পুলিশ, তুমি বন্ধু হয়েই থাকো

0
89

নিশাত সুলতানা:
অনেক শিশুর মতো আমিও পুলিশ সম্পর্কে কৌতূহলী হই শৈশবেই। দারুণ পরিপাটি তখনকার খাকি পোশাকে সজ্জিত কোনো পুলিশ দেখলে অপলক তাকিয়ে থাকতাম। তবে পুলিশের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে আমার শিশুমন প্রথম ধারণা লাভ করে বাংলা চলচ্চিত্রের মাধ্যমে। সেখানে সব সময় শেষ দৃশ্যে আবির্ভূত হতো একদল পুলিশ। নায়কের উত্তম-মধ্যমে নাজেহাল কুচক্রী দলকে উদ্ধার করত তারা। সঙ্গে নিশ্চিতভাবে থাকত একটি সংলাপ, ‘আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না।’ বাস্তব জীবনেও পুলিশের আবির্ভাব ঘটেছিল অনেকটা একইভাবে। আমি তখন অনেক ছোট। বাসার সবকিছু ডাকাতেরা লুট করে নিয়ে যাওয়ার পর পুলিশ এসেছিল। বেশ কয়েক মাস তদন্তের পর ভাটা পড়ে পুলিশের তৎপরতায়। ধরা পড়ে না কোনো ডাকাত। প্রথম অভিজ্ঞতাতেই তাই পুলিশের কর্মদক্ষতা নিয়ে সন্দেহ জেগেছিল আমার শিশুমনে। পরবর্তী সময়ে সেই ধারণার আর তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি।

পুলিশ সম্পর্কে যে খবরগুলো আমরা পাই, তার অধিকাংশই নেতিবাচক। পুলিশের ক্ষেত্রে প্রায়শই নেতিবাচক বিশেষণই বেশি ব্যবহৃত হয়। ভালো কাজ স্বাভাবিকভাবে নেওয়া হয়, কথা হয় কেবল খারাপ কাজগুলো নিয়ে। ওই সব বিশেষণ এমনভাবে আমাদের তাড়িত করে যে আমরা অনেকেই পুলিশের প্রতি আস্থাশীল হতে পারি না, এড়িয়ে চলি পুলিশকে। তাদের প্রশংসনীয় কাজগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ঢাকা পড়ে গেছে দুর্নীতির আড়ালে।

করোনা পরিস্থিতি সারা বিশ্বকেই বিভিন্ন বিষয়ে নতুনভাবে ভাবিয়েছে, নতুন পথ দেখিয়েছে। লকডাউন শুরুর দিনগুলোতে পুলিশের কর্মতৎপরতা নতুনভাবে দেখার সুযোগ পায় বাংলাদেশের মানুষ। সম্ভবত এই প্রথম পুলিশ বাহিনীর দেশ ও জাতিকে সেবা করার ইচ্ছার বিষয়টি প্রবলভাবে অনুভূত হয়, যা পুরো জাতিকেই নতুনভাবে নাড়া দেয়। আমরা নতুনভাবে চিনতে শুরু করি পুলিশকে। এই জোয়ারে ভেসে যায় পুলিশ নিয়ে মানুষের মনে তৈরি হওয়া এত দিনের ক্ষোভ ও অনাস্থা। করোনা লকডাউনের তুমুল দুঃসময়ে অসহায় মানুষ তাঁদের পাশে পুলিশকে খুঁজে পান মাস্ক, হ্যান্ড স্যানিটাইজার কিংবা খাবারের প্যাকেট হাতে। তাঁদের কেউবা রাতের আঁধারে ক্ষুধার্ত মানুষকে খাবার পৌঁছে দিয়েছেন, আবার কেউবা অসহায় মায়ের অসুস্থ সন্তানকে পৌঁছে দিয়েছেন হাসপাতালে কিংবা প্রসববেদনায় কাতর নারীকে সন্তান জন্মদানে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন, করোনা সংক্রমণে মৃত ব্যক্তির সৎকার করেছেন। এই কাজ করতে গিয়ে হাজারের ওপরে পুলিশ সদস্য করোনায় সংক্রমিত হয়েছেন, মারা গেছেন পুলিশ বাহিনীর বেশ কজন সদস্য। চিকিৎসকদের পাশাপাশি তাঁদের এই অবদান এই সময়ে বিরাট গুরুত্ব বহন করে।

করোনাকালে পুলিশের তৎপরতা আমাদের নতুনভাবে ভাবিয়েছে পুলিশের সক্ষমতা ও সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে। পুলিশের সক্ষমতা নিয়ে একদিকে যেমন আমাদের নতুন প্রত্যাশার মানদণ্ড তৈরি হয়েছে, ঠিক একইভাবে পুলিশের নানা অসহায়ত্ব ও সীমাবদ্ধতা আমাদের ভাবিয়েছে। আমরা জানতে পেরেছি পুলিশের দৈন্যদশার কথা। আমরা শুনেছি জনগণকে নিরাপদ আশ্রয়ে পাঠিয়ে ব্যারাকের মেসে অবস্থান করা পুলিশের বিমর্ষ পিতৃ হৃদয়ের আকুতি।

লকডাউন এরই মধ্যে ঢিলেঢালা হয়ে গেছে। হয়তো পরিস্থিতির পরিবর্তন হবে অচিরেই। কিন্তু আমরা চাই, করোনা-পরবর্তী পৃথিবীতেও বাংলাদেশ পুলিশ নতুনভাবে পথ চলুক মাথা উঁচু করে। সূচনা হোক বাংলাদেশ পুলিশের গর্বিত পথচলা। অনাস্থা নয়, বরং আস্থার নতুন দিক উন্মোচিত হোক। দূর হোক রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে মানুষকে সেবা দেওয়া পুলিশের ব্যক্তিজীবনের যাবতীয় দৈন্য আর হতাশা। পুলিশ বাহিনীকে আরও আধুনিক করা হোক, খসড়া পুলিশ আইন চূড়ান্ত হোক, যার সুফল পেতে পারে সমগ্র জাতি।

গত সেপ্টেম্বরে আন্তর্জাতিক শিশু অধিকার সপ্তাহে শিশু একাডেমিতে যোগ দিয়েছিলাম শিশুদের একটি সেশনে। আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল, ‘পুলিশ আমার বন্ধু’। অবাক হয়ে শুনছিলাম পুলিশের কাছ থেকে আমাদের শিশুদের নানা প্রত্যাশার কথা। করোনার লকডাউন পরিস্থিতি পুলিশের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারের যে সুযোগ করে দিয়েছে, তা যেন চলমান থাকে। পুলিশ যেন সত্যিকার অর্থেই সবার বন্ধু হয়ে থাকে।

লেখক পরিচিতি: লেখক ও গবেষক

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here