন্টাইনস ডে”। আকাশ সংস্কৃতির বিস্তারে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে পাশ্চাত্য থেকে প্রাচ্যে।

এক সময় বিশ্ব ভালোবাসা দিবস আমাদের কাছে শফিক রেহমানের যায় যায় দিনের ভালোবাসা সংখ্যার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। ফেব্রুয়ারির ভালোবাসা সংখ্যার জন্য আমাদের ছিল তীর্থের কাকের প্রতিক্ষা। এই মাসে আমাদের চোখ থাকতো ঢাকা থেকে আগত আপনজনদের বুচকার দিকে। কারো ব্যাগ থেকে যদি একটা ভালোবাসা সংখ্যা বের হয়। তারপর পড়ি মরি করে শুরু হয় প্রতিযোগিতা । কে কার আগে পাঠকের ভালোবাসার গল্পগুলো পড়বো।

হোস্টেলে আসলে সেই কষ্টটা ঘুচে যায়। নিজেই নিজের জন্য যায় যায় দিন ভালোবাসা সংখ্যার কপিটা যোগাড় করতে পারি। কি অপার আনন্দে পাঠকের ভালোবাসার গল্পটা পড়ি। কারো ভালোবাসায় আপ্লুত, আবার কারো বিচ্ছেদে মর্মাহত।

করপোরেট দুনিয়ার চালাকিতে “যায় যায় দিনের” গন্ডি ছাড়িয়ে বিশ্ব ভালোবাসা দিবস এখন আমাদের সংস্কৃতির পরতে পরতে। কারও মতে ভালোবাসার জন্য একটা দিনকে আলাদা করে বেছে নিতে ক্ষতি কি?
আবার কারও মতে, বছরের সব দিনইতো ভালোবাসা বাসির। এর মধ্যে এত বাড়াবাড়ির কি হল?

মধ্যবিত্তের সবকিছুতেই মধ্যম মনোভাব। বিশ্ব ভালোবাসা দিবসের বিতর্কেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। মধ্যবিত্তের ক্ষুদ্র অংশের প্রতিনিধি হিসেবে এই ক্ষেত্রেও সিদ্ধান্ত নিতে পারি না, ভালোবাসা দিবস থাকবে কি থাকবে না।

তবে আমার কাছে ভালোবাসা দিবসের আলাদা গুরুত্ব নেই।

আমাদের আটপৌরে জীবনে আছে দুঃখ, আছে কষ্ট, আছে অপ্রাপ্তি ও অপূর্ণতা। কিন্তু নিখাদ ভালোবাসার কমতি তো নেই। তাহলে কি দরকার বছরের একটি দিনকে ভালোবাসাময় ভেবে বাকি দিনগুলোকে গুরুত্বহীন ভাবার।

জীবনের প্রতিটা দিন হোক ভালোবাসাময় এই প্রত্যাশায়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here