আকবর হোসেন:
বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ যেভাবে ছড়িয়েছে ঠিক একইভাবে এই ভাইরাসকে কেন্দ্র করে নানা ধরনের ভুল খবর এবং মিথ্যা তথ্যও ছড়িয়েছে সমানতালে।
এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ছড়িয়েছে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত নানা ধরনের ভুয়া পরামর্শ। করোনাভাইরাস ঠেকাতে নানা ধরনের স্বাস্থ্য পরামর্শ দেখা যাচ্ছে – যেগুলো প্রায়ই হয় অপ্রয়োজনীয় নয়তো বিপজ্জনক। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়।
শুধু স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিষয় নয়, করোনাভাইরাসকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ধর্মীয় গ্রুপ এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থেকেও ভুয়া খবর ছড়ানো হয়েছে।
অন্যদিকে মহামারির এসময়ে ভুয়া খবর ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার উপর চড়াও হয়েছে সরকার।
ভুয়া স্বাস্থ্য পরামর্শ
সম্প্রতি ফেসবুকে এমন অসংখ্য পোস্ট দেখা গেছে যেখানে লেখা: রসুন খেয়ে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধ করা সম্ভব।
এমন প্রেক্ষাপটে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে “যদিও রসুন একটা স্বাস্থ্যকর খাবার এবং এটাতে এন্টিমাইক্রোবিয়াল আছে” কিন্তু এমন কোন তথ্য প্রমাণ নেই যে রসুন নতুন করোনাভাইরাস থেকে মানুষকে রক্ষা করতে পারে।
সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট সংবাদপত্রে খবর বের হয়েছে যে করোনাভাইরাস থেকে রক্ষা পেতে একজন নারী দেড় কেজি কাঁচা রসুন খেয়ে মরণাপন্ন হয়েছে।
ঢাকার বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজের অধ্যাপক শারমিন ইয়াসমিন বলেন, এ ধরণের ভিত্তিহীন পরামর্শের কারণে মানুষ অনেক সময় মূল স্বাস্থ্যবিধি বাদ দিয়ে অন্যদিকে ঝুঁকে যেতে পারে।
“মহামারির সময় মানুষের মন দুর্বল থাকে। তখন যে বিষয়টা প্রতিকার দেবে বলে মনে হয়, মানুষ তখন সেটা গ্রহণ করতে চায়। এর একটা ভয়াবহ দিক হচ্ছে রোগ প্রতিরোধের জন্য বৈজ্ঞানিক পন্থা থেকে মানুষ সরে আসতে চায়।”
করোনাভাইরাসের প্রতিষেধক নিয়ে নানা ভুয়া খবর ছড়িয়েছে
অজ্ঞতা ও গুজব
পৃথিবীজুড়ে সর্বশেষ মহামারি এসেছিল ১০০ বছর আগে যেটি ছিল স্প্যানিশ ফ্লু। তবে ডিজিটাল যুগে এটাই প্রথম মহামারি, যেটি পুরো বিশ্বকে কাঁপিয়ে দিয়েছে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে মানুষের হাতে কাছে এখন প্রচুর তথ্য। এর মধ্যে কোনটি গুজব আর কোনটি সত্য – এটি নির্ণয় করা মানুষের জন্য বেশ কঠিন।
মার্চ মাসের প্রথম দিকে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় গুজব ছড়িয়েছিল যে থানকুনি পাতা খেলে করোনাভাইরাস আক্রমণ করতে পারবে না। একজন পীরের বরাত দিয়ে ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়িয়েছে এই গুজব।
এছাড়া টেলিফোনের মাধ্যমেও একজন থেকে আরেকজনের কাছে এই বার্তা পৌঁছে যায়। ফলে হাজার-হাজার মানুষ থানকুনি পাতা সংগ্রহ করতে নেমে যায়।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোকলোর বিভাগের অধ্যাপক সুস্মিতা চক্রবর্তী নিয়মিত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম পর্যবেক্ষণ করেন।
তার পর্যবেক্ষণ হচ্ছে – বাংলাদেশের মানুষ যেহেতু মহামারির সাথে পরিচিত নয়, সেজন্য নানা রকম ভয় এবং উদ্বেগ থেকেই এমন তথ্য ছড়িয়েছে।
