প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মানবিক পদক্ষেপ

0
560

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ১৩ এপ্রিল জাতির উদ্দেশে এক ভাষণে সকলকে নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়ে করোনাকবলিত অন্ধকার কেটে যাওয়ার প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছেন। তিনি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন যারা এই মহামারির সংকটে নিষ্ঠা ও সাহসের সঙ্গে সেবামূলক কাজে নিয়োজিত আছেন তাদের প্রতিও। এর আগে ১০ এপ্রিল জানিয়েছিলেন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যেসব চিকিৎসক, নার্স, সেনা, পুলিশ ও অন্যান্য কর্মকর্তা করোনাভাইরাস মোকাবিলায় বিভিন্ন দায়িত্বে নিয়োজিত রয়েছেন তারা পুরস্কৃত হবেন। তবে যারা দায়িত্ব পালন না করে পৃষ্ঠপ্রদর্শন করেছেন তারা কোনো প্রকার প্রণোদনা পাবেন না।

কয়েকদিন পরপর তিনি দেশের করোনাভাইরাস পরিস্থিতি নিয়ে সমস্ত জেলার প্রশাসনিক কর্মকর্তা এবং জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্স করেছেন এবং বলেছেন দুঃসময় আসছে, এপ্রিল মাসে করোনাভাইরাস ব্যাপকভাবে হানা দিতে পারে। এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় সবাইকে প্রস্তুত থাকতে হবে। করোনাভাইরাস মোকাবিলায় যারা জীবনবাজি রেখে কাজে নিয়োজিত, তাদের তিনি পুরস্কৃত করতে চান জানিয়ে তালিকা করতে বলেছেন।

বৈশ্বিক দুর্যোগে যারা দেশের মানুষের পাশে আছেন প্রধানমন্ত্রী তাদের সম্মানী দিতে চান। তারা বিশেষ ইনস্যুরেন্স পাবেন। দায়িত্ব পালনকালে কেউ করোনায় আক্রান্ত হলে তার চিকিৎসার সব ব্যবস্থা সরকার নেবে। পদমর্যাদা অনুযায়ী ৫ থেকে ১০ লাখ টাকার স্বাস্থ্যবীমা করা হবে। প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে এই বীমা পাঁচগুণ বাড়ানো হবে। তবে যারা ডাক্তারি পেশায় থেকেও মহতী দায়িত্বে অবহেলা করেছেন, রোগীকে ফেরত দিয়েছেন কিংবা নিজে আতঙ্কিত হয়ে পালিয়েছেন তাদের জন্য এই প্রণোদনা দেয়া হবে না।

পক্ষান্তরে যারা করোনার সময় কাজ করছেন, জীবনের ঝুঁকি নিচ্ছেন, এই প্রণোদনা তাদের জন্য। প্রধানমন্ত্রী কেবল করোনা রোগীর সংস্পর্শে আসা ডাক্তারদের জন্য নয়, খেটে খাওয়া মানুষের জন্যও মানবিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। করোনা পরিস্থিতির কারণে যারা কর্মহীন হয়ে পড়েছেন, তাদের জন্য রেশনের ব্যবস্থা করতে বলেছেন তিনি। যারা দিন এনে দিন খান, ছোটখাটো ব্যবসা-বাণিজ্য করেন, তাদের কাজ বন্ধ হয়ে আছে। তারা নানা ধরনের কষ্ট সহ্য করছেন। অনেকে আছেন, যারা অনুদান নেবেন না, কিন্তু কিনে খেতে চান, তাদের জন্য ব্যবস্থা করতে হবে। যারা হাত পাততে পারবেন না, তাদের তালিকা করতে হবে। তাদের বাচ্চা নিয়ে যাতে কষ্ট না হয়।

উপরের পদক্ষেপগুলো সবই বাংলাদেশের রাষ্ট্রনায়কের যিনি এদেশের মানুষের সামগ্রিক অবস্থা বুঝতে সক্ষম তার। উপরন্তু দুর্ভোগের সময় কেউ অনিয়ম করলে কোনো ছাড় দেয়া হবে না বলে তিনি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে গ্রামে যেতে অনিচ্ছুক ডাক্তারদের প্রতি প্রধানমন্ত্রী বিরক্তি প্রকাশ করেছিলেন। বলেছিলেন, যে ডাক্তার জেলা বা উপজেলায় যাবেন না তাকে ওএসডি করে নতুন ডাক্তার নিয়োগ দেয়া হবে। তাছাড়া দুর্যোগ এলে সেই দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতি মানুষ সাহসের সঙ্গে মোকাবিলা করবে এটাই স্বাভাবিক বলে মনে করেন প্রধানমন্ত্রী। এ জন্য তিনি ৩১ দফা নির্দেশনার প্রথম ১০টিতে রোগী এবং ডাক্তারদের দায়িত্ব-কর্তব্য স্পষ্ট করে উল্লেখ করেছেন।

