আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী
শেখ হাসিনা গত ১৭ এপ্রিল ঢাকা থেকে সৌদি আরব হয়ে লন্ডনে এসেছেন। লন্ডনে তিনি খুবই ব্যস্ত সময় কাটাবেন। কমনওয়েলথ সম্মেলনে যোগ দেওয়া ছাড়াও তাঁর আরো কর্মব্যস্ততা রয়েছে। এবার ঘরে-বাইরে তাঁর জন্য সমস্যা তৈরি হয়েছে। ঘরে সরকারি চাকরিতে কোটা প্রথা বাতিলের আন্দোলনের দাবি মেনে নিয়ে তাঁকে বাইরে বেরোতে হয়েছে। বাইরে কমনওয়েলথ সম্মেলনে নিশ্চয়ই টেরেসা মের সরকার সিরিয়ায় পশ্চিমা ত্রিশক্তির ‘বেআইনি যুদ্ধটি’কে কমনওয়েলথের সদস্য রাষ্ট্রগুলো যাতে সমর্থন দেয়, তার চেষ্টা করবে। বাংলাদেশ এখানে একক অথবা জোটবদ্ধভাবে কোনো সুষ্ঠু ভূমিকা নিতে পারে কি না তা দেখার রইল।
কোটা প্রথা বিলোপের দাবি সহিংস আন্দোলনে পরিণত হয়েছিল। এই আন্দোলনে ঢুকে তাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার যে ষড়যন্ত্র সাবোটিয়ারেরা করেছিল, সরকার তা ব্যর্থ করেছে। আমি নিজে কোটা প্রথা সংস্কারের পক্ষপাতী ছিলাম, বিলোপের নয়। তবে সরকার যখন দাবিটি মেনে নিয়েছে, তখন এটা নিয়ে নতুন করে বিতর্কে জড়াতে চাই না। সরকার শুরুতেই সাবোটিয়ারদের কবল থেকে আন্দোলনটিকে মুক্ত রাখতে পারলে রাজনীতির হার-জিতের খেলা উতরে উঠতে পারত।
কোটা প্রথা বাতিলের আন্দোলন একটি কঠিন সত্যের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে। সত্যটি হলো—দেশে সরকারের বিরোধিতা নেই, বিরোধী দল নেই ভেবে আওয়ামী লীগের বেশির ভাগ নেতা, মন্ত্রী ও এমপি একটি সাধারণ নির্বাচনের আগেও যে কুম্ভকর্ণের নিদ্রা দিচ্ছেন, তা বিপজ্জনক। বিভিন্ন ননইস্যুকে ইস্যু করে সরকার উচ্ছেদের আন্দোলন করার শক্তি বিএনপি-জামায়াতের নেই—এ কথা সত্য। কিন্তু কোনো প্রকৃত ইস্যু নিয়ে আন্দোলন হলে কোনো রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব ছাড়াই যে আন্দোলন গড়ে উঠতে পারে এবং এত উন্নয়ন সত্ত্বেও দেশের মানুষকে তা প্রভাবিত করতে পারে তা কোটা প্রথাবিরোধী আন্দোলনে প্রমাণিত হলো।
আরো একটি দুর্ভাগ্যের বিষয়, এই আন্দোলনে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগের গণবিচ্ছিন্নতা ধরা পড়ল। কোটাপদ্ধতির বিরুদ্ধে দেশের তরুণসমাজের একটা বড় অংশের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরেই ক্ষোভ বিরাজ করছিল। এই ক্ষোভ দূর করার দায়িত্ব ছিল ছাত্রলীগ, যুবলীগের মতো আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনগুলোর। কোটাপদ্ধতির ভালো ও মন্দ দুই দিকই যুবসমাজের কাছে তুলে ধরে এই পদ্ধতি একেবারে বাতিলের দাবি থেকে তাদের নিবৃত্ত করতে তারা পারত, সরকারও এই প্রথা একেবারে বাতিল না করে তা সংস্কার করে গণদাবি পূরণ করতে পারত।
এই আন্দোলন প্রমাণ করল, মাঠের আন্দোলন বা কোনো সংকটে যুবসমাজকে প্রভাবিত করার আগের সেই ক্ষমতা ছাত্রলীগ ও যুবলীগের সম্ভবত আর নেই। আত্মদ্বন্দ্বে ও স্বার্থদ্বন্দ্বে তারা এতই জর্জরিত যে দেশের ছাত্র ও যুবসমাজকে নেতৃত্বদানের মতো আগের নৈতিক শক্তি তারা হারিয়েছে। আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনগুলোর এই ‘শক্তি শূন্যতা’র জন্যই যে আন্দোলনটি হওয়ার কথা ছিল শান্তিপূর্ণ এবং অরাজনৈতিক, তাতে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপরায়ণ সাবোটিয়ার ঢুকে হিংসা ও সন্ত্রাসের পথে টেনে নিয়ে যেতে পেরেছে।
