কৃষকের ধান ক্রয় নাকি চাল রফতানি?

0
84
ছবি: সংগৃহীত

ড. জাহাঙ্গীর আলম:
গত সপ্তাহে একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের টক-শোতে একজন সরকারি অর্থনীতিবিদের কথা শুনছিলাম। সরকারি বলছি এ কারণে যে তিনি সরকারি অর্থে বেতন-ভাতা পেয়ে থাকেন। স্বাভাবিকভাবেই তার আনুগত্য থাকার কথা সরকারের প্রতি। আলোচনা হচ্ছিল ধানের বর্তমান মূল্য পতন নিয়ে। তিনি বললেন, দেশে ব্যবসায়ীদের কোন সিন্ডিকেট নেই। ধান-চালের বাজারে সিন্ডিকেট ক্রিয়াশীল নয়। আমার সঙ্গে আরও একজন আলোচক ছিলেন। তিনি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির শিক্ষক। কথাটায় তিনি বেশ বিব্রত হয়েছেন মনে হলো। আমার কাছেও তেমন সুখকর মনে হয়নি কথাটা। আমাদের দেশে চালের বাজার, তেলের বাজার, চিনির বাজার ও রসুন-পেঁয়াজের বাজারে প্রায়ই অস্বাভাবিক হারে মূল্য বেড়ে যায়। জনগণ বলে এটা মুনাফাখোর ব্যবসায়ীদের কারসাজি। তখন এদের সিন্ডিকেটকে দায়ী করা হয় বিভিন্ন আলোচনায়। এমনকি সরকারের মন্ত্রীরাও অনেক সময় সিন্ডিকেটকে দোষারোপ করে থাকেন। কিন্তু এই গবেষক তা অস্বীকার করছেন। চার বছর আগে গরুর মাংসের দাম ছিল ২৮০ টাকা প্রতি কেজি। অতঃপর ভারতীয় গরু আমদানি হ্রাসের অজুহাতে তা লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে যায় ৫০০ টাকায়। গত বছর (২০১৭-১৮ সালে) হাওরের বন্যায় বোরো চালের উৎপাদন কম হয়েছিল প্রায় সাড়ে ৯ লাখ টন। তাতে মোটা চালের দাম বেড়ে হয়েছিল প্রতি কেজি ৬০ টাকার উপরে। সরু চালের দাম বেড়ে হয়েছিল প্রতি কেজি ৭০ টাকার উপরে। ব্যবসায়ীদের চাপে সরকার চাল আমদানি উদারীকরণের স্বার্থে আমদানি শুল্ক ২৮ শতাংশ থেকে নামিয়ে দেয় ১০ শতাংশে। চাল আমদানি শুরু হয় পুরো উদ্যেমে, প্রচুর পরিমাণে। তাতেও তেমন কমেনি অভ্যন্তরীণ বাজারে চালের দাম। পরে আমদানিকারকদের চাপে আরেক দফা শুল্ক হ্রাস করে তা নির্ধারণ করা হয় ২ শতাংশে। ফলে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে মোট খাদ্যশস্যের আমদানির পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৯৮ লাখ টন। চাল আমদানি হয় ৩৯ লাখ টন। সেটা ছিল স্মরণকালের সর্বোচ্চ পরিমাণ আমদানি। তারপরও বাজারে চালের দামের ওপর প্রভাব পড়েছিল খুবই কম। মোটা চালের দাম ছিল ৪০ থেকে ৪৫ টাকা কেজি। সরু চাল ৬০ থেকে ৬৫ টাকা। তা ছিল আন্তর্জাতিক বাজার দরের চেয়ে অনেক বেশি। তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশের সব শ্রেণীর ভোক্তা। বিভিন্ন