করোনা নিয়ন্ত্রণে যেসব কারণে জাপান সফল

0
98

বাংলা খবর ডেস্ক: চীনে করোনার প্রাদুর্ভাবের একেবারে শুরুতেই যে কয়েকটি দেশে এ ভাইরাস আঘাত হেনেছে, জাপান তার মধ্যে অন্যতম। তারপরেও এখানে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা একেবারেই সামান্য, ৮ হাজারের মতো। মৃত্যুবরণ করেছে ও অল্প, দেড়শ’র কাছাকাছি। অনেকেই আমাকে প্রশ্ন করেছেন কীভাবে জাপান এই মহামারীকে মোকাবেলা করছে?

আপনারা জানেন জাপান প্রায় সারা বছরই কোন না কোন প্রাকৃতিক বিপর্যয় মোকাবেলা করে, আজ ঘূর্ণিঝড় তো কাল প্লাবন, পরশু আবার ভূমিকম্প। তাই প্রায় সারা বছরই জাপানিজদের বিপর্যয় মোকাবিলা করার একধরণের মানসিক প্রস্তুতি থাকে। যেমন, প্রত্যেক জাপানিজ বা জাপানে বসবাসকারী নাগরিকের ঘরেই আপদকালীন চাল, ডাল, পানি, লাইট, ব্যাটারি মজুদ করাই থাকে। তারপরেও এই করোনা ভাইরাসটা (কভিড-১৯) যেহেতু একটি বিশেষ বিপর্যয়, তার মোকাবেলা ও একটু বিশেষ ধরণের।

করোনাভাইরাসে কেন জাপানে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা এত কম?

১। জাপানিজরা জাতিগতভাবে খুবই কনজারভেটিভ, এরা কখনও কাউকে জড়িয়ে ধরে না, এমনকি হ্যান্ডসেক পর্যন্ত করেনা। কেবলমাত্র মাথা নুইয়ে একে অপরকে শুভেচ্ছা জানায়।

২। জাপানিজদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ও অনেক ভালো, পরিমিত শারীরিক ব্যায়াম এবং নিয়মিত সুষম খাদ্যাভ্যাসের কারণে।

৩। যদিও করোনা ভাইরাসের কোন টিকা এখনও আবিষ্কার হয়নি, তথাপিও জাপানে প্রতি বছর অক্টোবর-নভেম্বেরে ফ্লু ভ্যাকসিন নামে একধরনের ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের টিকা দেয়া হয়। এই টিকাটা প্রায় সকল কর্মজীবীর জন্য বাধ্যতামূলক। যে যেই প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে, কোম্পানির অর্থায়নে এই ভ্যাকসিন দেয়া হয়। ধারণা করা হচ্ছে এই ভ্যাকসিনটা দেয়ার কারণে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে ও একধরণের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়।

৪। জাপানে প্রতি বছর জানুয়ারির শেষের দিক থেকে একেবারে মে মাস পর্যন্ত ফুলের রেনু থেকে একধরনের সর্দি-কাশি হয়। এই সর্দিকাশি থেকে বাঁচার জন্য এই সময়ে শতকরা ৭০-৮০ ভাগ মানুষ মাস্ক ব্যবহার করে।

৫। জাতি হিসেবে খুবই আনুগত্যশীল, সরকার থেকে কোন দিক নির্দেশনা এলে অক্ষরে অক্ষরে পালন করার চেষ্টা করে।

করোনা মোকাবেলায় জাপানিজদের কৌশল

চলুন জেনে নিই জাপান করোনাকে মোকাবেলা করার কি কি বিশেষ কৌশল নিয়েছে। প্রথমেই বলে নিই, জাপান যে কোনো পরিস্থিতিতে কোন ব্যবস্থা নেয়ার আগে সংশ্লিষ্ট বিভাগের যারা বিশেষজ্ঞ তাদের গবেষণা ও মতামতের ভিত্তিতেই কেবল ব্যবস্থা গ্রহন করে থাকে। চলুন জানি ব্যবস্থাগুলি কি আর গবেষণাই বা কি বলে-

১. সামাজিক দূরত্বঃ জাপানি গবেষণা প্রতিষ্ঠান গবেষণা করে দেখেছে একজন অপরজন হতে ৬ ফুট দূরত্বে অবস্থান করলে এই ভাইরাসের বিস্তার ঠেকানো সম্ভব।

