সোশাল ডিস্টেন্স মেনে ব্যাকইয়ার্ডয়ে এবারের ঈদ

0
232

ইব্রাহিম চৌধুরী:
একদম প্রত্যন্তর গ্রাম থেকে আসা মানুষ আমি।
আমার গ্রামের বাড়ির একপাশে হিন্দু বাড়ি। আরেক পাশে খৃষ্টান বাড়ি। বাংলাদেশের জন্য খুব বিরল জনারণ্য। ছোটবেলায় তিনটে দিনের জন্য অপেক্ষা করতাম । ঈদ , পুঁজো আর বড়দিন। দিনটিতে নানা পদের খাবার থাকতো , এ কারণেই আমার যতো ভালো লাগা ।
আমার পাঠশালার বন্ধু সৈন্ধা , দীপালীদের বাড়িতে পূজোর খৈ, মুড়ি । খৃষ্টান সহপাঠী শ্যামল সেই শিশুকাল থেকেই সংগে ছিল। বড়দিনে গীর্জায় গেলে আমাকে আলাদা মিষ্টান্ন তুলে দিতো। নিজে না খেয়ে আমি খাচ্ছি দেখে বেচারা সুখ পেতো।
শিশুকালে ঈদ আমার জন্য যে খুব খুশীর ছিলো , তা বলা যাবে না। ঈদ শীতের দিনে ছিলো। বেশ ভোরে উঠে পুকুরের হিম শীতল পানিতে গোসল করা আমার জন্য অন্যের দেখাদেখিতে। কষ্ট হলেও, খুশী হচ্ছি বলতাম। এমন আজো করি কতো কারণে।