হিসেবে এ ক্ষতির পরিমাণ অনুমান করা হয়েছে প্রায় ২০ থেকে ২২ হাজার কোটি টাকা। ওই টাকা চলে গেছে এক শ্রেণীর ব্যবসায়ীদের পকেটে। এরপর দুটো আমন ও দুটো বোরো মৌসুমে দেশে ধানের উৎপাদন হয়েছে ভালো। চালের দাম নেমেছে মোটা চালের ক্ষেত্রে প্রতি কেজি ৩৫ টাকায় আর সরু চালের ক্ষেত্রে প্রতি কেজি ৫০ থেকে ৫৫ টাকায়। এবার শুরু হয়েছে ভিন্ন কৌশল। বোরো ধানের বাম্পার ফলনের সুবাদে এখন অনেক নেমে গেছে ধানের দাম। চাতালের মালিক ও চাল ব্যবসায়ীরা মাঠে গিয়ে তেমন বিপুল পরিমাণে চাল কিনছেন না কৃষকদের কাছ থেকে। তারা ৫০০ টাকার ওপর মণপ্রতি দিতে রাজি নয় ধানের দাম। উৎপাদনের ভর মৌসুমে অন্যান্য ক্রেতারাও বাজারে তেমন নেই। ২৫ এপ্রিল থেকে ধান-চাল সংগ্রহের কথা থাকলেও দ্রুত মাঠে নামেনি সরকার। ফলে দেশের প্রায় ৮২ শতাংশ ছোট ও প্রান্তিক কৃষকদের দেনার দায়ে ধান বিক্রি করে দিতে হচ্ছে পানির দরে। মাঠে ক্রিয়াশীল ব্যবসায়ীরা যে দর নির্ধারণ করছে সে দামেই বিক্রি হচ্ছে কৃষকের অতি কষ্টে উৎপাদিত ধান। তাতে লাভবান হচ্ছে শুধু এক শ্রেণীর ব্যবসায়ী। এক বছর আগে (২০১৭-১৮ সালে) তারা চালের দাম বাড়িয়ে ভোক্তাদের কষ্ট দিয়েছে, এখন ধানের দামে পতন ঘটিয়ে উৎপাদনকারী কৃষকদের দারুণ দুর্ভোগের মুখে ফেলে দিয়েছে।

প্রশ্ন হচ্ছে সিন্ডিকেট কি? সিন্ডিকেট হচ্ছে এক শ্রেণীর অতি লোভী ব্যবসায়ীদের অনৈতিক আঁতাত। যাদের মিলিত প্রচেষ্টায় পণ্যের দাম কখনো হয় আকাশচুম্বী, আবার কখনও তা পাতালে গিয়ে ঠেকে। অথচ এরা থাকে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। অলক্ষ্যে, অজ্ঞাতে এরা কাজ করে। মানুষকে জিম্মি করে এরা অফুরান মুনাফা লুটে নেয়। এদের অস্তিত্ব শনাক্ত করা দুষ্কর। গবেষণার মাধ্যমেও তা প্রমাণ করা দুরূহ। যেমন দূষিত বাতাসে দুর্গন্ধ ভেসে আসে। কিন্তু তা দেখা যায় না, ছোঁয়া যা না, শুধু অনুভব করা যায়। কিছুদিন আগে আমি সদরঘাট থেকে কিনেছিলাম কিছু বিদেশি নাশপাতি। দাম ছিল ২৬০ টাকা কেজি। এর কিছুদিন পর ফার্মগেট এবং তারপর মিরপুর ১০ নম্বর থেকে নাসপাতি কিনেছি প্রতি কেজি ওই ২৬০ টাকা দামেই। গত পরশু দিন রাইনখোলার বাজার থেকেও তা কিনেছি একই দামে, প্রতি কেজি ২৬০ টাকা। অথচ আমদানি খরচ ও ব্যবসায়ীদের মুনাফা যোগ করে এর দাম হওয়ার কথা সর্বোচ্চ ২০০ টাকা। মনে হয় এখানেও সিন্ডিকেটের কারসাজি বিরাজমান। ধান-চাল থেকে ফলমূলে, খাতুনগঞ্জ থেকে মতিঝিলে সর্বত্রই এর প্রভাব টের পাওয়া যায়।

