সাইয়েদা আক্তার
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে জনসমাগম ঠেকাতে ৬ষ্ঠবারের মত সরকার ঘোষিত সাধারণ ছুটির মেয়াদ বাড়ানো হচ্ছে। সংক্রমণ ঠেকাতে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করার জন্য বাংলাদেশে সাধারণ ছুটি চলছে গত ২৬শে মার্চ থেকে।
সাধারণ ছুটি চলার মধ্যেই পোশাক কারখানা, ট্যানারি, প্যাকেজিং, সিমেন্ট এবং জুতাসহ বিভিন্ন ধরনের কারখানায় গত কয়েকদিনে আংশিক বা পুরোদমে উৎপাদন শুরু হয়েছে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় বলছে, বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের হার বাড়তে থাকায় সংক্রমণ রোধে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করার জন্য সাধারণ ছুটির মেয়াদ আগামী ১৭ই মে পর্যন্ত বাড়ানোর একটি প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়েছে।
জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেছেন, অনুমোদন পেলে সোমবার এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে।
“এখন যেহেতু সংক্রমণের সংখ্যা বাড়ছে, এবং বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে এ মাসটি ঝুঁকিপূর্ণ, সেজন্য মানুষকে ঘরে রাখার জন্য এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখার জন্য সাধারণ ছুটি বাড়ানোর সুপারিশ করে একটি প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হয়েছে।”
এক্ষেত্রে সরকারকে স্বাস্থ্য ঝুঁকির সাথে সাথে দেশের অর্থনৈতিক ক্ষতির বিষয়টিও বিবেচনা করতে হচ্ছে বলে জানিয়েছেন প্রতিমন্ত্রী মি. হোসেন।
তবে, শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতের পর কারখানা খোলার নির্দেশনা থাকলেও এখন কোন ধরণের প্রতিষ্ঠান খোলা যাবে আর কোনটি বন্ধ থাকবে এমন কোন নির্দেশনা সরকারের পক্ষ থেকে দেয়া হয়নি।
যদিও এ সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে সুপারিশ পাঠানো হয়েছে।
মি. হোসেন বলেছেন, “আন্তঃজেলা চলাচলের ওপর যে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে এখন, তা বহাল থাকবে। কিন্তু বাস মালিক ও শ্রমিকদের আবেদন করছে, বিক্ষোভ করেছে গণপরিবহন চালু করার জন্য।
তারা বলছে, আর বসে থাকা যাচ্ছে না। কিন্তু এটা এখন করতে দেয়া ঠিক হবে না। তবে এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী সিদ্ধান্ত নেবেন, কোন খাতে কতটা কী করা যাবে।”
জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, কারখানা খুললেও যেন ধাপে ধাপে এবং সব শ্রমিক নিয়ে একসঙ্গে না খুলে আংশিকভাবে কাজ করা যায়, মালিকদের সঙ্গে এমন আলোচনা করা হচ্ছে।
একই সঙ্গে বয়স্ক কর্মীদের ব্যাপারে বাড়তি স্বাস্থ্য সতর্কতার ব্যবস্থা রাখারও পরামর্শ দেয়া হয়েছে সবাইকে।
কারখানা খুলছে
সাধারণ ছুটির মধ্যেই ইতিমধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল, ট্যানারি, সিমেন্ট, প্যাকেজিং ও জুতাসহ বিভিন্ন ধরনের কারখানায় আংশিক বা পুরোদমে উৎপাদন শুরু হয়েছে।