এগুলো হলো- ‘করোনাভাইরাস সম্পর্কে চিকিৎসাব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এ ভাইরাস সম্পর্কিত সচেতনতা কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে হবে। লুকোচুরির দরকার নেই, করোনাভাইরাসের উপসর্গ দেখা দিলে ডাক্তারের শরণাপন্ন হোন। পিপিই সাধারণভাবে সকলের পরার দরকার নেই। চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট সবার জন্য পিপিই নিশ্চিত করতে হবে। এই রোগ চিকিৎসায় ব্যবহৃত পিপিই, মাস্কসহ সব চিকিৎসা সরঞ্জাম জীবাণুমুক্ত রাখা এবং বর্জ্য অপসারণের ক্ষেত্রে বিশেষ সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। কোভিড-১৯ রোগের চিকিৎসায় নিয়োজিত সব চিকিৎসক, নার্স, ল্যাব টেকনিশিয়ান, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, অ্যাম্বুলেন্স চালকসহ সংশ্লিষ্ট সবার স্বাস্থ্য সুরক্ষায় বিশেষ অগ্রাধিকার প্রদান করতে হবে। যারা হোম কোয়ারেন্টাইনে বা আইসোলেশনে আছেন, তাদের প্রতি মানবিক আচরণ করতে হবে। নিয়মিত হাত ধোয়া, মাস্ক ব্যবহার ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখাসহ এক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলবেন। অন্যান্য রোগে আক্রান্তদের যথাযথ স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং চিকিৎসাসেবা অব্যাহত রাখতে হবে। আইনশৃঙ্খলা বিষয়ে দৃষ্টি দিতে হবে। জাতীয় এ দুর্যোগে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগসহ সব সরকারি কর্মকর্তা যথাযথ ও সুষ্ঠু সমন্বয়ের মাধ্যমে কাজ করে যাচ্ছেন- এ ধারা অব্যাহত রাখতে হবে।’

উল্লেখ্য, ২২ মার্চ করোনা মোকাবিলায় ৫০০ চিকিৎসকের তালিকা চান শেখ হাসিনা। বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) ও স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) নেতারা সেই তালিকাও সরবরাহ করেছেন। এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে বাংলাদেশ প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ অ্যাসোসিয়েশন জানিয়েছে, করোনা মোকাবিলায় প্রস্তুত দেশের ৭০টি প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। ৮ মার্চ প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার পর চিকিৎসকদের ‘নিরাপত্তা এবং সুরক্ষা’র দাবি ছিল যথার্থ।

অবশ্য মনে রাখতে হবে, বিশ্বের প্রতিটি দেশই সম্মিলিতভাবে করোনা পরিস্থিতি সামাল দিচ্ছে। ফ্রন্টলাইনে আছেন চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা। তারাই এখন জনগণের আস্থার জায়গা। রোগীর পাশে দাঁড়িয়ে ভরসার কথা তারাই শোনাবেন, তাদের পেশাগত দায়িত্ব পালনের সঙ্গে সঙ্গে অসহায় ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে কাছে টেনে নেবেন, সাহস জোগাবেন- এটাই স্বাভাবিক। আর এ জন্যই করোনা আতঙ্কে লুকিয়ে থাকা বেশকিছু দায়িত্ব অসচেতন ডাক্তার সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন।