“যখন এ রকম একটা ভয়াবহ রোগ, যার কোন ঔষধ নাই, মানুষ তখন অনেক কিছু ট্রাই করে। থানকুনি পাতার ঔষধি গুণ আছে,এটা পরীক্ষিত। কিন্তু এটার সাথে করোনার কোন সম্পর্ক নাই।”
সুস্মিতা চক্রবর্তী, অধ্যাপক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
তিনি বলেন, মহামারির সময় মানুষ চিকিৎসা নিয়ে আশা খুঁজতে চায়।
চিকিৎসকরা বলছেন, যে কোন মহামারির সময় মানুষ উদ্বেগ এবং আতঙ্ক থেকে নানা ধরণের প্রতিকারের উপায় খুঁজতে থাকে।
এক্ষেত্রে যেসব তথ্য তাদের চিন্তাধারার সাথে মিলে যায়, সেগুলোর বৈজ্ঞানিক ভিত্তি থাকুক না থাকুক – তখন মানুষ সেগুলো গ্রহণ করে।
ঢাকার বক্ষব্যাধি হাসপাতালের চিকিৎসক কাজি সাইফুদ্দিন বেন্নুর বলেন, স্বাস্থ্য বিষয়ক যেসব ভুল তথ্য ছড়ানো হয়েছে তার বেশিরভাগই অজ্ঞতা থেকে হয়েছে।
“মহামারির সময় মানুষের মন দুর্বল থাকে। দুর্বল মনের মানুষ খড়কুটো দেখলেও আঁকড়ে ধরতে চায়। অনেক সময় সেখান থেকেও বৈজ্ঞানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত নয় এমন তথ্য পেলেও মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়ে,” বলেন মি: বেন্নুর।
ভুয়া খবরের ছড়াছড়ি – চিকিৎসা থেকে ধর্ম
বাংলাদেশে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যেসব বিষয় ভাইরাল হয় সেগুলো আদৌ সত্য কি না তা যাচাই করে দেখে বিডি ফ্যাক্ট চেক এবং বুম বাংলাদেশ নামে দুটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান।
দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরুর আগে থেকেই গত আড়াই মাসে ৯০ টি ভাইরাল খবর যাচাই করে তারা দেখেছেন যে সেগুলো সত্য নয়।
ভারতের সুপরিচিত হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ দেবী শেঠির বরাত দিয়ে কিছু স্বাস্থ্য পরামর্শ সম্প্রতি ফেসবুকে বেশ ভাইরাল হয়েছে।
সেখানে দেবী শেঠিকে উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে কাশি এবং জ্বর হলেই করোনাভাইরাসের পরীক্ষা করার প্রয়োজন নেই।
বুম বাংলাদেশ-এর কদর উদ্দিন শিশির বলেন, তারা যাচাই করে দেখেছেন, মি: শেঠি এ ধরণের কোন পরামর্শই দেননি।
করোনাভাইরাসের সময় স্বাস্থ্য বিষয়ক ভুয়া খবর যেমন ছড়িয়েছে, তেমনি অন্য এমন কিছু বিষয় ছড়িয়েছে যেগুলোর রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় মাত্রা রয়েছে।
এসব ভুয়া খবর ছড়ানোর সাথে ধর্মীয় গোষ্ঠী, রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী ও তাদের অনুসারীরা জড়িত ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে।
বিভিন্ন ইসলামপন্থী সংগঠন এবং তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল অনেকেই এমন খবর ছড়িয়েছে যে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে চীনের প্রেসিডেন্ট দেশটির বিভিন্ন মসজিদে যাচ্ছেন এবং অনেকেই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করছে।
করোনাভাইরাসের সময় ইন্টারনেটে যেসব গুজব ছড়িয়েছে সেগুলো পর্যবেক্ষণ করেছে বেসরকারি সংস্থা সাউথ এশিয়া সেন্টার ফর মিডিয়া এন্ড ডেভেলপমেন্ট।
প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা আফিয়া সুলতানা বলেন, বাংলাদেশে যারা ওয়াজ-মাহফিল করেন তাদের মধ্যে অনেকে ইউটিউবের মাধ্যমে নানা ভিত্তিহীন কথা বলে মানুষকে বিভ্রান্ত করেছে।