এ ব্যাপারে টোকিওর তোহো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কাযুহিরো তাতেদা বলেন, যদি আমরা কঠোরভাবে সামাজিক দূরত্ব ৮০ ভাগ পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করতে পারি, তবে এই ভাইরাসের বিস্তারকে প্রতিরোধ করতে এক মাসের প্রয়োজন পরবে। আর যদি আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে সামাজিক দূরত্ব ৭০ ভাগ, তাহলে সময় লাগবে ৩ মাস।

২। ঘন ঘন হাত ধোঁয়া ও মাস্কের ব্যাপক প্রচলন: টোকিও র তোহো বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনফেকশন কন্ট্রোল বিভাগের বিশেষজ্ঞ ডাঃ ইন্তেতসু কোবায়াশি তাঁর গবেষণাতে প্রকাশ করেছেন হাত ধূতে বেশি পরিমাণ সাবান ব্যবহার করতে হবে। কমপক্ষে ৩০ সেকেন্ড সময় নিতে হবে হাত ধূতে। হাতের উপর নিচ এবং প্রতিটি আঙ্গুলের ফাঁকফোকর নিশ্চিত করতে হবে। অপরিচ্ছন্ন হাত দিয়ে নাকে-মুখে বা কপালে স্পর্শ করা যাবেনা।

ডা. কোবায়াশি আরও বলেন, ব্যবহার্য মাস্ক অবশ্যই নাক মুখ এবং থুতনি ঢাকতে হবে। মাস্কের উপরের অংশ কোন ধাতু বা প্লাস্টিকের অংশ দ্বারা বন্ধ থাকতে হবে। কোন মাস্ক বারংবার ব্যবহার করা যাবে না। প্রতি ৩-৮ ঘণ্টা পরপর সেটা পরিবর্তন করতে হবে। ব্যবহৃত অবস্থায় মাস্কে কখনও হাত দিয়ে স্পর্শ করা যাবে না।

প্রতিবার মাস্ক পরিবর্তনের পরে হাত সাবান দিয়ে ধুয়ে ফেলতে হবে। আরেকটা গবেষণায় দেখানো হয়েছে যে সারজিক্যাল মাস্ক, কাপড় বা কাগজের মাস্কের তুলনায় করোনা প্রতিরোধে দ্বিগুণের ও অধিক কার্যকর।

৩। জনসমাগম এড়িয়ে চলা: অধ্যাপক তাতেদা তার গবেষণাগারে দেখিয়েছেন কোন একটি বন্ধ ঘরে দশের অধিক মানুষ থাকলে তাদের কথা বলা বা হাঁচি কাশির মাধ্যমে যে ছোট ছোট কণা বের হয় তা রুমের অন্যান্যকে ও সংক্রমণ করতে পারে, কেননা ২০-৩০ মিনিট পর্যন্ত তা বাতাসে ভেসে বেড়ায়। তবে মাস্ক ব্যবহার করলে এবং রুমে বাতাস প্রবাহের ব্যবস্থা থাকলে সেই আশংকা অনেকাংশেই কমে যায়।

৪। পরিচ্ছন্নতা: একেকটি করোনা ভাইরাসের ব্যাস ৫০-২০০ ন্যানোমিটার হয়ে থাকে। আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি কাশিতে যে কণা গুলো বের হয়, তা মেঝে বা আসবাবপত্রের উপর জমা থাকে। সাধারণ তাপমাত্রাতে ভাইরাসগুলো ৯-২৮ দিন পর্যন্ত জীবিত থাকতে পারে। সে জন্য মেঝে বা আসবাবপত্রের উপরিভাগ জীবাণু নাশক বা সাবান পানি দিয়ে নিয়মিত পরিস্কার রাখা জরুরী।

৫। নির্দিষ্ট ঔষধের প্রয়োগ: কভিড-১৯ এর যেহেতু নির্দিষ্ট কোন ঔষধ এখনও আবিস্কার হয়নি, হাসপাতাল এবং রোগীর উপসর্গভেদে জাপানের বিভিন্ন হাসপাতাল বিভিন্ন ভাইরাল নাশক ঔষধ ক্লিনিক্যাল ট্রাইয়ালের অংশ হিসেবে ব্যবহার করছে। এই ব্যাপারে বিস্তারিত পরের কিস্তিতে বর্ণনা করার আশা রাখছি।

লেখক: ডা. মোহাম্মাদ আরিফ হোসেন

সিনিয়র রিসার্চ সায়েন্টিস্ট, জিকেই মেডিকেল ইউনিভার্সিটি, টোকিও, জাপান

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here