জাহান রিমা:
আমার অ্যারেঞ্জড ম্যারেজ। তাই মন থেকে শরীর নয়; আকর্ষিক শরীর থেকে মনে পৌঁছানোর চ্যালেঞ্জিং পোশাক পরতে হয়েছিল আমাকে। বিয়ের আগে আমাদের পরস্পরকে জানার সময় ছিলো মাত্র ১৭দিন । এই ১৭দিনের কোনো একদিন…
এই ১৭ দিনের কোনো একদিন আমি আমার হবু বরের সঙ্গে কথা বলার কোনো একপর্যায়ে বলেছিলাম, তোমার প্রিয় ফুল কী? প্রিয় গাছ কী? প্রিয় মানুষ কে? প্রিয় রং কী? প্রিয় সময় কোনটা? অপ্রিয় বিষয়বস্তু কী? এই-সেই শত প্রশ্ন। সে দ্বিধান্বিত। আমার কোনো প্রশ্নেরই তাৎক্ষণিক উত্তর করতে পারছিল না। তখন হতাশ হওয়ার মতো জ্ঞান আমার ছিল না। তবে কিছুটা অবাক হয়েছি।
এদিকে পোস্ট অফিসের পোস্টমাস্টারের সঙ্গে আমার রিলেশান সেই ছোটবেলা থেকে। সময় খুব কম, এর মাঝে কিছু একটা ঘটাতে হবে। তাই বুদ্ধি করলাম আমার আজন্ম সহযোগী, আমার জমজ বোন রিপার সঙ্গে। রিপা আমাকে সব ধরনের সহায়তা দিতে এক পায়ে খাড়া। পারলে অন্যের পাও ভেঙে দেয়, যদি এসবে হস্তক্ষেপ করে! আমি বিয়ের কন্যা। আম্মুর সম্পূর্ণ নিষেধ এই সময়ে বাইরে যাওয়া। আম্মুর ভয়, কে জানি বলেছে মেয়ে নাকি কালো! যদি…
যা-ই হোক, সারা রাত নির্ঘুম থেকে আমি চিঠি লিখলাম। কার্ড বানালাম। নিজে এসব করে নিজেই খুশি৷ ইস! কী সুন্দর হয়েছে সব। আমার বর নিশ্চয় খুব খুশি হবে।
ওদের বাসা ছিল আমাদের বাসার ঠিক পাঁচ মিনিটের দূরত্বে। চাইলে হেঁটে গিয়ে বাসার নিচের দারোয়ানকে এসব দিয়ে আসা যায়। ২০ মিনিটের মাথায় যা সে হাতে পাবে। আমি এক পাগল, তার সঙ্গে আছে আরেক পাগল, রিপা। তাই এই পাঁচ মিনিটের দূরত্বকে কাঁচকলা দেখিয়ে ওদের বাসার সামনে দিয়েই ছয় মাইল দূরত্বের পোস্ট অফিসে গিয়ে রিপা ওসব পোস্ট করে এল।
যা যেতে সময় লাগবে তিন দিন! তাতে কি৷
পোস্ট অফিসের পোস্টমাস্টার যখন দরজা নক করে বলবে, আপনার চিঠি এসেছে। নিশ্চয়ই সে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলবে, আমার কোনো প্রেমিকা নাই! কিংবা স্মরণ করবে কাউকে যাকে আমি জানি না!