এবার বোরো ধান উৎপাদনের আউটলুক ছিল ভালো। ইতোমধ্যে প্রায় ৬০/৭০ ভাগ ধান কাটা শেষ হয়েছে। চলতি মাসের মধ্যেই প্রায় সব ধান কাটা শেষ হয়ে যাবে। তখন বোঝা যাবে বোরো ধানের উৎপাদনে আমরা কতটুকু উদ্বৃত্ত। এর মধ্যে কোন প্রাকৃতিক বিপর্যয় হলে উদ্বৃত্ত নাও হতে পারে। সে হিসাব-নিকাশ হবে আরও পরে। তার আগেই দেশের এক শ্রেণীর ব্যবসায়ী দাবি তুলেছেন চাল রফতানির জন্য। তারা এ বিষয়ে সরকারের কাছে আনুষ্ঠানিক আবেদনও করেছেন। গত বছর নামমাত্র শুল্কে বিপুল পরিমাণ আমদানির পর সংরক্ষিত চাল এখনও তারা বিক্রি করতে পারেননি। এর পর বোরো বাম্পার ফলনে তারা শঙ্কিত। কারণ মজুদ করা চাল সহসাই বিক্রি করা সম্ভব হবে না অভ্যন্তরীণ বাজারে। তাই তাদের রফতানির দেনদরবার। এ বিষয়ে কথা বলেছেন সরকারের দুই মন্ত্রী। তারা বলেছেন, সরকার চাল রফতানির কথা ভাবছে। একজন মন্ত্রী বলেছেন, ভর্তুকি দিয়ে হলেও চাল রফতানি করা হবে। এটি সরকারের খুবই পরিপক্ব এবং চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত বলে মনে হয় না। এক বছর আগে শুল্ক প্রায় তুলে দিয়ে আমদানি করা হয়েছে লাখ লাখ টন চাল। এখন আবার ভর্তুকি দিয়ে চাল রফতানির কথা বলা হচ্ছে। ধারণা করি দুটোই ব্যবসায়ীদের স্বার্থে, তাদেরই প্ররোচনায়। একজন ব্যবসায়ী বলেছেন, চাল রফতানি শুরু হলে কৃষক ধানের চাহিদা বৃদ্ধি পাবে। তাতে ধানের দাম বাড়বে। অতএব, কাল-বিলম্ব না করে চাল রফতানির অনুমতি চাই। একজন কৃষক প্রতিনিধি বলেছেন। আমরা সরাসরিভাবে সরকারকে ধান দিতে চাই। মধ্যস্বত্বভোগীদের কাছে ধান বিক্রি করতে চাই না। এখানে দুজনের বক্তব্যই যতেœর সঙ্গে প্রণিধানযোগ্য। তবে ভর্তুকি দিয়ে ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে চাল রফতানির বিষয়টি সমর্থনযোগ্য মনে হয় না। ব্যবসায়ীরা বর্তমান নিম্নমুখী আন্তর্জাতিকবাজার দরে চাল রফতানি করতে চাচ্ছে তাদের গুদামজাত উদ্বৃত্ত চালের হিল্লা করার জন্য। তাদের ব্যবসায়িক সুবিধার জন্য। প্রত্যক্ষভাবে কৃষকের স্বার্থে নয়। কৃষকদের যদি দরপতনের মুখে কোন সুবিধা দিতে হয় তবে সরকার নির্ধারিত দামে তাদের নিকট থেকে সরাসরিভাবে ধান ক্রয় করে নিতে হবে।

সরকারি অর্থনীতিবিদরা বলছেন, মুক্তবাজার অর্থনীতিতে সরকারের ভূমিকা শুধু খেলা পরিচালনাকারী বেফারির মতো। অর্থাৎ তারা শুধু বাজার অংশগ্রহণকারী খেলোয়াড়দের শতর্ক করে দিয়ে বাঁশি বাজিয়ে যাবেন। বাজারে হস্তক্ষেপের কোন দায় সরকারের নেই। তাই যদি হয় তবে সরকার ধান-চাল সংগ্রহের জন্য মূল্য নির্ধারণ করছে কেন? কোনইবা খোলাবাজারে