প্রতিটি ঘটনারই ভিডিও ছড়িয়ে পড়ুক সামাজিক মাধ্যমে

0
112

শওগাত আলী সাগর:

১.’প্রকাশ্য রাস্তায় স্বামীকে কুপাচ্ছে কয়েক সন্ত্রাসী, স্ত্রী প্রাণপনে তাঁকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে’- বরগুনার যে মানুষগুলো এই দৃশ্যের ভিডিও করেছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়েছে- আমি তাদের বাহবা দেই, অভিনন্দন জানাই। কেন জানেন?- এই যে আমি আপনি, সবাই মিলে বরগুনার ঘটনা নিয়ে এতোটা উতালা হয়ে পড়েছি, তার কারণ কিন্তু ওই ভিডিও। ওই ভিডিওটা আছে বলেই- আমাদের আবেগ এতোটা টগবগ করে উঠতে পেরেছে। এতো মানুষ এ নিয়ে কথা বলছে, প্রতিবাদ হচ্ছে। ভিডিওটা না থাকলে এই হত্যাকাণ্ড এতোটা মনোযোগ পেতো না।

আমি বিশ্বাস করি, যারা ভিডিওটা করেছেন, তারা আমাদের মানসিকতার এই দিকটা ভালো ভাবেই জানেন। ‘এই খুনের কোনো বিচার হবে না, কিছুই হবে না’- এমন একটা ধারণা তাদের মধ্যেও ছিলো বলেই হয়তো তারা চেয়েছেন- জগৎ দেখুক, মানুষ দেখুক- কি নৃশংসতা ঘটে এই বাংলাদেশে।

এই জন্যে ভিডিও ধারণ কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দেয়ার বিরোধীতা করি না আমি। বরং বলি, নিজেকে বাাঁচিয়ে এই ধরনের ঘটনার ভিডিও করুন, যতো বেশি সম্ভব ছড়িয়ে দিন। কে জানে, এই সব দেখতে দেখতেই হয়তো বা একদিন আমরা নিজের মুখোমুখি হয়ে নিজেকে প্রশ্ন করবো- কোন যোগ্যতায় আমরা আমাদের মানুষ বলে বিবেচনা করি?
২. রিফাতকে কুপানোর সময় যারা রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিলেন- তাদের কেন সমালোচনা করছেন আপনি? তারা কারা তা তো আপনি আমি কেউ জানি না। আলী রিয়াজই তো সম্ভবত নিজেদের ছাত্র রাজনীতির সময়কার সহিংসতার অভিজ্ঞতা থেকে বলেছেন, এই ধরনের ঘটনার সময় আশপাশে নিজেদের লোক থাকে। অপারেশনের প্ল্যানের অংশ হিসেবেই তারা থাকে। যেমন রাস্তায় পকেটমারদের লোকজনও আশপাশে থাকে। পকেটমার ধরা পড়ে গেলে তাদের সঙ্গীরাই প্রথম পিটুনি দিতে শুরু করে। এটি করে তারা ধরে পড়ে যাওয়া পকেটমারকে বাঁচিয়ে দিতে।

রাস্তার মানুষগুলো যদি সন্ত্রাসীদের সঙ্গী না ও হয়, তাতেই বা কি? আমরা কি কোনো ধরনের প্রতিবাদকেই ভালোভাবে নেই? যে কোনো ধরনের প্রতিবাদের ব্যাপারেই তো আমাদের এক ধরনের এলার্জি আছে। যারা প্রতিবাদ করবেন- তাদের তো ভবিষ্যতের কথা, নিজ পরিবারের কথাও ভাবতে হয়। প্রকাশ্য দিবালোকে যখন কেউ কাউকে কুপিয়ে মারতে শুরু করে- তার ক্ষমতার উৎস নিয়েও তো মানুষের মনে প্রথম প্রশ্ন জাগে।

৩. বরগুনার সন্ত্রাসীর ক্ষমতার যে একটা উৎস আছে, তা তো জানিয়ে দিয়েছেন সেখানকার ওসি আবির মোহাম্মদ হোসেন। একটি সংবাদ মাধ্যমের খবরে পড়লাম- তিনি সাংবাদিককে ‘দ্বিমুখী প্রেমের’ গল্প শোনাচ্ছেন। থানার ওসি আইন শৃংখলা রক্ষীবাহিনীর লোক। এই মামলার তদন্ত এবং প্রমাণাদি সংগ্রহ তিনি করবেন। খুনটা কি কারণে হয়েছে- সেটা তো অধিকতর তদন্তের ব্যাপার। ঘটনাটা ‘দ্বিমুখী প্রেমের’ না কি প্রেম করতে চাওয়া বখাটের’ জিঘাংসা – এগুলো তো তদন্তের ব্যাপার। এতো তাড়াতাড়ি থানার ওসি কিভাবে মিডিয়াকে দ্বিমুখী প্রেমের গল্প শোনান? তার কারণ কি সন্ত্রাসীর ক্ষমতার উৎস? ফেনীতে যেমন ওসি মোয়াজ্জেম আত্মহত্যার গল্প শুনিয়েছিলেন, বরগুনায়ও কি ওসি আবির মোহাম্মদ ‘দ্বিমুখী প্রেমের’ গল্প শুনিয়েছেন একই কারণে? তাহলে ঘটনাটি কি বরগুনা থানা জানতো? ওসি আবির মোহাম্মদ জানতো?

৪. বরগুনার ঘটনা নিয়ে কতো কি প্রশ্ন যে করার আছে? কিন্তু কি লাভ? রিফাত নামের ছেলেটা, যে কী না মাত্র কিছুদিন আগেই নতুন জীবন শুরু করেছিলো-সে তো সব কিছুরই বাইরে। রিফাতের স্ত্রী- যে প্রাণপণে নিজের স্বামীকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছে, সন্ত্রাসীর কোপের মুখেও স্বামীকে রক্ষার চেষ্টা করে, শেষ পর্যন্ত একা লড়াই করে হেরে গেছে, তার কথাটা কি আমরা ভাবতে পারি? তার মনের ভেতর কি প্রচন্ড চাপ পড়েছে, বাকি জীবনটা তার বীভৎস দুঃস্বপ্ন নিয়ে বাঁচতে হবে- সে সবও কিন্তু ভাবনার বিষয়।

৫. ‘দিনে দুপুরে যে কাউকে কুপিয়ে মেরে ফেলা যায়, কিচ্ছুই হয় না’- এমন একটা বার্তা কি আমরা সন্ত্রাসীদের, দুর্বৃত্তদের দিয়ে রেখেছি? রাষ্ট্রের চরিত্র, সক্ষমতা কিংবা রাষ্ট্রের অগ্রাধিকারের বিষয়কে এর সাথে মিলিয়ে আলোচনা না করলে আমরা কেবল প্রলাপই বকতে পারবো। জনগণ কিংবা জনগণের নিরাপত্তা যদি রাষ্ট্রের অগ্রাধিকারের মধ্যে না থাকে তাহলে এই ধরনের ঘটনা তো ঘটতেই থাকবে। তাই বলি, প্রতিটি ঘটনারই ভিডিও হোক, সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ুক।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here