ক‌রোনাভাইরা‌সের মহামারী‌তে অপু সব‌কিছু‌তে প্রথম দি‌কে

0
216


মাসুদ করিম:

এক
ক‌রোনাভাইরা‌সের মহামারী‌তে অপু সব‌কিছু‌তে প্রথম দি‌কে অা‌ছে । বাংলা‌দে‌শে সাংবা‌দিক‌দের ম‌ধ্যে প্রথম দি‌কে যারা কো‌ভিড ১৯ প‌জি‌টিভ হ‌য়ে‌ছে, তা‌দের ম‌ধ্যে সে অন্যতম । ওই সম‌য়ে ভাইরাস‌টি যা‌দের অাক্রমন ক‌রে‌ছে; তারা সবাই নি‌জে‌দের অাক্রান্ত হওয়ার খবর ক‌ঠোরভা‌বে গোপন রে‌খে‌ছে ।

কেন গোপন রাখ‌বে না ? যারা অাক্রান্ত তারা সবাই রী‌তিমত পা‌পিষ্ঠ ! যেন খু‌নের মামলার অাসামী ! কেউ তার বা‌ড়ির ত্রিসীমানায় যা‌বে না ! বা‌ড়ি‌তে, গ‌লি‌তে লাল পতাকা উড়‌বে ! লকডাউন ! ভাড়া বা‌ড়ি থে‌কে বের ক‌রে দে‌বে বা‌ড়িওয়ালা ! ডাক্তার, নার্স, টেক‌নি‌শিয়ান করুনার দৃ‌ষ্টি‌তে তাকা‌বে ! অপরাধীর দি‌কে সবাই যেভা‌বে তাকায় । ক‌রোনাভাইরা‌সে অাক্রান্ত কেউ যেন বেঁ‌চে থাক‌বে না । এমন ধারণা চারপা‌শে । তার মারা যাওয়া‌তো শুধু সম‌য়ের অ‌পেক্ষা ! মারা গে‌লে লাশ দাফন কর‌বে না কেউ !

এমন অবস্থার ম‌ধ্যে অপু সব স্টিগমা‌কে বু‌ড়ো অাঙুল দে‌খি‌য়ে তার ক‌রোনাভাইরা‌সে অাক্রান্ত হওয়ার কথা অামা‌দের কূট‌নৈ‌তিক রি‌পোর্টার‌দের গ্রু‌পে ফাঁস ক‌রে দিল । অামরা হায় হায় ক‌রে উঠলাম ! সর্বনাশ ! ভাল ছে‌লেটা বু‌ঝি এবার ম‌রেই গেল ! মরার প‌রে ফেসবু‌কে একটা মর্মস্প‌র্শি স্ট্যাটাস দেয়ার জন্য তার স‌ঙ্গে একটা ছ‌বি বাছাই ক‌রে রাখলাম ! এখন অবশ্য অ‌নে‌কে ক‌রোনাভাইরা‌সে অাক্রান্ত হওয়ার কথা প্রকাশ কর‌ছে । অপু যখন ক‌রে‌ছে তখন ভয়টা বে‌শি ছিল ।


‌কো‌ভিড ১৯ স‌ঙ্গে নি‌য়ে অপু রী‌তিমত বিভূ‌তিভূষন ব‌ন্দোপধ্যা‌য়ের “প‌থের পাচালী”র অপু‌ ও দুর্গা‌কে ছা‌ড়ি‌য়ে গে‌ছে ! কয়‌দিন প‌রে মর‌বে এখনও বিছানায় শু‌য়ে শু‌য়ে ফেসবু‌কে পাকা পাকা স্ট্যাটাস দেয় ! ক‌রোনাভাইরাস‌কে ভয় ক‌রি না ব‌লে বেচারা ওবায়দুল কা‌দের কত গালমন্দ শু‌নে‌ছে, অার তুই‌তো অপু ! অাজরাইল কীভা‌বে জানটা নেবে সে চিন্তা কর, বাবা ! ক‌রোনাভাইরা‌সের চে‌য়ে মানু‌ষের শ‌ক্তি বে‌শি এমন কথা বলা পাপ ! এমন কথা কেউ মু‌খে অান‌লে সামা‌জিক যোগা‌যোগ মাধ্য‌মে তু‌লোধু‌নো করা হ‌বে !