“মুসলমানদের করোনা হবে না, করোনা হচ্ছে আল্লাহর সৈনিক। চীনকে শাস্তি দেয়ার জন্য এবং বিধর্মীদের শাস্তি দেয়ার জন্য এটা আল্লাহ পাঠিয়েছে – এ রকম বহু কথা ইউটিউবে এবং ফেসবুকে ছড়ানো হয়েছে,” বলেন আফিয়া সুলতানা।
মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় বিধি-নিষেধ
গুজবের বিষয়টিকে ব্যবহার করে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মতপ্রকাশের স্বাধীনতার নতুন বিধি নিষেধ আরোপ করতে দেখা যাচ্ছে যার অংশ হিসেবে লেখক, সাংবাদিক, ব্যবসায়ী এবং কার্টুনিস্টসহ চারজনকে আটক করেছে এবং ১১ জনের বিরুদ্ধে বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দায়ের করেছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, গুজবকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে সরকারি অব্যবস্থাপনাকে ঢাকার চেষ্টাও করা হয়েছে।
আক্রান্ত কিংবা মৃত ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যদের বহু মর্মস্পর্শী বর্ণনা ফেসবুকের মাধ্যমে উঠে এসেছে।
চিকিৎসা ব্যবস্থার দুরবস্থা নিয়ে ডাক্তার এবং নার্সরা নানা সমস্যা এবং হতাশার কথা ফেসবুকের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন।
এমন প্রেক্ষাপটে সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগের তরফ থেকে একের পর এক বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়। যেসব ডাক্তার এবং নার্স ফেসবুকে সমালোচনায় মুখর হয়েছেন তাদের কয়েকজনের বিরুদ্ধেও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
এছাড়া ডাক্তার এবং নার্সরা যাতে গণমাধ্যমের সাথে কথা বলতে না পারেন সেজন্য বিভিন্ন নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
এসব বিষয় নিয়ে অনেকে ফেসবুকে তাদের ক্ষোভ এবং হতাশার কথা তুলে ধরেন।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সুস্মিতা চক্রবর্তী, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হবার পর থেকে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বেহাল দশা দেখে তিনি আতঙ্কিত এবং উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন।
“মানুষ হসপিটালে হসপিটালে দৌড়চ্ছে তার ভাই নিয়ে, মা নিয়ে, বাবা নিয়ে। কোন হসপিটাল তাদের রাখছে না। হসপিটালে ডাক্তারদের সরঞ্জাম নেই, ডাক্তাররা মারা যাচ্ছেন। এটা তো মেনে নেয়াও কঠিন।”
“সমালোচনা করার অধিকার আমার আছে। আমি এদেশের একজন নাগরিক। কিন্তু গুজবটাকে এখন ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছেন যারা আধিপত্যশীল তারাই,” বলছিলেন সুম্মিতা চক্রবর্তী।
বাংলাদেশে ভুয়া খবর কিংবা গুজবের বিরুদ্ধে সাধারণত নজরদারি করে পুলিশ, র্যাবসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা।
এসব সংস্থায় কর্মরত ব্যক্তিরা সবসময় দাবি করেন, ভুয়া খবর নিশ্চিত হবার পরেই তারা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছেন।
কয়েকদিন আগে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বিবিসিকে বলেন, এপ্রিল মাসের শুরুতে তার মায়ের মৃত্যুর পর জানাজায় লোক সমাগম নিয়ে তিনি নিজেও ফেসবুকে অবমাননার শিকার হয়েছেন।
তিনি বলেন, অন্য এক ব্যক্তির জানাজার ছবি তার মায়ের জানাজার ছবি হিসেবে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছিল।
সূত্র: বিবিসি বাংলা