শিশুকালে প্রথম দাঁড়ালো ঈদের জামাতে যেতে হবে। একাত্তর সাল। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বছর। পাজামা , ফুল প্যান্ট নেই। আমাকে একটা লুঙ্গি দেয়া হলো পরার জন্য। এ নিয়ে বেশ ঝামেলা হলো । আমাদের বাড়ির গৃহকর্মি ফরিদ ছাগল বাঁধার দড়ি দিয়ে লুঙ্গি আটকে দেয়ার কথা মনে আছে। আমার এক দাদা বলছিলেন , একদম যোগ্য লোকের কোমরে দড়ি পড়েছে। বেশী উৎপাত করলে একই খুটির সাথে, একই দড়ি দিয়ে বাঁধা যাবে !
তো আমার বাবা তাঁর লুঙ্গি পরার গল্প সেদিনই শুনিয়েছিলেন। তাঁরা ধুতি পরতেন। দাদা কোনদিনই লুঙ্গি পরেননি। এ লুঙ্গি জিনিসটা নাকি বার্মা বা আরকান থেকে আমাদের পূর্বসূরীরা নিয়ে এসেছিলেন। বাবা বীর দর্পে বলছিলেন , তাঁর প্রথম বিয়েতে ধুতি পরে কেমন করে বর সেজেছিলেন। তখন নাকি সম্পন্ন লোকজন ধুতিই পরতেন। জিজ্ঞেস করছিলাম , অন্যরা ?
ঃ ওরা নেংটি পরতো।
নেংটি জিনিসটা কি, তা বুঝাতে পারবো না দেখে আমার ছেলে মেয়েকে এ গল্পটাই করতে পারি না।
লুঙ্গি জিনিসটাকে সেখানেই সেলাম দিয়েছিলাম। ধুতিও আমার পরা হয়নি। একবার নাটকে মনির ভাই পরতে বলেছিলেন । মঞ্চে উঠলে কোন কেলেঙ্কারি হবে মনে করে আমি কিছুতেই রাজী হয়নি। ননি কাকার রোলটা পাজামা পরেই সেরেছিলাম।
আসা যাক ঈদের পাঞ্জাবী পরা নিয়ে। দেশ থেকে প্রায়ই কেউ আসেন । প্যাকেজ ডেলিভারি আসে । মেয়েকে জিজ্ঞেস করি , তোমার খালামনি আমার জন্য কিছু দিলো?
নির্ঘাত আমার জন্য সান্ত্বনা পুরষ্কার হিসেবে একটা পাঞ্জাবী আসে। এ পোশাক আমার খুবই অপছন্দের।আমি টি শার্ট পরা মানুষ , পাঞ্জাবী পরে কখনো স্বস্থি বোধ করি না। ঈদের দিনে ঢেঁকি গিলতে হয় বলে পরি । কতো দ্রুত এটা খুলে রাখবো , এনিয়ে ব্যস্ত থাকি।
ঈদের দিন কুলাকুলি করা , আর হ্যান্ডসেক করার চাপ থাকে। কোন এক কারণে এ দুটো বিষয়েই আমি কখনো স্বচ্ছন্দ নই।
আমাদের লোকজনের হাত প্রায়ই নাকের মধ্যে চাবি দিয়ে তালা খোলার মতো ঘুরাতে দেখি। কারো হাত ঘর্মাক্ত থাকে । কেউ হাতে জোরে চাপ দেন – কেউ হাত ধরে দাঁড়িয়ে থাকেন। কথা শুরু করার আগে হ্যান্ডশেক একবার , পরে আরেকবার বিদায় নেয়ার সময় । এনজিওদের এক একট্রেনিং থেকে জেনেছিলাম ,গড়ে দেড় মিনিটের সময়ের অপচয় হয় এ হ্যান্ডশেক প্রক্রিয়ায়। আমার এক সুহৃদ আবু তাহের আর তার হ্যান্ডশেক নিয়ে পত্রিকায় লিখে বেশ ঝামেলায়ও পড়েছিলাম একবার!
হ্যান্ডশেক বরাবরই এড়িয়ে চলি । কমরেড আশিক চৌধুরী হাত উঠিয়ে অভিবাদন জানাতেন। এ কাজে তাঁকেই অনুসরণ করে আসছি বরাবর।
এবার আসা যাক কুলাকুলিতে। কুলাকুলি করতে গিয়ে সিকুয়েন্সটা আমি মিস করি। কেউ ডানে ঝুঁকছেন তো আমিও ঝুঁকি একই দিকে। ফলে প্রায়ই ঝামেলা হয়। মাথায় মাথা লাগে । এছাড়া ইশতিয়াক রুপু , সালেহ বা রহমান মাহবুবের মতো লম্বা চওড়া মানুষের সাথে বুক মেলামেলি করে অস্বস্থি লাগে। তাদের পেটে আমার কান লাগে। লম্বা মানুষের সাথে কুলাকুলি করে নিজের দুর্বলতাটা টের পেয়ে আমি আর আনন্দ পাই না ।
করোনাকালের ঈদ এ দু’টোকেই মুক্তি দিয়েছে !

সোশাল ডিস্টেন্স মেনে ব্যাকিয়ার্ডে এবারের ঈদ । ভাই বোন , তাদের সন্তানরা সহ আমাদের আঙ্গিনায় ঈদের খাবার। সবাই এক ভিন্ন আবহে।
এমন দিনে আমার মা বসে থাকতেন।অনেক খাবার সামনে থাকলেও সতর্ক করে দিতেন, সামনে যা পাও সব খেয়ে ফেলো না। পেট খারাপ করবে!
মায়ের এ কথাটা মেনে চলি। সামনে পেলেই খাওয়ার ইচ্ছে হয় না আমার । যা সামনে থাকে না , তা নিয়ে মন আনচান করে!
প্রতি ঈদের নিউজার্সিতে আমার ঘরে এমনি ঈদের মেলা বসে।
ভাই বোনরা , তাদের ছেলে মেয়েরা ঈদ আসলেই সেলাম করে । সালামি গুনতে হয়। প্রতি বছর তালিকাটার আপডেট নেই।
একবার দেখি আমার মেয়ে তাঁর বার্ষিক আয় ব্যয়ের একটা বাজেট করছে। সেখানে দুই ঈদের সেলামি বাবত আয়ের কলাম দেখে অবাক।
এবারে নিশ্চয়ই এ বাজেট বিবরণীতে অনেক কাটা ছেড়া করতে হবে !
বেকারভাতাও পাচ্ছি না এখনও । বলতেই , আমার এক ভাগ্নি ফিসফিস করে বলছিলো – মামা তুমি এমনিতেই কঞ্জুস !

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here