অপুর পু‌রো নাম অা‌শিকুর রহমান অপু । এ‌টিএন নিউ‌জের রি‌পোর্টার । অা‌মি অার অাঙ্গুর নাহার ম‌ন্টি ম্যা‌সেঞ্জা‌রে অালাপ ক‌রি, অপুটা‌রে ক‌রোনায় ধ‌রে‌ছে, এখন কী হ‌বে ?

ম‌ন্টি ডিকা‌বের সভাপ‌তি । ম‌ন্টির জ‌ন্যেও খারাপ লা‌গে, অ‌নেক শখ ক‌রে সভাপ‌তি হই‌ছে, সংগঠ‌নের কাজ কর‌বে, এখন ভাইরাস অাসায় কাজ কর‌তে পার‌ছে না । তবু সংগঠ‌নের সভাপ‌তি তাই সদস্য‌দের সু‌খেদুঃ‌খে খোঁজ নেয়া তার দা‌য়িত্ব । জিজ্ঞাসা করলাম, অপুর খবর নি‌য়েছ ? ম‌ন্টি ব‌লে, “জি‌নিয়ার স‌ঙ্গে কথা হই‌ছে । এ‌টিএন নিউজ সব সা‌পোর্ট দি‌চ্ছে । অা‌মি ব‌লে‌ছি, কখন কী লাগ‌বে জানাবা” ।
অপু কি ভয় পাই‌ছে না‌কি ? অা‌মি জিজ্ঞাসা করলাম ।
ম‌ন্টি ব‌লে, “ভয়‌তো পাই‌ছেই । মু‌খে না বল‌লে কী হ‌বে !”
অা‌মি বললাম, ভয় পাই‌লে শেষ । অার বাঁচা‌নো যা‌বে না !

‌জি‌নিয়া অপুর বউ । দুইজন মি‌লে অপুর সংসার । অা‌মি ভাবলাম, অপুর একটু খোঁজ নেয়া দরকার । য‌দি মইরা যায় কষ্ট নিয়া মর‌বো । ভাই‌রে এত ভালবা‌সি, একটাবার খবর নিল না ! বিপ‌দে না‌কি প্রকৃত বন্ধুর প‌রিচয় ! ভাবলাম, জি‌নিয়া‌কে একবার ফোন ক‌রি । সৌজন্য দেখাই । অপু বেঁ‌চে গে‌লে বল‌তে পার‌বো, খোঁজ নি‌য়ে‌ছিলাম । জি‌নিয়া বোধ হয় ড‌রেভ‌য়ে স্থির হ‌য়ে গে‌ছে । হাজার হ‌লেও মে‌য়ে মানুষ ! বাচ্চা‌মে‌য়ে । এতবড় বিপদ সামলাবে কেম‌নে ! জি‌নিয়া‌কে ফোন করলাম । ওমা ! এ ত দে‌খি অারও এক‌ ডিগ্রী বে‌শি ! কথাবার্তায় ভয়ড‌রের লেশ নেই । অা‌মি বললাম, তু‌মি দূ‌রে থে‌কো । ভাইরাস অাবার তোমার ম‌ধ্যে এ‌সে যা‌বে ।

জি‌নিয়া ব‌লে,”দূ‌রে অা‌ছি । অভ্যাস হ‌য়ে গে‌ছে ভাই । ক‌য়েক দিন অা‌গে ১৪ দি‌ন কোয়া‌রে‌ন্টিন করে‌ছে” । কোনও প্র‌য়োজন হ‌লে ফোন ক‌রো ব‌লে ফোন রাখলাম । জি‌নিয়ার স‌ঙ্গে কথা বলার পর অা‌মি পু‌রোপু‌রি অাশ্বস্ত, অপু মর‌বে না । মে‌য়ে‌টোর সাহস অা‌ছে । সব সামলা‌তে পার‌বে । ক‌রোনা রো‌গের কোনও ওষুধ না থাক‌লেও একটা ওষুধ অা‌ছে । ওষুধটার নাম সাহস ।