এসব কাণ্ড করে পরের তিন দিন ওর প্রতিটা কলে আমি হুমড়ি খেয়ে পড়েছি। কতবার কল্পনা করেছি, ফোনের অপর প্রান্ত থেকে আমার বর বলছে, এইরে… কী করেছ তুমি? পাগলি একটা
তবু সান্ত্বনা এই; এই যে প্রতীক্ষা, এ-ও তো সুখের।
আমার ফোন ছিল না তখন। আম্মুর ফোনে কল করে আমার বর আমার সঙ্গে কথা বলত। অবশেষে প্রতীক্ষিত সেই কল এলও। পাশ থেকে সে বলল, তুমি লিখেছ তাই না? কার্ড আছে, তাতে তোমার বিয়েতে আমাকে দাওয়াত! জানো, কি যে লজ্জা পেয়েছি। আম্মা ছিল, তোমার হবু দেবর-ননদ সবাই ছিল। আমি তো প্রথমে ভয় পেয়ে গেছি, ভেবেছি আমেরিকান অ্যাম্বাসি থেকে বোধ হয়! লজ্জা? লজ্জা পেয়েছ তুমি? এই কথা শুনে এদিকের আমি কিছুটা নিষ্প্রভ। এবার আমি অনুমান করতে পারি, ওর জগৎ আমার জগৎ আলাদা। ও এমন পাগলামির সঙ্গে পরিচিত নয়। কীভাবেই বা থাকবে আমাদের যে অ্যারেঞ্জড ম্যারেজ।
আরও কিছু দিন পরে আমার বর বলল, তোমার জন্য একটা মোবাইল পাঠাই? এখন? তখনো আমাদের বিয়ে হয়নি।
আমি স্ট্রেইট বললাম, না। সন্ধ্যায় আম্মু-আব্বুকে বলি, আপনাদের হবু জামাই আজকে আমাকে বলেছিল, মোবাইল পাঠাতে চায়। আমি বলেছি, না। আম্মু-আব্বু দুজন দুজনের দিকে তাকাল। তারপর বলল, কেন না করলে? আমার উত্তর ছিল, আমার ব্যক্তিত্বে লাগে, আমি যেমন, তেমন করেই আমার সঙ্গে কথা বলুক। এরপর আব্বু-আম্মু আমাকে কাছে টেনে, কপালে চুমু দিয়ে বলল, হ্যাঁ, এইত আমাদের মেয়ে।
এভাবে ১৭ দিন শেষ। আমাদের বিয়ে হলো।
বিয়ের দুই মাস পর ওর দেশের বাইরে যাওয়ার সময়ও হয়ে গেল।
যে রাতে সে চলে যায়, সেই রাতে আমি পাগলের মতো কাঁদি। আমার বরও কাঁদে। বিদায় দেওয়ার ১০ মিনিট আগে আমি ওকে রুমের বাইরে রেখে দরজার খিল আটকে দিই। ২০ মিনিট পর দরজা খুলে দিই। কোনো কৈফিয়ত দিইনি। আমার বরও তা চায়নি। প্রথমবারের মতো এটুকু মিল কি আমার চোখে পড়ল? কী জানি।
তারপর আবার প্রতীক্ষা।
আটলান্টিক মহাসাগরে ও যখন উড়ছে, তখন আমার বালিশই যেন আটলান্টিক সাগরে পরিণত। এত কান্না করেছি!
দেড় দিন পর ওর কল। বিমান থেকে নেমেই কল দিয়েছে। আমি বেসামাল। পৃথিবী ভেঙে একটা প্রশ্ন আসছিল, কখন আসবা? কিন্তু করিনি। সেও বলেনি। এই মিলটার সঙ্গে ওই দরজা বন্ধের মিলটার পার্থক্য আছে কি? কী জানি।
তখন আমার মনে আরেকটা কারণে উতলা ছিল, আরেকটা প্রশ্ন ছিল, তা-ও বলিনি। এসব যে বলব না বিয়ের আগের সেই নিষ্প্রভ ক্ষণটাই আমাকে বাতলে দিয়েছিল। এবার আমরা দুজন সাত সমুদ্র দূরে। সে আমেরিকা পৌঁছে গেছে, আমি বাংলাদেশে। ফোনের এক প্রান্তে সে, অপর প্রান্তে আমি। কথা বলছিলাম।
তারপর ফোন রেখে আমার বর এয়ারপোর্ট থেকে বাসায় ফেরার জন্য রওনা দিল। ট্যাক্সি নিল। পৌঁছে ট্যাক্সির বিল দেওয়ার আগেই আবার আমাকে কল করে বসল। ভাবলাম, বিল কত দেবে সেটা আমাকে জিজ্ঞাস করবে নাকি!
নাহ; তা তো নয়। হ্যাঁ; এই কলটাই আমি চাচ্ছিলাম। ওই পাশ থেকে আমার বর কথা বলছে, ওর কণ্ঠে বিস্ময়।
কী করেছ তুমি? আমি মানি ব্যাগ খুলে বিল দিতে গিয়ে দেখি ওখানে তুমি! তোমার চিঠি! এমন কেউ করে…এমন লিখে কেউ?
আমি নিজের যত্ন নেব; নিশ্চয়ই নেব। তোমার জন্যই যে আমার নিজেকে ভালো রাখতে হবে।
তারপর দিন যায়, কখনো সময়ে, কখনো অসময়ে সুযোগ পেলেই সে দেশে ছুটে যায়। আমার জন্য! আস্তে আস্তে আমাদের বোঝাপড়া বাড়তে থাকে, আর বাড়তে থাকে চিঠির সংখ্যা। এভাবেই দুই এক বছর পরে আমরা পার্মানেন্টলি একসঙ্গে থাকতে শুরু করি, ফ্লোরিডায়। আমরা দুজনে একসঙ্গে থাকছি প্রায় এক যুগ। এগারো বছর রানিং।আমরা ম্যাচিং যুগল না, কনট্রাস্ট যুগল। আমার ভালো লাগে যে গান; ওর তা না। আমি সাহিত্য পছন্দ করি, সে রাজনীতি। তবু আমাদের আশপাশে থাকা মানুষগুলোর ভ্রম হয়। তারা ভাবে আমাদের সবই বুঝি এক! তাই এত সুখী। আমাদের কখনো ঝগড়া হয় না বুঝি!
