বাংলা খবর ডেস্ক: করোনা ভাইরাসজনিত বৈশ্বিক মহামারির কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সম্ভাব্য মহাদুর্যোগ মোকাবিলায় বিএনপির পক্ষ থেকে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী ৮৭ হাজার কোটি টাকার অর্থনৈতিক প্যাকেজ প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে। যা বাংলাদেশের জিডিপির তিন শতাংশ। এরমধ্যে স্বল্পমেয়াদী খাতে ৬১ হাজার কোটি, মধ্যমেয়াদী খাতে ১৮ হাজার কোটি টাকার সুনির্দিষ্ট বরাদ্দ প্রস্তাবনা করা হয়েছে। এছাড়া অতিরিক্ত আট হাজার কোটি টাকা অদৃশ্য খাত ও অন্যান্য খাতে ব্যয় করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
শনিবার (৪ এপ্রিল) বেলা সাড়ে ১১টার দিকে রাজধানীর গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সংবাদ সম্মেলনে এ প্যাকেজ প্রস্তাবনা পেশ করেন।
মির্জা ফখরুল বলেন, বিশ্বে মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়া করোনা ভাইরাস গোটা মানবজাতিকে হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ করোনার তৃতীয় স্তরে পৌঁছেছে। অর্থাৎ করোনা এখন কমিউনিটি পর্যায়ে সংক্রমিত হওয়া শুরু হয়েছে। তাই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রদত্ত নীতিমালা অনুযায়ী সবাইকে আরও সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
তিনি বলেন, কাশি-জ্বর হলেই তা করোনা নাও হতে পারে। তাই এখন প্রয়োজন পরীক্ষা আর পরীক্ষা। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে সরকারের রোগ পরীক্ষা ও আক্রান্তের পরিসংখ্যানের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
মির্জা ফখরুল বলেন, প্রধানমন্ত্রী তার এক সাম্প্রতিক ভাষণে গার্মেন্টসসহ রপ্তানি শিল্প-কারখানার শ্রমিকদের বেতন-ভাতাদির খাতে পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করেছেন। রপ্তানিমুখী শিল্প-কারখানার শ্রমিকদের বেতনের হিসাব নিলে এ প্রণোদনার পরিমাণ যথেষ্ট নয় বলে আমরা মনে করি।
তিনি বলেন, আমরা ইতোমধ্যে করোনা ভাইরাস নিয়ে দলের পক্ষ থেকে বক্তব্য তুলে ধরেছি। এখন আমরা শুধুমাত্র অর্থনৈতিক ক্ষেত্রের জন্য কতােগুলো পদক্ষেপের প্রস্তাব রাখছি। তন্মধ্যে কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে স্বল্পমেয়াদী অনতিবিলম্বে। কিছু মধ্যমেয়াদে ও কিছু দীর্ঘমেয়াদী।
আমাদের প্রদত্ত সুপারিশসমূহ বাস্তবায়নের জন্য জিডিপির তিন শতাংশ অর্থ সমন্বয়ে ৮৭ হাজার কোটি টাকার একটি বিশেষ তহবিল ঘোষণা করতে হবে । শাটডাউন প্রত্যাহার হলে নতুন করে একটি সংশোধিত আর্থিক প্যাকেজ প্রদান করতে হবে যেন সব সেক্টরের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সাধারণ ছুটি পূর্ব স্তরে ফিরে আসতে সক্ষম হয়।
স্বল্পমেয়াদী পদক্ষেপ
দিন এনে দিন খায় এ ক্যাটাগরির যেসব শ্রমিক, দিনমজুর, রিকশাওয়ালা, ভ্যানচালক, হকার, ভাসমান শ্রমিক, ছিন্নমূল, ভিক্ষুক, ভবঘুরে, সিএনজিচালক, ভাড়াভিত্তিক গাড়িচালক (উবার, পাঠাও ইত্যাদি), পরিবহন শ্রমিক, বস্তিবাসী ইত্যাদি মহামারির কারণে অঘোষিত লকডাউনে কর্মহীন হয়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনতিবিলম্বে এদের মুখে খাবার তুলে দেয়া অপরিহার্য। দ্রব্যসামগ্রী ক্রয়ে দুর্নীতি ও জটিলতা এড়াতে পণ্যসামগ্রীর পরিবর্তে নগদ টাকা দিতে হবে। কোনাে প্রকারেই রাজনৈতিক বা দলীয় লোকজনকে এ কাজে সম্পৃক্ত করা যাবে না। প্রাথমিকভাবে এপ্রিল-মে-জুন এ তিন মাসের জন্য জনপ্রতি ১৫ হাজার টাকা বরাদ্দ করে অনতিবিলম্বে ঘরে ঘরে গিয়ে টাকা নগদ পরিশোধ করতে হবে। এজন্য ন্যূনতম আট হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করতে হবে।
সমস্ত শ্রমিক শ্রেণীকে (গার্মেন্ট, প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর আওতায় শিল্প ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত) সেবার জন্য টাকা ও জীবন যাত্রায় সমর্থন দিতে হবে। ৮০ লাখের অধিক শ্রমিক বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক সেক্টরে কাজ করছে। তাদের নগদ সাহায্য দিতে হবে। এটা সামাজিক সুরক্ষার আওতায় এনে অতিরিক্ত অর্থের যোগান দিয়ে এখনই করতে হবে। যাদের মজুরি/বেতন বন্ধ হয়ে গেছে তাদের জন্য এটা করতেই হবে।