আন্দোলন এখন চুকেবুকে গেছে। তবু আজ তা নিয়ে আলোচনা করছি এ জন্যই যে এই আন্দোলন থেকে ক্ষমতাসীন দল ও তার সরকারের এখনই সতর্ক ও সক্রিয় হওয়া উচিত। তারা যদি শেখ হাসিনার নেতৃত্বের ক্যারিশমা, উন্নয়নের প্রচারমহিমা দ্বারা সহজেই নির্বাচনে জয়ী হবেন ভেবে কুম্ভকর্ণের নিদ্রায় মগ্ন থাকে এবং ভাবে, জেগে উঠে তারা দেখবে ২০১৪ সালের মতো নির্বাচনে জয় তাদের হাতের মুঠোয়, তাহলে তারা নিজেরা ডুববে, দেশকেও ডোবাবে।
আওয়ামী লীগ সরকার দেশের বিস্ময়কর অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটিয়েছে—এ কথা সত্য। কিন্তু দৃশ্যমান এই উন্নয়ন সত্ত্বেও কোটা প্রথার মতো অনেক ছোট-বড় সমস্যা এখনো আছে এবং সাধারণ মানুষের মনে তা নিয়ে অসন্তোষও আছে। এই অসন্তোষকে বিক্ষোভে পরিণত করে পেছন থেকে রাজনৈতিক ফায়দা লোটার চেষ্টা বিএনপি-জামায়াত, এমনকি সরকারের অদৃশ্য শত্রুপক্ষও করতে পারে। কোটা প্রথাবিরোধী আন্দোলনেও তারা তা করেছে। তারা জানে বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক আন্দোলন করতে গেলে তারা সফল হবে না। কিন্তু কোনো কোনো অরাজনৈতিক ইস্যু নিয়ে সাধারণ মানুষের মনে যে স্বাভাবিক ক্ষোভ আছে, তাকে উসকে দিয়ে অরাজনৈতিক আন্দোলনের পেছনে কৌশলী অবস্থান নিয়ে তাকে সরকারবিরোধী সহিংস আন্দোলনেও পরিণত করা সম্ভব। আমার ধারণা, আগামী নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের প্রকাশ্য ও নেপথ্যের শত্রুরা কোটা প্রথার মতো আরো কোনো কোনো ইস্যু নিয়ে অরাজনৈতিক চেহারার আন্দোলন গড়ে তুলতে চেষ্টা করবে এবং তার দ্বারা হয় নির্বাচন বানচালের অথবা সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার প্রয়াস চালাবে।
বিএনপির বর্তমান ভারপ্রাপ্ত নেতা তারেক রহমানের সুস্থ রাজনীতির প্রতি কোনো আগ্রহ নেই এবং সুস্থ রাজনীতিচর্চার শিক্ষা ও অভিজ্ঞতাও নেই। কিন্তু পিতার মতো ষড়যন্ত্র ও সন্ত্রাসের রাজনীতিতে তিনি পরিপক্ব। ‘লাইক ফাদার লাইক সান’। তিনি বিলেতে বসে দুই হাতে অর্থ বিলিয়ে বাংলাদেশে কী ধরনের ষড়যন্ত্রের জাল ছড়াচ্ছেন, বাংলাদেশ সরকার তার কতটা খবর রাখে তা জানি না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কমনওয়েলথ সম্মেলন উপলক্ষে লন্ডনে এসেছেন। তিনি যদি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মের সঙ্গে তারেক রহমান সম্পর্কে সরাসরি আলোচনা করেন, তাহলে ভালো হবে। বিদেশের কোনো রাজনৈতিক দলের নেতাকে ব্রিটেনে রাজনৈতিক আশ্রয় দেওয়া এক কথা; আর নিজ দেশে হত্যা, সন্ত্রাস, দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত এবং আদালতের বিচারে দণ্ডপ্রাপ্ত এক অপরাধীকে ব্রিটিশ সরকার কী করে আশ্রয় দেয় এবং পোষণ করে, সে প্রশ্নটি আজ ব্রিটিশ সরকারের কাছে গুরুত্বের সঙ্গে তোলা দরকার।
তারেক রহমান লন্ডনে বসে নাটাই ঘোরাচ্ছেন আর বাংলাদেশে ষড়যন্ত্রের ঘুড়ি ওড়ে—এই সত্যটা আজ প্রমাণিত। তাঁকে দেশবিরোধী ষড়যন্ত্র থেকে নিবৃত্ত করা গেলে বাংলাদেশে সন্ত্রাস ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতি বারো আনা হ্রাস পাবে এবং বিএনপিও একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক দল হিসেবে গড়ে ওঠার সুযোগ পাবে। আওয়ামী লীগের এক দল মন্ত্রী ও নেতা যদি হেফাজত নেতার কাছে রোজ ধরনা না দিয়ে তারেক রহমানের দুর্বৃত্তপনা থেকে দেশকে মুক্ত করার জন্য সক্রিয় হন এবং সরকারের কাছেও এ ব্যাপারে ব্রিটিশ সরকারের ওপর কার্যকর চাপ প্রয়োগের জন্য দাবি জানান, সেটাই দেশ ও আওয়ামী লীগের জন্য মঙ্গলজনক হবে।