বিক্রি করছে চাল? রফতানি কর ও আমদানি শুল্ক বসিয়ে কেন নিয়ন্ত্রণ করছে দেশের আমদানি-রফতানিকে? সামনে দেশের জনগণ তথা কৃষকের প্রতি সরকারের দায়বদ্ধতা আছে। সে কারণেই বাজার হাস্তক্ষেপের প্রয়োজন হয় জরুরি মুহূর্তে। যেমন ধানের দাম এখন পরে গেছে। অতএব, দাবি উঠেছে বাজার হস্তক্ষেপের জন্য। মাঠে নেমে সরাসরিভাবে কৃষকের নিকট থেকে ধান কেনার জন্য। সরকারের একজন মন্ত্রী বলেছেন, প্রকৃত কৃষক খোঁজার উপায় না থাকায় সরাসরি ধান কেনা অসম্ভব। কথাটা এখন সামাজিক যোগাযোগ মিডিয়ায় বহুল প্রচারিত। অথচ কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের আয়োজনে উপকরণ কার্ড দেয়া হয়েছে দেশের প্রায় দেড় কোটি কৃষককে। তাছাড়া ১০ টাকার ব্যাংক একাউন্ট আছে প্রায় এক কোটি কৃষকের। তাছাড়া দেশের চাতালের মালিক ও ব্যবসায়ীরা যদি মাঠে নেমে কৃষকদের নিকট থেকে ধান কিনে নিতে পারে তাহলে সরকার তা পারবে না কেন? অবশ্যই পারবে। অতীতে পেরেছে, এখনও পারবে। এর জন্য সদিচ্ছা থাকা দরকার। ইতোমধ্যেই বিভিন্ন জেলায় কৃষকদের নিকট থেকে সরাসরিভাবে ধান কেনার জন্য নেমে পড়েছে। সরকারের মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তারা। তাতে অনেকের বোধোদয় হবে আশা করি। সরকারের গুদামের অভাব, লোকবলের অভাব এবং প্রয়োজনীয় বাজেটের অভাব বলে অনেক সময় বেশি মাত্রায় ধান-চাল সংগ্রহকে নিরুৎসাহিত করা হয়। কিন্তু এ সমস্যার সমাধানকল্পের আমরা কি কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারি না? দেশের বাজেট এখন অনেক বড় আকার ধারণ করেছে। বহু মেগা প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য। সেক্ষেত্রে কৃষকদের বাঁচিয়ে রাখার স্বার্থে এবং তাদের অর্থনীতিকে গতিশীল করার জন্য আমরা কি একটি মেগা প্রকল্প হাতে নিতে পারি না? আমরা কি সরাসরি কৃষকদের নিকট থেকে উপযুক্ত পরিমাণে ধা-চাল সংগ্রহের জন্য এবং এতদসংক্রান্ত অবকাঠামো গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় বাজেটের সংস্থান করতে পারি না? দেশে শ্রমিক সংকট হয় কৃষির উৎপাদনে মৌসুমে, অন্য সময় না। কৃষি মজুরের মৌসুমি সংকট কাটিয়ে উঠার জন্য ব্যাপক কৃষি যন্ত্রায়ণের কোন বিকল্প নেই। এর জন্য ভর্তুকি মূল্যে কৃষি যন্ত্রপাতি বিতরণের ব্যবস্থা করেছে সরকার। কিন্তু এ সুযোগ সীমিত। সব কৃষকের জন্য তা অবারিত নয়। দেশের প্রতিটি কৃষক যাতে প্রয়োজন মতো ভর্তুকি মূল্যে কৃষি যন্ত্রপাতি ক্রয় করতে পারে তার জন্য কি বাজার উন্মুক্ত করা যায় না?