কিন্তু একইসঙ্গে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে স্বাস্থ্যবীমা প্রবর্তনের ঘোষণা দিয়ে আক্রান্ত ডাক্তার-নার্সদের সাহসও জুগিয়েছেন। আতঙ্ক দূর করার জন্য এ ধরনের মানবিক উদ্যোগ সত্যিই অভিনব ও প্রশংসনীয়। কারণ বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের মহামারিতে প্রাণ হারিয়েছেন সোয়া এক লাখের বেশি মানুষ আর আক্রান্ত হয়েছেন প্রায় ২১ লাখ। ফলে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে করোনা আতঙ্কে দিন কাটছে মানুষের। যদিও মৃত্যুর হার খুব বেশি নয় তবু আক্রান্ত ব্যক্তিদের সুস্থ করতে বিভিন্ন দেশের চিকিৎসকরা প্রাণপন লড়াই করে যাচ্ছেন। করোনা রোগীদের চিকিৎসা করতে গিয়ে বহু চিকিৎসক এই প্রাণঘাতী ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছেন। এমনকি অন্যদের প্রাণ বাঁচাতে গিয়ে অনেক চিকিৎসক নিজের প্রাণ হারিয়েছেন। ইতালিতে করোনায় মৃত্যু হয়েছে ১৮ হাজারের বেশি মানুষ আর সেখানে শতাধিক চিকিৎসকের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে করোনা।

বাংলাদেশেও করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন অর্ধশত চিকিৎসক। তবে প্রথম দিকে কিছু ডাক্তার আতঙ্কে কিংবা নিজের পরিবার ও সন্তানদের কথা চিন্তা করে করোনা আক্রান্ত রোগী সম্পর্কে উদাসীন থাকলেও এখন আবার জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রোগীদের চিকিৎসাসেবা দিয়ে মানবতার পরিচয় অক্ষুণ্ন রাখতে উৎসাহী হয়ে উঠেছেন। ৯ এপ্রিল একটি মিডিয়া প্রকাশ করেছে যে, করোনা ঝুঁকিতেও চট্টগ্রামের এক চিকিৎসক দম্পতি ডা. জাকির হোসেন ও ডা. রাহেলা বানু অনড় ও বদ্ধপরিকর। স্কুলপড়ুয়া দুই সন্তানকে বাসায় একা রেখে সারাদিন রোগীদের সেবায় ব্যস্ত থাকেন এই ডাক্তার দম্পতি।

এ ধরনের দৃষ্টান্ত দেশের অনেক জায়গা থেকে তুলে আনা যায়। অন্যদিকে রোগীর সেবা করতে গিয়ে একাধিক ডাক্তার এখন কোয়ারেন্টাইনে আছেন। এ জন্য তাদের প্রতি রাষ্ট্রের দায়িত্ব অনেক। তবে শেখ হাসিনা ৩০ নম্বর নির্দেশনায় গণমাধ্যমকর্মীদের জনসচেতনতা সৃষ্টিতে যথাযথ ভূমিকা পালন করতে বলেছেন। বিভিন্ন ধরনের গুজব ও অসত্য তথ্য যাতে বিভ্রান্তি ছড়াতে না পারে, সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখার আহ্বান জানিয়েছেন। অবশ্য তিনি তাদের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করার বিষয়ে কোনো পরামর্শ দেননি। কারণ ইতোমধ্যে বেশকিছু সাংবাদিক করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। এ জন্য এ বিষয়ে তার দিকনির্দেশনা ও প্রণোদনা বা সম্মানীর ঘোষণা আসা দরকার।

করোনাভাইরাস মোকাবিলায় বিশ্ব নেতাদের সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। চীনের কাছ থেকে চিকিৎসা সহায়তার প্রতিশ্রুতি অনুসারে পিপিই-মাস্ক প্রভৃতি সরবরাহের কথা ইতোমধ্যে আমরা জেনেছি। ১৫ মার্চ সার্কের আট দেশের সরকারপ্রধানরা করোনা মোকাবিলা নিয়ে করণীয় নির্ধারণে ভিডিও কনফারেন্সে মিলিত হন। ফলে ভারত থেকে প্রয়োজনীয় ওষুধের সরবরাহ পাওয়া যাচ্ছে এখন।

তাছাড়া জাপানও করোনা চিকিৎসায় আমাদের সহযোগিতা করবে। অর্থাৎ মহামারির পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য শেখ হাসিনার সার্বক্ষণিক প্রচেষ্টা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এক্ষেত্রে ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীদের সহযোগিতা সর্বাগ্রে প্রয়োজন। তাদের জন্য স্বাস্থ্যবীমা প্রচলন করে মানবিক রাষ্ট্রনায়কের কর্তব্যটিই পালন করলেন শেখ হাসিনা।

লেখক : বিশিষ্ট লেখক, কবি, কলামিস্ট
সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রগতিশীল কলামিস্ট ফোরাম
এবং অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here