বাজারে একটা কথা প্রচলিত—আওয়ামী লীগের শত্রু আওয়ামী লীগ। কথাটা সত্য। দেশের উন্নতি ঘটানোর কাজে শেখ হাসিনার অর্জনের কোনো তুলনা নেই। কিন্তু সব অর্জনকে বিসর্জনের কাজে আওয়ামী লীগের এক শ্রেণির মন্ত্রী, এমপি ও উপজেলা চেয়ারম্যানদের কার্যকলাপেরও কোনো তুলনা নেই। একদিকে এদের দুর্নীতি ও গণস্বার্থবিরোধী অপকর্ম তো রয়েছেই, তার ওপর নির্বাচনে দলের মনোনীত প্রার্থীর বিরুদ্ধে কতজন বিদ্রোহী প্রার্থী দাঁড়ায় তাও দেখার রয়েছে। প্রাচীন এবং বড় বটগাছেই ‘কাউয়া’ এসে ভিড় জমায়। কথাটা ওবায়দুল কাদের সঠিকভাবে বলেছেন। কিন্তু কাউয়া তাড়ানোর কাজে এখন পর্যন্ত সফল হতে পারেননি।
বিএনপির একটা অপপ্রচার—হাসিনা সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে প্রশাসনকে (সিভিল ও মিলিটারি) কাজে লাগিয়ে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে জয় ছিনিয়ে নেবে। বিএনপি অতীতে সিভিল-মিলিটারি প্রশাসনের সাহায্য ও সমর্থনে ক্ষমতায় এসেছিল এবং ক্ষমতা ধরে রাখতে পেরেছিল। সে জন্যই এখন আওয়ামী লীগ সরকারও তাই করবে বলে দুঃস্বপ্ন দেখছে। কিন্তু বাস্তবে আওয়ামী লীগের জন্য তা সম্ভব নয়। বিএনপির মতো আওয়ামী লীগ সামরিক ছাউনিতে জন্ম নেওয়া দল নয়। জনগণের আন্দোলনের মাধ্যমে জন্ম নেওয়া একটি গণতান্ত্রিক দল। জনসমর্থন তার শক্তির উৎস।
সুতরাং এই দল জনসমর্থন হারালে সামরিক-অসামরিক প্রশাসনও তা বুঝতে পারলে হাওয়া বুঝে পাল ওড়াবে। এটা সব দেশেই ব্যুরোক্রেসির ধর্ম। ১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক নির্বাচনে গোহারা হেরে মুসলিম লীগের নূরুল আমিন সখেদে বলেছিলেন, ‘আমলাতন্ত্রকে বিশ্বাস করে ভবিষ্যতে যারা নির্বাচনে জয়ী হতে চাইবে, তাদের অবস্থা নূরুল আমিনের মতোই হবে।’ জিয়াউর রহমানের আমলের এক মন্ত্রী জিয়া হত্যার পর পালিয়ে এসে লন্ডনে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের মামলা ছিল। তিনি আমার কাছে দুঃখ করে বলেছেন, ‘গাফ্ফার সাহেব, আপনাকে দুঃখের কথা কী বলব, মন্ত্রী থাকাকালে যে সচিব সর্বকাজে আমাকে উৎসাহিত করেছেন এবং সাহায্য জুগিয়েছেন, বিভিন্ন ফাইলে আমার সই নিয়েছেন, তিনিই এখন আমার বিরুদ্ধে দুর্নীতির ফাইল তৈরি করেছেন এবং আমার বিরুদ্ধে মামলায় প্রধান সাক্ষী।’
‘আমার কথাটি ফুরোলো, নটে গাছটি মুড়লো’। আমি আওয়ামী লীগের শুভাকাঙ্ক্ষী বলেই তাদের বলছি, আগামী নির্বাচনে বিএনপি জোট মাঠে থাকুক আর না থাকুক, আওয়ামী লীগের জন্য সহজ বিজয়ের কোনো রাস্তা খোলা নেই। শেখ হাসিনাকে আরো কঠোর হতে হবে। দুর্নীতিবাজ মন্ত্রী ও এমপিদের বর্জন করতে হবে। জনগণের পছন্দের সৎ ও তরুণ বয়স্কদের নির্বাচনে মনোনয়ন দিতে হবে। বিদ্রোহী প্রার্থীদের নির্মূল করতে হবে। তরুণ ভোটারদের অনুপ্রাণিত করবে—এমন কর্মসূচি দিতে হবে। এসব কথা আপ্তবাক্যের মতো শোনাতে পারে। কিন্তু আওয়ামী লীগের জন্য এটাই এখন ‘সিরাতুল মুস্তাকিম’।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here