যুগ বদলিয়েছে।নিত্য পরিবর্তনের ধারায় পৃথিবী ক্রমঅগ্রসরমান।পৃথিবীর এই এগিয়ে চলাকে অগ্রাহ্য করা কোন শক্তির পক্ষেই সম্ভব নয়। এ বাস্তবতার পথ ধরেই মানুষ আজকের সভ্যতায় এসে পৌঁচেছে।
বাংলাদেশের ‘হুজুররা’ও (আলেম সমাজ বললাম না। কারণ যাদের কথা বলতে চাইছি তাদেরকে আলেম অভিহিত করতে চাই না) মনে হচ্ছে এই পরিবর্তনের ধারায় পা মিলিয়েছেন। তাদের ওয়াজের ধরন, ভাষা ইত্যাদি কোনটিই আর আগের মতো নেই। তারা এখন ওয়াজে ধর্মীয় বিষয়বস্তুর চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেন সমাজ ও রাজনীতির ওপর।
ছোট এক মফস্বল শহরে থাকতাম। খুব ঘন ঘন না হলেও মাঝে মাঝে সেখানে ওয়াজ মাহফিল হতো। এবং সেগুলিতে তাফসির করতেন বিশিষ্ট আলেম-ওলামারা। একবার ফুরফুরা শরীফের পীরও সেখানে ওয়াজ করতে এসেছিলেন। তাদের বক্তব্য ছিল মার্জিত, বক্তব্যে গভীরতা ছিল, ধর্মীয় ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ ছিল। রাজনীতি ছিল না, কারো বিরুদ্ধে কোন প্রচারণা বা ব্যক্তিগত বিদ্বেষের প্রকাশ ছিল না, কোন গীবৎ ছিল না।
সেই ধারা আজকের হুজুররা বদলে দিয়েছেন। নিশ্চয় তারা দেড় হাজার বছর আগের পুরনো ধর্মীয় ধারা থেকে সরে এসে যুগের সাথে তাল মিলিয়ে তাদের ওয়াজকে আধুনিকায়ণ করেছেন। যে মাইক ব্যবহারের বিরুদ্ধে তাদের পূর্বসূরি হুজুররা সোচ্চার ছিলেন, আমাদের সেই শহরের তখনকার একমাত্র মসজিদে মাইকে আজান চালুর বিরোধিতা করেছেন, সেই মাইকই এখন এই হুজুরদের সদা সঙ্গী। যারা বরাবর ছিলেন ছবি তোলার বিরোধী, ক্যামেরা দেখলেই তেডে আসতেন(মনে আছে বিগত ষাটের দশকের মাঝামাঝি টঙ্গীর তাবলীগ এজতেমায় ছবি তুলতে গেলে আলোকচিত্র সাংবাদিকের ক্যামেরা কেড়ে নিয়ে ভেঙে ফেলা হয়েছিল), সেই তারাই এখন ক্যামেরার সামনে সপ্রতিভ। তারা এখন যে শুধু ছবি তুলতেই ব্যগ্র তা নয়, তারা ভিডিওতেও নিজেদের জাহির করেন এবং সেগুলি সামাজিক মাধ্যমে ছেড়ে নিজেদের প্রচার দেন।
আধুনিকায়ণ হয়েছে তাদের ওয়াজেও। ভাষা বদলে গেছে, বলার ধরন বদলে গেছে, বিষয়বস্তু বদলে গেছে। বদলে গেছে তাদের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ। তাদের বক্তব্যে থাকে সমকালীন সমাজ-সামাজিকতা নিয়ে শ্লেষাত্মক কথাবার্তা, কোন কোন সময় যা হয়ে ওঠে নিম্ন রুচির, যাকে অশ্লীলতার পর্যায়েও ফেলা যায়, থাকে রাজনীতি। বলা যায়, তারা ওয়াজ মহফিলকে ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য থেকে সরিয়ে এনে পরিণত করেছেন বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানে।
এ ধারার প্রচলন মনে হয় করে গেছেন দেলোয়ার হোসেন সাঈদী। তিনি তার ওয়াজে সত্য-মিথ্যা এবং অশ্লীল ভাষায় অশ্লীল বিষয়বস্তুর ভিয়েন দিতেন। দূর পাল্লার বাস যাত্রায় একবার ক্যাসেটে তার এক ওয়াজ শোনার দুর্ভাগ্য আমার হয়েছিল। বাস চালকের চালিয়ে দেয়া এই ক্যাসেটে সাইদী রসিয়ে রসিয়ে বলছিলেন, ‘এই যে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঝোপের আড়ালে বসে ছেলেমেয়েরা কি করে? বলেন কি করে? বলেন নাউজুবিল্লাহ।’
অনেক্ষণ সহ্য করে ছিলাম। কিন্তু যখন দেখলাম আমার পাশের আসনে দুই উঠতি বয়সী মেয়েকে নিয়ে এক মা দারুণ অস্বস্তিতে আছেন, মেয়ে দুটি না শোনার ভান করে জানালার বাইরে তাকিয়ে আছে, তখন চিৎকার করে ড্রাইভারকে বলেছিলাম ক্যাসেট বন্ধ করতে। অবাক হয়ে দেখেছিলাম সাথে সাথে আরো অনেকেই ক্যাসেট বন্ধ করতে সোচ্চার হয়েছিলেন।
মনে হয় সাঈদীর সেই বিনোদনমূলক রগরগে ওয়াজের ধারাই আজকের হুজুররা অনুসরণ করে চলেছেন।
লেখক: প্রধান সম্পাদক, সাপ্তাহিক আজকাল, নিউইয়র্ক