এক রাতে তাদেরই একজন; আমার বান্ধবী রায়া কল দিয়েছে। পাশে আমার বর। রায়া কী যেন কথা বলবে, জরুরি। আমি কিছু বলার আগেই আমার বর অন্য রুমে চলে যায়। সে জানে এটুকু আমার বান্ধবীর প্রাইভেসি। আমাদের কথা বলতে দিয়ে সে প্রমাণ করে যায়, প্রতিটা মানুষের থাকা উচিত একান্ততা ব্যক্তিস্বাধীনতা। আমার ভালো লাগে।
আমার বান্ধবী রায়া জানতে চায়, ওদের জামাই-বউয়ের সব পছন্দ-অপছন্দ নাকি এক ছিল। তা বিয়ের আগে। তাই তো একসঙ্গে ঘর বাঁধা। কিন্তু কেন যেন হচ্ছে না…, কেন?
আমি বলি, ম্যাচিং থ্রি পিসের সালোয়ার, ওড়না আর জামা কখনো কি মিলতে দেখেছিস? কাছাকাছি হয়তো যায়, কিন্তু তিন রং কখনোই এক হয় না। সুতার জামার কাপড়ের গোলাপি রং শিপন ওড়নাই একটু ভিন্ন থাকে। সালোয়ারে থাকে আরেকটু ভিন্ন। কিন্তু দেখ, বুদ্ধি করে কনট্রাস্ট করে একটা জামা পরলে তা কত অ্যাট্রাক্টিভ হয়। সাদা আর নীলের কম্বিনেশন কেমন টানে? কিংবা মাটি রঙের সঙ্গে লাল? মেজেন্ডার সঙ্গে বেগুনি? খুব দারুণ না? আমরা তেমন যুগল। আমাদের অনেক কিছুই মিল না। তবু আমরা ভীষণ সুখী। কেননা এই কনট্রাস্ট করার জন্য যে প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়, তার নাম সময়, বোঝাপড়া, পরস্পরের পছন্দকে পরস্পর শ্রদ্ধা করার মানসিকতা এবং ভালোবাসার মানুষের ভালোবাসার বিষয়কে সহায়তা না করতে পারুক কিন্তু অসহায়তা না করা। আমরা ভালোবাসার ফুল নিইনি কিন্তু বীজ রোপণ করেছি! আমরা ভালোবাসা তৈরি করিনি, এসবই সৃষ্টি করছে একটু একটু করে দৃঢ় ভালোবাসা।
এরপর রাত গভীর হয়। রায়া ফোন রেখে দেয়। আর আমি সেটুকু লিখব বলে হঠাৎ লিখতে বসি। মাথায় সমস্যা! ওই যে রিপা আর আমার পাগলামির ভাব আছে! আমার পাশে আমার প্রিয়তম যত্ন আর ভালোবাসা নিয়ে অপেক্ষা করে। বলে, কিছু কী লিখছ? আচ্ছা, লেখাটা শেষ করো! তুমি লিখো যত্ন করে…এই তো আমি আছি। ওর এটুকু কথায় প্রশান্তিতে আমার শব্দরা ঝলমলিয়ে ওঠে! তারপর আমি লেখাটা পোস্ট বাটনে ক্লিক করি। এরপর আমাদের রুমের বাতি নিভে যায়..তার খুব হিংসা!
এভাবেই রাত বাড়ে। আর বাড়ে বিয়ের আগে থাকা দুইটা অচেনা দ্বীপের আরও চেনাচেনি! মধ্যখানে জেগে ওঠে ভালোবাসার চর! গাঢ় হয় রাত, গাঢ় হয় দ্বীপের রানির কণ্ঠ!
আবেগী দ্বীপের রানি তার বরের চুলে বিলি কেটে বলে, তুমি এত ভালো কেন? দ্বীপের রাজা বলে, তোমার জন্য দিন দিন এত আদর লাগে কেন!? রানি অভিমানী ঢঙে বলে, কখনো চিঠি তো লিখোনি! রাজা বলে, পারি না তো! আচ্ছা তোমার সব চিঠিতে তোমার একটা ঘ্রাণ মেশানো থাকত, কী করে সেই ঘ্রাণ আনতে বলো তো? রানি বলে, উহু…সবকিছু জানতে নেই! যেমন তোমার আর আমার গানের পছন্দ ভিন্ন। কিন্তু কেমন করে আমার প্রিয় সব গান দিয়ে প্রতিদিন ঘুম ভাঙাও তুমি, বলো তো?
দ্বীপের রাজা বলে, উহু… সবকিছু জানতে নেই!