দেশে ধানের মূল্য পতনের জন্য অনেকে বেশি পরিমাণে ধান উৎপাদনকে দায়ী করছেন এবং শস্য বহুধাকরণের ওপর জোর দিচ্ছেন। এ বিষয়ে আবার দ্বিমত আছে অনেকের। দেশের পুষ্টি সমস্যার সমাধানের জন্য অবশ্যই শস্যের বহুধাকরণ প্রয়োজন, কিন্তু ধান চাষের উপর গুরুত্ব কমিয়ে নয়। বাংলাদেশের মানুষের প্রধান খাদ্যশস্য চাল। এটি খুবই স্পর্শকাতর পণ্য। নীতিগত সমর্থন তুলে নিয়ে ধানের উৎপাদন হ্রাস করা হলে তা খাদ্য নিরাপত্তার জন্য হুমকি হতে পারে। সমাজের স্থিতিশীলতা বিনষ্ট হতে পারে। তাছাড়া বর্তমানে দেশে চালের উদ্ধৃত্ত খুবই কম। তার ওপর খাদ্যশস্যের আমদানি বাড়ছে বছরের পর বছর। ২০১০-১১ সালে খাদ্যশস্যের আমদানির পরিমাণ ছিল ৫৩ লাখ টন, ২০১৪-১৫ সালেও ছিল প্রায় ৫৩ লাখ টন, ২০১৬-১৭ সালে ছিল ৫৮ লাখ টন, এবং ২০১৭-১৮ সালে ছিল ৯৮ লাখ টন। এবার কিছুটা উদ্বৃত্ত হবে। কিন্তু খাদ্যশস্যের আমদানি চলছে অবিরত। দেশের কোন প্রাকৃতক বিপর্যয় দেখা দিলে ঘাটতি হবে খাদ্যশস্যের। এমন পরিস্থিতিতে ধান চাষিদের উৎসাহ ধরে রাখতে হবে। নতুবা ২০০৭ ও ২০০৮ সালে মতো চাল ক্রয়ের জন্য হন্যে হয়ে ঘুরতে হবে আন্তর্জাতিক বাজারে। কিন্তু প্রয়োজনীয় চাল সংগ্রহ করা হবে খুবই কঠিন। অবশ্য তা সত্ত্বেও বহুমুখী করতে হবে আমাদের কৃষিকে। গুরুত্ব দিতে হবে ধানবহির্ভূত শস্য খাতের এবং শস্যবহির্ভূত কৃষি খাতের ওপর। আমরা সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখেছি দেশে কৃষি বহুধাকরণ হচ্ছে। ধান চাষের জমি হ্রাস পাচ্ছে। বাড়ছে শাকসবজির জমি। পশুপাখির খামার ও মাছ চাষে উৎসাহিত হচ্ছে। কিন্তু তার গতি মন্থর। সেটা এগিয়ে চলছে তার নিজস্ব গতিতে। এক্ষেত্রে চাপ দিয়ে দ্রুত বহুধাকরণের ফলাফল দাঁড়াতে পারে কিলিয়ে কাঁঠাল পাকানো মতো।

খাদ্যশস্যের আমদানি ও রফতানি উভয় ক্ষেত্রেই আমাদের মুক্ত চিন্তা নিয়ে নীতি প্রণয়ন করতে হবে। চালের উৎপাদন কম হলে আমরা আমদানি করব। উদ্বৃত্ত হলে করব রফতানি। পরিস্থিতি ভালোভাবে বিশ্লেষণ করেই গ্রহণ করতে হবে এ নীতি। কোন গোষ্ঠী বা শ্রেণী বিশেষের চাপের পড়ে নয়। গত বছর আমাদের কৃষকদের প্রতিরক্ষণের কথা না ভেবে চালের আমদানি অবারিত করে আমরা ভুল করেছিলাম। তাতে উচ্চ মূল্যের বিদেশি চাল এসে বাজার সয়লাব করে দিয়েছে। এখন ধান বিক্রি করতে না পেরে পথে বসেছেন দেশের উৎপাদনকারী কৃষক। আবার ব্যবসায়ীদের চাপে বর্তমান নিম্নমুখী আন্তর্জাতিক বাজারমূল্যে চাল রফতানির দুয়ার উন্মুক্ত করে দিয়ে যেন ভবিষ্যতে আমাদের নিম্ন আয়ের ভোক্তাদের পথে না বসাই। প্রয়োজনে চাল রফতানি আমরা করতে পারি, কিন্তু তা হতে হবে খুবই সীমিত পরিমাণে। আন্তর্জাতিক বাজারে আমাদের তুলনামূলক সুবিধা বিবেচনা করেই নিতে হবে এ সিদ্ধান্ত (এ সম্পর্কে গত ১৮ মে দৈনিক সংবাদের উপ-সম্পাদকীয় কলামে প্রকাশিত আমার নিবন্ধটি দ্রষ্টব্য)। তার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো কৃষকদের নিকট থেকে সরাসরি ধান কেনা ও সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে চাল মজুদ করে রাখা। প্রয়োজনে এক্ষেত্রে চালকল মালিকও ব্যবসায়ীদের সহজ শর্তে ঋণ সুবিধা দিয়ে কৃষকদের নিকট থেকে ধান ক্রয়ে উদ্বুদ্ধ করা যেতে পারে। তাছাড়া এ মুহূর্ত থেকেই বন্ধ করতে হবে চাল আমদানি। শুল্ক হার দ্বিগুণ করতে হবে মিহি ও সুগন্ধি চাল আমদানির ওপর। তাতে প্রতিরক্ষা পাবে আমাদের কৃষকগণ।