প্রাথমিকভাবে আগামী ছয় মাসব্যাপী সব অপ্রাতিষ্ঠানিক সেক্টরে কর্মরত শ্রমিকদের নগদ টাকা সাহায্য দিয়ে জীবনযাত্রায় সমর্থন দিতে হবে। এ খাতে ছয় মাসের জন্য দুই কিস্তিতে প্রথম তিন মাসের ও পরবর্তী কিস্তিতে অবশিষ্ট টাকা নগদ দেওয়া যেতে পারে।
গার্মেন্টস ও রফতানিমুখী শিল্প শ্রমিক শ্রেণীকে ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে স্ব স্ব অ্যাকাউন্টে প্রাথমিকভাবে তিন মাসের একটি নগদ টাকা সাহায্য দিতে হবে। পরবর্তীতে তা আরও তিন মাসের জন্য বৃদ্ধি করা যেতে পারে। এজন্য প্রাথমিকভাবে ১০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করতে হবে।
বিএনপির মহাসচিব বলেন, খাদ্য উৎপাদন যেন ব্যাহত না হয় সেদিকে নজর দিতে হবে এবং বীজ, সার, কীটনাশক সেচ ও ভর্তুকিসহ অন্যান্য সহযোগিতার কাজ চালিয়ে যেতে হবে। প্রয়োজনীয় টাকা এখনই বরাদ্দ করতে হবে।
তিনি বলেন, বিভিন্ন দেশ থেকে বাধ্য হয়ে কয়েক লাখ প্রবাসী শ্রমিক বাংলাদেশে ফিরেছেন। তাদের অনেকেই শূন্য হাতে দেশে ফিরতে বাধ্য হয়েছেন। এদের চিহ্নিত করে প্রত্যেক প্রবাসীকে তিন মাসের জন্য মাসিক ১৫ হাজার টাকা আপদকালীন আর্থিক সাপোর্ট দিতে হবে, যাতে তারা যথাসময়ে পুনরায় বিদেশে স্বীয় কর্মস্থলে ফেরত যেতে পারেন। এজন্য এ খাতে এক হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করতে হবে।
স্বাস্থ্যখাত ও যারা করোনা মোকাবিলার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত সেসব হাসপাতাল এবং সম্পৃক্ত প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রাথমিকভাবে ১৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করতে হবে।
করোনা মোকাবিলার সঙ্গে যারা যুক্ত সেসব ডাক্তার, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের জীবন ঝুঁকির বিবেচনায় জরুরিভিত্তিতে তাদের স্বাস্থ্যবীমার ব্যবস্থা করতে হবে। আগামী তিন মাসের জন্য প্রতি চিকিৎসকদের জন্য এক কোটি, নার্সদের জন্য ৭৫ লাখ ও স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য ৫০ লাখ টাকার বীমার বিপরীতে প্রিমিয়াম সরকার বহন করবে।
রাজধানী, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে করোনা রোগীদের জন্য পৃথক হাসপাতাল স্থাপন/চিহ্নিতকরণ, পৃথক কোয়ারেন্টিন, আইসোলেশনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক/নার্সদের করোনা পরীক্ষা সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও জরুরিভিত্তিতে পর্যাপ্ত জনবল নিশ্চিত করতে হবে।
দ্রুততম সময়ে করোনা ভাইরাসের টেস্টিং কিট দেশে পর্যাপ্ত পরিমাণে আমদানি ও উৎপাদনের ব্যবস্থা করতে হবে। নতুন আইসিইউ স্থাপনের জন্য ভেন্টিলেটরসহ উন্নত চিকিৎসা সামগ্রী শুল্কমুক্ত আমদানির ব্যবস্থা করতে হবে।
প্রয়োজনে কমিউনিটি সেন্টার, কনভেনশন হল ও রাজধানীর বড় বড় শূন্য আবাসিক হোটেলগুলোকে সাময়িকভাবে হসপিটালে রূপান্তরিত করে জরুরি স্বাস্থ্য সেবা দিতে হবে।
প্রয়োজনে করোনায় আক্রান্তদের নদীতে ভাসমান জাহাজে আইসোলেশনের মাধ্যমে চিকিৎসাসেবা দেওয়া যেতে পারে। তাতে আক্রান্তের হার কমে আসবে।
মির্জা ফখরুল বলেন, বয়স্ক নারী, বিধবা, প্রতিবন্ধী, ষাটোর্ধ্ব বয়স্কদের আগামী তিন মাসের জন্য প্রতিমাসে জনপ্রতি ৫০০০ টাকা করে নগদ টাকা বিতরণ করতে হবে। এ খাতে আপাতত দুই হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করতে হবে।
সাধারণ ছুটি ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে লাখ লাখ মানুষ গ্রামে চলে গেছে। গ্রামে তাদের কোনাে কর্মসংস্থান নেই। শাটডাউন চলতে থাকলে ওই সময়ে বিপদগ্রস্ত এ জনগোষ্ঠীর মুখে খাবার তুলে দিয়ে এদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে। স্থানীয় প্রশাসন ও সামরিক বাহিনীর মাধ্যমে এদের আপদকালীন ভাতা হিসেবে প্রাথমিকভাবে এক মাসের জন্য মাথাপিছু ৫০০০ টাকা করে অর্থ প্রদান করতে হবে।