অপুর অা‌রেকটা সাহ‌সের কাজ হল প্লাজমা দান করা । এটা‌তেও সে প্রথম দি‌কে অা‌ছে । বাংলা‌দে‌শে যারা প্লাজমা দি‌য়ে‌ছেন, তা‌দের ম‌ধ্যে অপু তৃতীয় ব্যা‌ক্তি । তার অা‌গে যে দু’ জন প্লাজমা দি‌য়ে‌ছেন, তারা ডাক্তার । ক‌রোনাজয় করার পর মানু‌ষের দে‌হে এ‌ন্টি ব‌ডি তৈরী হয় । তা‌দের প্র‌তি‌রো‌ধে ভাইরাস পরা‌জিত হয় । ওই সব ক‌রোনাজয়ী‌দের দেহ থে‌কে রক্তরস তথা প্লাজমা নি‌য়ে কো‌ভিড ১৯ অাক্রা‌ন্তের দে‌হে দি‌লে অ‌নে‌কে সুস্থ হ‌য়ে ও‌ঠেন । প্লাজমা দেয়া নি‌য়ে মানু‌ষের ম‌নে ভয় হয় । এ কার‌ণে প্লাজমা দাতা যখন খোঁজা শুরু; ওই সম‌য়ে অপু প্লাজমা দি‌য়ে‌ছে । তাই তার নাম ছাড়া বাংলা‌দে‌শে প্লাজমা দা‌নের ই‌তিহাস রচনা সম্ভব নয় ।

দুই
অামার প‌রি‌চিত অ‌নেক‌কে দে‌খে‌ছি, একটু গলা খুশখুশ কর‌লে, স্বাভা‌বিক হাঁ‌চি এ‌লে কিংবা শরীরটা সামান্য গরম হ‌লে ভ‌য়ে নীল হ‌য়ে যায় । ফেসবু‌কে স্ট্যাটাস দেয় । সবাই দোয়া কর‌বেন । করুনার উপসর্গ দেখা দি‌য়ে‌ছে । অাল্লাহ যেন রহম ক‌রে । এসব দে‌খে অামরা সবাই অাহাজা‌রি শুরু ক‌রি । চি‌লে কান নি‌য়ে‌ছে অবস্থা । একবার টেস্ট ক‌রি‌য়ে দে‌খি না ।

যারা ক‌রোনা উপসর্গ ম‌নে ক‌রে মরার অা‌গে মানু‌ষের যে দশা হয় তেমন ছটফট শুরু ক‌রেন; অা‌মি নি‌শ্চিত তা‌দের ৮০ ভা‌গের বে‌শি মানু‌ষের ক‌রোনা হয়‌নি । তা‌দের যে রোগটা হ‌য়ে‌ছে এ রো‌গের অা‌মি নাম রে‌খে‌ছি “প্যা‌নিক সিন‌ড্রোম” মা‌নে অাতঙ্ক রোগ । এ রোগ হ‌লে কোনও চি‌কিৎসা নাই । তাই এ রো‌গ হ‌লে রক্ষা নাই । মহামারীর কা‌লে চারপা‌শে যত অঘটন মা‌নে স্টিগমা তার একটাই উপসর্গ সেটা হল অাতঙ্ক ।

অামরা সবাই মি‌লে প‌ত্রিকায়, টি‌ভি‌তে, ফেসবু‌কে সে অাতঙ্ক ছ‌ড়ি‌য়ে যা‌চ্ছি । স‌ঠিক তথ্য দি‌য়ে মানুষ‌কে স‌চেতন কর‌ছি না । কারণ সমা‌জে মহামারী মা‌নে অাতঙ্ক ব‌লে যে সংস্কৃ‌তি গ‌ড়ে উ‌ঠে‌ছে সেটা‌কে চ্যা‌লেঞ্জ করার অর্থ সমা‌জে প্র‌তি‌ষ্ঠিত নিয়ম‌কে অগ্রাহ্য করা । সমা‌জের বিরু‌দ্ধে দাঁ‌ড়ি‌য়ে কেউ টি‌কে থাক‌তে পা‌রে না । তাই, অাসুন, অামরা সবাই মি‌লে অাতঙ্ক সৃ‌ষ্টি ক‌রি !

ঢাকা
২০ মে ২০২০
লেখক: প্রধান প্রতিবেদক: দৈনিক যুগান্তর

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here