এর আগে ২৩ শে এপ্রিল জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এক প্রজ্ঞাপনে জানিয়েছিল, শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করে কর্তৃপক্ষ চাইলে কারখানা চালু রাখতে পারবে।
এরপর ২৬ শে এপ্রিল থেকে এক হাজারের মত পোশাক কারখানা চালু হয়।
ইতিমধ্যেই দোকানপাটে মানুষ আগের চেয়ে বেশী সময় ধরে কেনাকাটা করতে পারছেন।
সেই সঙ্গে কিছু মন্ত্রণালয় এবং আদালতের কার্যক্রম সীমিতভাবে চালু করার সিদ্ধান্ত নেয়া হলেও পরে অবশ্য তা বাতিল করা হয়েছে।
এদিকে, রাষ্ট্রায়ত্ত এবং বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো এ সপ্তাহের শেষ দিকে কার্যক্রম পুরোদমে শুরু করার জন্য কর্মীদের চিঠি দিয়েছে।
ইতিমধ্যে চালু হয়েছে কাঁচামালবাহী তিনটি লাগেজ ট্রেন।
এছাড়া আগামী পাঁচই মে থেকে আন্তঃনগর ট্রেন চলাচলের ব্যাপারেও আলোচনা চলছে বলে জানা গেছে।
সাভারের হেমায়েতপুরের ট্যানারি শিল্প এলাকায় আংশিকভাবে কারখানা চালু হয়েছে, সেখানকার শ্রমিকেরা বলছেন, করোনাভাইরাসের স্বাস্থ্য ঝুঁকি নিয়ে উদ্বেগ থাকলেও এখন চাকরি টিকিয়ে রাখার স্বার্থে তারা কাজে এসেছেন।
একজন নারী শ্রমিক বলেছেন, “আমাদের ফোন করে আসতে বলছে, বলছে প্রোডাকশন শুরু হইতেছে, সবাইকে নিয়ে আসতে। আমরা আপত্তি করি নাই, কারণ তাইলে কোম্পানি আমাদের সাথে ঝামেলা করতো।”
আরেকজন শ্রমিক বলেছেন, “যারা সিদ্ধান্ত নেয়, তারা একেক সময় একেক কথা বলে একবার বলে সাধারণ ছুটি কারখানা চলবে না, আবার বলে কারখানা খোলা, আসো। এখন আমরা আসছি সামাজিক দূরত্ব কিভাবে করবো? আমি থাকি ১২ফুট বাই ১০ একটা ঘরে, সেখানে পাঁচজন মিলে থাকি।
সরকার যে তিন ফুট দূরে থাকতে বলছে, সেটা এই ঘরে কেমনে করবো?”
জনসমাগম বাড়লে ঝুঁকি কী বাড়বে?
সরকার যখন একদিকে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে জনসমাগম কমাতে চাইছে, সেই সময় কলকারখানা এবং অফিস-আদালত খোলার সিদ্ধান্ত নেয়া হলে, ঝুঁকি বহুগুণ বেড়ে যেতে পারে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজের ভাইরোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক সাবেরা গুলনাহার বলছেন, এখন পর্যন্ত যেহেতু আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে, সেটা থামাতে হলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ মত সতর্কতা নেয়াই একমাত্র উপায়।
তিনি মনে করেন পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাবে, বিশেষ করে মে মাসটিকে যখন খুবই ঝুঁকিপূর্ণ বলা হচ্ছে, তখন লকডাউন পরিস্থিতি শিথিল করার সুযোগ নেই।
“এখন সংক্রমণ জ্যামিতিক হারে বাড়বে। কিন্তু কারখানা খোলা হলে লোকজন যত বাড়বে, বিশেষ করে ঢাকায় তো সংক্রমণ সবচেয়ে বেশি, সে কারণে ঝুঁকিও বাড়বে। এছাড়া যারা ঢাকায় যাবে, তারা আবার গ্রামে ফিরবে ঈদ করতে, সুতরাং ঝুঁকি তখন ছড়িয়ে পড়বে।”
অধ্যাপক গুলনাহারের পরামর্শ এখন কারখানা আংশিকভাবে খোলাও উচিত হবে না। তিনি মনে করেন, সরকার যে লকডাউন করেছিল সেটা অনেক ক্ষেত্রেই ভালভাবে কার্যকর করা যায়নি। “ভালভাবে করা গেলে সংক্রমণ প্রতিরোধের কাজটি আরো কার্যকর হত।”
সৌজন্যে: বিবিসি বাংলা, ঢাকা