কেউ কেউ বলছেন, সরকারিভাবে ধান ক্রয়ের মাধ্যমে এর মূল্য বাড়ানোর সুযোগ সরকারের হাতে নেই। অতি সহসা কৃষকের এ সমস্যার সমাধান সম্ভব নয় ইত্যাদি। এ ধরনের বক্তব্য খুবই অন্তঃসারশূন্য। এগুলো নন একাডেমিক কথা। এ ধরনের বক্তব্য খুবই হতাশ করে আমাকে। দেশব্যাপী কৃষকদের নিকট থেকে সরকার নির্ধারিত দামে ধান কেনা শুরু হলে এখনই তার ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বাজারে। ধান কেনার পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হলে এখনই চাঙ্গা হবে ধান-চালের বাজার। বোরো ধানের মৌসুম পেরিয়ে গেলে আরও বেড়ে যাবে ধান-চালের দর। ভর্তুকির মাধ্যমে গচ্চা দিয়ে চাল রফতানির জন্য অপেক্ষা করে থাকতে হবে না দেশের কৃষকদের।

বর্তমানে দেশে কৃষকের সময় ভালো যাচ্ছে না। মাঠে ভালো ধান হলেও বেশি উৎপাদন খরচের কারণে তিনি লাভের মুখ দেখছেন না। উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য না পেয়ে তিনি হতাশ। সে কারণে বিভিন্নভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছেন দেশের কৃষক সমাজ। তাদের দুঃখ ও ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। তাতে রাজনীতি থাকতে পারে, কারও কোন ইন্ধনও থাকতে পারে। অথবা স্বেচ্ছায়ই তারা প্রতিবাদ করছেন, এমনও হতে পারে। কিন্তু সত্য কথাটা এই যে কৃষকের আর্থিক অবস্থা এখন খারাপ। অতএব, তাদের আবেগ ও অনুভূতির প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়াই এখন একান্ত কাম্য। এর জন্য ইতিবাচক কর্মসূচি নেয়া দরকার, যাতে তাদের সমস্যার ত্বরিত সমাধান সম্ভব হয়। অতিকথন আর বিদ্রুপ ছড়িয়ে দিয়ে এ সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন এই নতুন রাস্তাটি পরিচালনা করছিলেন তখন আমাদের চরম খাদ্য সংকট ছিল। এ সংকট সমাধানের জন্য তিনি সার্বিক প্রচেষ্টা নিয়েছিলেন। তিনি প্রায়ই বলতেন, ‘আমার কৃষকের যেন কষ্ট না হয়’। তাদের কষ্ট লাঘবের জন্য এবং দেশকে খাদ্যে স্বয়ম্ভর করার জন্য তিনি অনেক ভর্তুকি দিয়ে অতি অল্প মূল্যে বিভিন্ন কৃষি উপকরণ বিতরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন। ইরি ধানের আবাদ সম্প্রসারণের জন্য দেশের বিভিন্ন স্থানে গভীর নলকূপ বসিয়ে দিয়েছিলেন নামমাত্র মূল্যে। ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা চিরতরে মাপ করে দিয়েছিলেন। এর প্রায় চার দশক পর আমরা এখন খাদ্যে অনেকটাই স্বয়ংসম্পূর্ণ। তাতে আওয়ামী লীগ সরকারের অবদান আছে অনেক। বিগত দশকে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে যুগান্তকারী উন্নয়ন সাধিত হয়েছে দেশের কৃষি খাতে। তিনি কৃষকদের সম্মান দিতে বলেছেন। আরও সমর্থন ও সহায়তা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন বিগত জাতীয় নির্বাচনের ম্যানুফেস্টোতে। তার এ নির্দেশনা ও প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন হলে দেশের কৃষকদের মুখে হাসি ফুটবে। তাদের হতাশা আর থাকবে না।

[লেখক : কৃষি অর্থনীতিবিদ ও সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ কৃষি অর্থনীতিবিদ সমিতি]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here